দ্বিমেরু প্রভাবে এবার শীতকাল ব্যতিক্রমী হতে পারে

দেশে এবারের শীতকাল অন্য বছরগুলোর তুলনায় কিছুটা ব্যতিক্রমী হতে পারে। কারণ, এবার শীতের মধ্যেও বঙ্গোপসাগর হঠাৎ উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে।কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম উপকূলে বঙ্গোপসাগরের তাপমাত্রা মূল ভূখণ্ডের চেয়ে প্রায় ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি হয়ে গেছে।অন্যদিকে, হিমালয় থেকে এবার অপেক্ষাকৃত শীতল বাতাস উত্তরাঞ্চল দিয়ে প্রবেশ করে সারা দেশে ছড়িয়ে হাড়কাঁপানো শীত আনার চেষ্টা করছে। কিন্তু বঙ্গোপসাগরে বাড়তি তাপের কারণে ফুটন্ত পানির ধোঁয়ার মতো ঘন মেঘ তৈরি হচ্ছে।উপকূল দিয়ে আসা উষ্ণ মেঘ আর উত্তরাঞ্চল দিয়ে আসা হিমেল বাতাসের মধ্যে রীতিমতো লড়াই শুরু হয়েছে। এ কারণে শৈত্যপ্রবাহ শুরু হতে না হতেই মেঘের দল এসে তাতে উত্তাপ ঢেলে দিচ্ছে।অস্ট্রেলিয়া ও ভারতের আবহাওয়া বিভাগ বঙ্গোপসাগর নিয়ে নতুন এক তথ্য দিয়েছে। তারা বলছে, বঙ্গোপসাগরে ইন্ডিয়ান ওশান ডাইপল বা ভারত মহাসাগর দ্বিমেরু পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।

আবহাওয়াবিদ্যায় যাঁরা পারদর্শী নন, তাঁরা হয়তো বলে উঠবেন, এটা আবার কী?এর উত্তরে আবহাওয়াবিদদের জবাব, এটা অনেকটা প্রশান্ত মহাসাগরের ‘এল নিনো’ ও ‘লা নিনার’ মতো একটা বিষয়।এই জবাবে বেশির ভাগ মানুষের সন্তুষ্ট হওয়ার কথা নয়। আবহাওয়ার এই জটিল পরিভাষা যাঁদের বুঝতে সমস্যা হচ্ছে, তাঁদের জন্য সহজ উত্তর হলো, ভারত মহাসাগর থেকে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে একদিকে সাগরের পানি স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি গরম হয়ে ওঠে, অন্যদিকে পানি স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি ঠান্ডা হয়ে যায়।ভারত মহাসাগরের তাপমাত্রার তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বাংলাদেশের কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম উপকূলের তাপমাত্রা বর্তমানে ২৭ থেকে ২৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে থাকছে, যা এই সময়ের স্বাভাবিক তাপমাত্রার চেয়ে ২ থেকে ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি।আবহাওয়াবিদেরা বলছেন, ভারত মহাসাগরে সৃষ্টি হওয়া দ্বিমেরু পরিস্থিতির কারণে একদিকে আন্দামান ও ইন্দোনেশিয়ার জাভা অঞ্চলের তাপমাত্রা প্রায় ৩০ ডিগ্রির কাছাকাছি চলে গেছে। এ কারণে সেখানে একটি সুস্পষ্ট লঘুচাপ তৈরি হয়েছে। এটি আজ বুধবারের মধ্যে ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হতে পারে। বাতাসের ধাক্কায় ওই উত্তপ্ত পানি বাংলাদেশ ও ভারতের বঙ্গোপসাগর অংশে চলে আসছে। এ জন্য এখানেও তাপমাত্রা বেড়ে গেছে।


এ বিষয়ে বাংলাদেশের আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ বজলুর রশিদ বলেন, মূলত মিয়ানমার ও ভারতের পূর্বাঞ্চলের জলসীমায় সৃষ্টি হওয়া মেঘ বাংলাদেশের ওপরে আসছে। এ জন্য আগামী দু-এক দিন বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় শীত কমবে। তবে দেশের উত্তরাঞ্চল দিয়ে হিমেল হাওয়ার প্রবাহ অব্যাহত থাকবে। তাই সেখানে শীত ও শৈত্যপ্রবাহ জানুয়ারি পর্যন্ত চলবে।বাংলাদেশ ও ভারতের আবহাওয়া বিভাগ বলছে, উত্তপ্ত পানির কারণে সৃষ্টি হওয়া মেঘ মিয়ানমারের আরাকান পর্বতমালা ও ভারতের মিজোরাম-অরুণাচলের পর্বতমালায় বাধা পাচ্ছে। এ কারণে আজ বাংলাদেশ, ভারত ও মিয়ানমারের উপকূলীয় এলাকায় ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হতে পারে। সাগরের বাড়তি উত্তাপের কারণে আগামী দুই দিন মেঘের আনাগোনা বেড়ে দেশের উপকূলীয় এলাকাগুলোয় শীত কমে আসতে পারে।বাংলাদেশের আবহাওয়া অধিদপ্তরের পূর্বাভাসে বলা হয়, আজ দেশের বিভিন্ন স্থানে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হতে পারে। দেশের বেশির ভাগ এলাকার আকাশে মেঘ ও কুয়াশা থাকতে পারে।

যুক্তরাজ্যের রয়্যাল মেটেরোলজি সোসাইটির ‘ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব ক্লাইমোটলজি’ ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের মেঘ-বৃষ্টির সঙ্গে পাহাড়ের সম্পর্ক নিয়ে একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে।শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের প্রাক্তন-বর্তমান পাঁচ ছাত্র ও এক ভারতীয় বিজ্ঞানী মিলে বাংলাদেশের মৌসুমি বৃষ্টিপাত নিয়ে গবেষণাটি করেছেন। গবেষকেরা বলেছেন, ভারত ও মিয়ানমারের পবর্তমালা বাংলাদেশের বৃষ্টিপাতের ধরনকে অনেক বেশি প্রভাবিত করছে।গবেষণাটিতে বলা হয়েছে, আরব সাগর ও ভারত মহাসাগরে উত্তাপ বেড়ে মেঘ সৃষ্টি হলে তা দুই দেশের পর্বতমালায় বাধা পেয়ে বৃষ্টি ঝরায়। কিন্তু বাংলাদেশের আবহাওয়ার পূর্বাভাসে ওই পর্বতমালার উচ্চতাকে বিবেচনায় নেওয়া সম্ভব হয় না। কারণ, ওই দুই পবর্তমালার উচ্চতার বিস্তারিত হিসাব বাংলাদেশের কাছে নেই।

গবেষণায় বলা হয়, অনেক দূরদূরান্তের সাগরের তাপমাত্রা বাড়লে তার প্রভাবে সৃষ্টি হওয়া মেঘ পর্বতমালায় বাধা পেয়ে বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। এতে বৃষ্টি ঝরে।গবেষণাটির সঙ্গে যুক্ত কানাডার সাসকাচুয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক মোস্তফা কামাল বলেন, এবার শীতের পুরো সময় ভারত মহাসাগর ও বঙ্গোপসাগরে বাড়তি তাপমাত্রা থাকবে। এ জন্য দেশের উপকূলীয় এলাকায় শীত কম থাকবে। আর উত্তরাঞ্চলে শীত বেশি পড়বে।চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মেরিন সায়েন্স বিভাগের শিক্ষক সমুদ্রবিজ্ঞানী সাইদুর রহমান চৌধুরী বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বঙ্গোপসাগরে তাপমাত্রা বাড়ছে। দ্বিমেরু প্রভাব তাপমাত্রা বৃদ্ধিকে আরও ত্বরান্বিত করছে। এর প্রভাব আবহাওয়ার পাশাপাশি জীববৈচিত্র্যের ওপর পড়ছে।

Leave a Comment