দেশের সবচেয়ে পুরোনো বন্দুকের দোকানের অন্দরমহলে

চক সার্কুলার রোডে শুধু ভিড় আর ভিড়। মানুষ আর যন্ত্রচালিত বাহনের ভিড়, চুড়ি-জরি-সৌখিন বোতামের দোকানে ভিড়। চকবাজার শাহি মসজিদে জোহরের নামাজে মুসল্লিদের ভিড়। ব্যতিক্রম শুধু শতাব্দী প্রাচীন বন্দুকের দোকান শামসুদ্দীন আহমেদ অ্যান্ড সন্স। চকবাজার শাহি মসজিদের ডানপাশের সরু গলির মুখে লুঙ্গি-গেঞ্জি, গামছা-টুপির দোকানের পেছন দিকে ছোট্ট এক কামরায় এই দোকান। দেয়ালে ঝোলানো কাপবোর্ডে একনলা-দোনলা বন্দুক, ছোট দুটি স্টিলের র‌্যাক, একটা টেবিল, ক্রেতাদের জন্য রাখা চেয়ার—দোকানের সাজসজ্জা বলতে এটুকুই। খেয়াল করে দেখলে মনে হয় সুলভসামগ্রীর পেটের ভেতর ঢুকে পড়েছে একসময়ের বনেদি দোকানের প্রায় পুরোটাই।

শামসুদ্দীন আহমেদ অ্যান্ড সন্সের অন্যতম স্বত্বাধিকারী আবরার আহমেদ প্রথম আলোকে বলছিলেন, ‘ছেলেরা আর চায় না। বন্দুকের ব্যবসার সঙ্গে তিনপুরুষের সম্পর্ক শেষের পথে। বিক্রি নেই, সম্মানও নেই। অথচ আগে এমন ছিল না।’ দোকানটি যাঁর নামে সেই শামসুদ্দীন আহমেদের নাতি আবরার আহমেদ। তিনি ও তাঁর দুই ভাই ব্যবসাটাকে ধরে রেখেছেন। পরের প্রজন্মের আর আগ্রহ নেই। কেউ অন্য ব্যবসায় ঢুকে গেছে, কেউ চাকরি করছে। আগে কেমন ছিল? শামসুদ্দীন আহমেদ অ্যান্ড সন্সের পুরোনো কাগজপত্রে, চিঠিতে, সরকারি ফরমানে, ছবিতে, বন্দুকের বাঁটে নকশার পরতে পরতে এই প্রশ্নের জবাব পাওয়া যায়। কবে থেকে, কেন পতন সে কথাও জানান বৈধ আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবসায়ীরা।

ঢাকায় বন্দুক ব্যবসার গোড়াপত্তন
ঢাকার বন্দুক ব্যবসায়ীরা জানান, শামসুদ্দীন আহমেদ অ্যান্ড সন্সই এ দেশের সবচেয়ে পুরোনো বন্দুকের দোকান। কলকাতার ম্যান্টন কোম্পানিতে পুরান ঢাকার ছেলে শামসুদ্দীন আহমেদ গানস্মিথের কাজ করতেন । ইয়েমেনি স্ত্রী আবেদান্নেসা আর যৌথ পরিবারের সদস্যদের দেশে ফেলে রেখে চাকরিতে মন টেকেনি। ফিরে এসে ১৯১২ সালে ঢাকার চকবাজারে নিজেই শুরু করেন ব্যবসা।

একনলা-দোনলা বিদেশি বন্দুক বিক্রি করতেন, সেই সঙ্গে মেরামতের কাজটাও চালিয়ে যাচ্ছিলেন শামসুদ্দীন আহমেদ। খুব দ্রুতই তিনি সমৃদ্ধির দেখা পান। ১৯৪৮ সালে মৃত্যুর আগপর্যন্ত নিয়মিত দোকানে বসতেন। ওই সময়কার কোনো ছবি নেই। একটা সরকারি ফরমান আছে কেবল। ঢাকার ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট বি সি প্রান্সের সই করা ফরমানে লেখা, ‘আগ্নেয়াস্ত্র হেফাজতে রাখা সম্পর্কে বঙ্গীয় বিপ্লব অত্যাচার দমন আইনের ১০ ধারার ১-বি নিয়মানুযায়ী ঢাকা জেলার যাবতীয় লাইসেন্সধারী ও বিনা লাইসেন্সে

অস্ত্র রাখার অধিকারী ব্যক্তিগণের প্রতি এতদ্দ্বরা আদেশ করা যাইতেছে যে—
তাহারা নিজ নিজ বন্দুক, রাইফেল এবং গুলি বারুদ ইত্যাদি সাবধানে নিজের থাকিবার ঘরে শক্ত এবং ভারী কাঠের বাক্সে অথবা স্টিলের বাক্স ও লোহার সিন্দুকের ভিতরে আবদ্ধ রাখিবেন। উক্ত বাক্সসমূহের তালা অত্যন্ত মজবুত হওয়া দরকার এবং বাক্সের চাবি সর্ব্বদা তাহাদের নিজের হেফাজতে থাকিবে, অন্য কাহারো নিকট রাখিতে পারিবে না।

অন্যত্র যাইবার সময় যখন বন্দুক, রাইফেল কিম্বা গুলি বারুদ ইত্যাদি ছোট বাক্সে ভর্ত্তি করার প্রয়োজন হইবে তখন ঐ বাক্স তাহারা সর্ব্বদা নিজের নিকটে রাখিবে এবং কখনো এমন স্থানে রাখিবে না যেখান হইতে উহা চুরি হইতে পারে। এই ফাঁকে একটা কথা বলা দরকার। ভারতবর্ষে বারুদ ও বন্দুক কিন্তু ১৯১২ সালের আগেই ঢুকেছিল। বাণিজ্যিকভাবে এর বিক্রিবাট্টার শুরু কবে সে সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত ইকতিদার আলম খানের গান পাউডার অ্যান্ড ফায়ার আর্মস ওয়ারফেয়ার ইন মেডিয়েভেল ইন্ডিয়া বলছে, বারুদের জনক চীনারা। চীনা মিলিটারি হ্যান্ডবুকে ১০৪৪ সালে সালফার, পটাশিয়াম নাইট্রেট ও কাঠ–কয়লা দিয়ে বারুদ বানানোর উল্লেখ আছে। নাইট্রেটের পরিমাণ বাড়ালে ধ্বংসের ক্ষমতা বাড়ে এ তথ্য জানতে তাদের সময় লেগে যায় ১২৩০ সাল অব্দি।

খুব দ্রুতই বারুদের ব্যবহার বিশ্বের বিভিন্ন দেশ জেনে যায়। তবে বন্দুক পুরোপুরিভাবেই ইউরোপীয়দের আবিষ্কার। ভারতবর্ষে ১৪৯৮ সালে পর্তুগিজদের আগমনের পর কালিকটে বন্দুক বানানোর কৌশল শিখে নেন এ দেশীয় কারিগরেরা। আরও উন্নত মানের বন্দুকের দেখা যায় ১৫২৬ সালে জালালুদ্দীন মুহাম্মদ বাবর ভারতবর্ষে আগমনের পর। তবে সেই ধারার অস্ত্রও পরে মার খেয়ে যায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অস্ত্রের কাছে।

১৯৭১ সালে শামসুদ্দীন আহমেদ অ্যান্ড সন্সসহ ঢাকার বন্দুকের দোকানগুলো বড় ক্ষতিতে পড়ে। বন্দুক বাঙালিদের জিম্মায় থাকা বিপজ্জনক এই আশঙ্কা থেকে ১ মার্চ পাক আর্মিরা শতাধিক অস্ত্র নিয়ে যায়। আর ফিরিয়ে দেয়নি। যুদ্ধ শেষে বন্দুক ব্যবসায়ীরা নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হন। আত্মরক্ষা, আভিজাত্য আর শিকারের অনুষঙ্গ হিসেবে অনেকের জিম্মাতেই ছিল আগ্নেয়াস্ত্র। বই-পুস্তকেও এর উল্লেখ আছে।

কেন ছোট হয়ে আসছে বন্দুকের বাজার
একটা সময় ‘ফার গেম’ ও ‘ফিদার গেম’ দুই ধরনের শিকারই আইনগতভাবে বৈধ ছিল। পাখি শিকারের চল ছিল মোটামুটি সর্বত্র, গ্রামাঞ্চলেও প্রভাবশালীরা বন্দুক রাখতেন। গ্রামে একটা বন্দুক থাকলে ডাকাত পড়বে না এমন একটা ধারণা ছিল। এখন পরিস্থিতি বদলেছে। কথা হচ্ছিল শহীদ আনোয়ার গার্লস হাইস্কুলের শিক্ষক শাহনাজ সিদ্দিকীর সঙ্গে। তিনি রংপুর ডেইলীকে বলেন, ‘নেত্রকোনার হাওর অঞ্চলে প্রচুর পাখি, বালিহাঁস পাওয়া যায়। শীতে আব্বা নিয়মিত পাখি শিকার করতেন। আবার আমরা ছিলাম তালুকদার বংশ। নিজেদের ও গ্রামের মানুষের নিরাপত্তা দিতেও বন্দুক সঙ্গে রাখতেন আব্বা।’ বন্দুকটা এখন কোথায়? শাহনাজ জানান, শিকার নিষিদ্ধ হওয়ার পর আত্মীয়স্বজনেরা বললেন, বন্দুকের কারণে বিপদে পড়তে পারেন। তাই ওটা জমা দিয়ে দেওয়া হয়েছে।

জানা যায়, যাঁদের বৈধ অস্ত্রের লাইসেন্স আছে, তাঁদের অনেকেই এমন অস্ত্র জমা দিয়ে দিয়েছেন। অনেকে আবার বীতশ্রদ্ধও হয়ে পড়েছেন। বিভিন্ন সময় সরকারি নির্দেশে আগ্নেয়াস্ত্র থানায় জমা দিতে হয়। গুলি কিনতে আলাদা অনুমতিপত্র লাগে। এত ঝক্কি অনেকেই আর নিতে চাননা। ঢাকার একটি সিএনজি স্টেশনের মালিকের একটি রিভলবার আছে। তিনি বলছিলেন, ‘সময় সময় সরকারি নির্দেশে অস্ত্র থানায় জমা দিতে হয়। আমার ব্যবসায় কাঁচা পয়সা, ঝুঁকি আছে। সে কারণেই লক্ষাধিক টাকা দিয়ে একটা রিভলবার নিলাম। রাখিও যত্ন করে। কিন্তু মালখানায় অস্ত্র যত্নে থাকে না।’ ব্যবহারকারীদের প্রশ্ন অস্ত্র যদি থানাতেই জমা রাখতে হয়, তাহলে অত পয়সা দিয়ে কেনা কেন? তা ছাড়া, বন্দুক বা রিভলবার থাকলে পুলিশের নজরদারিতে থাকতে হয়—এটাও অনেকে পছন্দ করেন না। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন বন্দুক ব্যবসায়ী বলেন, ‘অবৈধ অস্ত্রধারীদের করুণার ওপর বৈধ অস্ত্রধারীদের টিকে থাকতে হচ্ছে। অবৈধ অস্ত্রে তো বাজার সয়লাব। টানাটানি শুধু বৈধ অস্ত্রধারীদের নিয়ে।’

বন্দুক ব্যবসায়ীরা জানান, স্বাধীনতার পর থেকেই এই ব্যবসায় উত্থান-পতন ছিল। স্বাধীনতার পর ব্যক্তিখাতে আমদানি নিষিদ্ধ হওয়ায় আমদানিকারকেরা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে আগ্নেয়াস্ত্র কিনতে হতো। জিয়াউর রহমানের সময় পরিস্থিতি আরও সঙ্গীন হয়ে পড়ে। হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের আমলে লাইসেন্স দেওয়াই একরকম বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৯৬ সালে আবারও আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবসা মোটামুটি স্বাভাবিক হতে শুরু করে। বছরপাঁচেক পর আবারও কড়াকড়ি শুরু হয়।

তবে ব্যবসায়ীরা মনে করেন, আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স প্রদান, নবায়ন ও ব্যবহার নীতিমালা ২০১৬ সালের পর তাঁরা সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতিতে পড়েছেন। নীতিমালায় ব্যক্তিপর্যায়ে আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স পাওয়ার অন্যতম শর্ত হলো, আবেদনকারীকে তিন করবছরে ধারাবাহিকভাবে পিস্তল, রিভলবার, রাইফেলের ক্ষেত্রে কমপক্ষে তিন লাখ টাকা ও শটগানের ক্ষেত্রে এক লাখ টাকা আয়কর দিতে হবে। বন্দুকের ব্যবহার কমে আসায় অনেকেই অযথা এই টাকাটা আর খরচ করতে চাননা। আর্মস ইম্পোর্টার্স অ্যান্ড ডিলার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক নাসিরউদ্দীন আহমেদ বলেন, ২০১৬ সালের পর ব্যবসা অর্ধেকে নেমেছে। সারা দেশের সব জেলায় এমনিতেও বন্দুকের দোকান নেই। দেশের ৮৪টি দোকানের ২২টিই ঢাকায়। সেগুলোও ধুঁকছে। দামও পড়ে গেছে অনেক। যে বন্দুক ৪০ হাজারে বিক্রি হতো, তা এখন ২০ হাজারে বিক্রি হচ্ছে।

প্রায় পঞ্চাশ বছরের পুরোনো দোকান ‘শিকার ও শিকারী’র এই মালিক বলেন, বৈধ অস্ত্র অবৈধকাজে ব্যবহার হচ্ছে এমন অভিযোগে তাঁদের সব সময় চাপে রাখা হয়। কিন্তু বন্দুক বা রিভলবারের যিনি মালিক তাঁর সবচেয়ে নিষ্কলুষ হওয়া কথা। অন্তত প্রক্রিয়া তাই বলে। মুক্তাগাছার জমিদার শ্রী ব্রজেন্দ্রনারায়ণ আচার্য্য চৌধুরী তাঁর শিকারিজীবনের অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখেছিলেন ‘শিকার ও শিকারী’। ১৯২৬ সালে কলকাতা থেকে প্রকাশিত এই বই থেকে এ অঞ্চলে ব্যবহৃত আগ্নেয়াস্ত্র সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। তিনি তাঁর লেখায় গাদা বন্দুক, স্মুদ বোর গান, রাইফেল, বিগ বোর রাইফেল ও হাই ভেলোসিটি রাইফেলের কথা বলেছেন।

ব্রজেন্দ্র নারায়ণ আচার্য্য চৌধুরী লিখছেন, ‘শিকারী মাত্রেরই বন্দুক সম্বন্ধে যথেষ্ট জ্ঞান থাকা উচিত। অনেকের ধারণা বন্দুক হইলেই বুঝি শিকার করা চলে। সচরাচর গ্রাম্য শিকারীরা একনলা গাদা বন্দুক দিয়াই শিকার করিয়া থাকে। তাহার দুটি কারণ— প্রথমত তাহারা বেশি মূল্যের বন্দুক ও তাহার টোটা (কারট্রিজ) অর্থাভাবে ক্রয় করিতে অসমর্থ। আর যদি বা কেহ সমর্থ হয় তাহাও আমাদের মতো হীন পরাধীন জাতির অদৃষ্টের ফেরে সরকার অনেক সময়ই পাশ (লাইসেন্স) মঞ্জুর করেন না, ইহাও অন্যতম কারণ। কাজেই তাহারা নিরুপায় হইয়া আত্মরক্ষা ও সখ নিবৃত্তি, গাদা বন্দুক দিয়াই শিকার করিয়া থাকে। এই সব বন্দুক সাধারণতঃ মুঙ্গেরের দেশি কারিগরের তৈরি। এইসব বন্দুক কখনও একনলা বা দোনলা।’

ব্রজেন্দ্র জানাচ্ছেন, এই শিকারীদের বারুদের পরিমাণ সম্পর্কেও বিশেষ কোনো জ্ঞান ছিল না। তাঁরা পাখি শিকারে চোঙের তিন ভাগে বারুদ ভরতেন, আর বাঘ, মহিষ, হরিণ শিকারে ব্যবহার করতেন পুরো চোং। বন্দুকের দোতলা ভরার বিবরণও পাওয়া যায় এ লেখায়। একবার বন্দুকে বারুদ ও গুলি ভরে, পরের স্তরে খড়কুটো বা কাগজ তারপর আবারও গুলি ও বারুদ ভরাকে তিনি বলেছেন দোতলা ভরা।

তাঁর মতে শিকারের জন্য উপযুক্ত বন্দুক দুই রকম। একটা হলো স্মুদ বোর গান। এই বন্দুক থেকে ছররা ও গুলি দুইই ছোড়া যায়। অন্যটি রাইফেল। এতে শুধু গুলিই ছোড়া যায়। ভেতরে প্যাঁচ কাটা থাকে বলে গুলির খুব জোর হয়। ব্রজেন্দ্র নারায়ণ আচার্য্য বলছেন, দড়িতে কোনো জিনিস বেঁধে ঘুরিয়ে ছেড়ে দিলে যেমন বেগে চলে যায়, বন্দুকের নলের ভেতর প্যাঁচ কাটা থাকায় গুলি নলের প্যাঁচের মধ্য দিয়ে খুব জোরে ঘুরে বের হয়ে যায়। তাই এর শক্তিও প্রচণ্ড। দুই ধরনের রাইফেলের কথা তিনি বলেছেন। এর একটি বিগ বোর রাইফেল, অন্যটি হাই ভেলোসিটি এক্সপ্রেস রাইফেল। বিগ বোরে নলের ছিদ্র বড়, গুলিও বড় ও ভারী হয়। সে কারণে গুলির গতি সোজা হয় না, বেঁকে পৌঁছায়। অন্যদিকে হাই ভেলোসিটি এক্সপ্রেস রাইফেলে নলের ছিদ্র ছোট, গুলিও ছোট। সজোরে সোজা ছোটে। ধোঁয়াও হয় না।


এই হাই ভেলোসিটি এক্সপ্রেস রাইফেল ছিল ব্রজেন্দ্র নারায়ণ আচার্য্য চৌধুরীর প্রিয়। তিনি লিখছেন, ‘যাঁহারা হাঁটিয়া শিকার করেন, এই বারুদ তাঁহাদের পক্ষে অত্যন্ত আবশ্যক ও সুবিধাজনক। হাঁটিয়া শিকারের অর্থই অনেক সময় স্বেচ্ছায় বিপদের সম্মুখীন হওয়া, কাজেই তাহাতে আমোদও বেশি। কোনও হিংস্র জন্তুর প্রতি আওয়াজ করিলে বন্দুকের সম্মুখে যে ধুম বাহির হয়, তাহা হাওয়া না থাকিলে অধিক হয় এবং ৮/১০ সেকেন্ড স্থায়ী হয়, তাহাতে সম্মুখের আর কিছু দেখা যায় না। বন গভীর হইলে ধুম আরও দীর্ঘকাল স্থায়ী হয়। আওয়াজ করিয়াই যদি আহত শিকারকে দেখিতে না পাওয়া যায়, তবে তাহার গতিবিধির প্রতি লক্ষ্য করা যায় না বলিয়া অনেক সময় শিকার (গেম) হারাইয়া যাইবার সম্ভাবনা অধিক হয়। পক্ষান্তরে আহত জানোয়ার হিংস্র হইলে আক্রান্ত হইবার আশঙ্কাও যথেষ্ট থাকে। ধূমশূন্য বারুদে সে সম্ভাবনা নাই। অতি অল্প কুয়াশার মত সাদা ধূম বাহির হয় মাত্র। কাজেই আওয়াজ করিয়াই নিজেও সতর্ক হওয়া যায়, জানোয়ারের গতিবিধিও লক্ষ্য করা যায়। হাই ভেলোসিটি রাইফেলের আরেক সুবিধা এই যে, এইগুলি সহজে বহন করা যায়। যাঁহারা বনে বনে হাঁটিয়া শিকার করেন তাঁহাদের পক্ষে ইহা বড় কম সুবিধার কথা নহে।’

আর্মস ডিলার্স অ্যান্ড ইম্পোর্টার্স অ্যাসোসিয়শেনের সাধারণ সম্পাদক নাসিরউদ্দীন আহমেদ বেণু প্রথম আলোকে বলছিলেন, ‘গুলি ছুড়লে ধোঁয়া বের হয় এমন আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার নেই বহুদিন। বিশ্ব সেরা শিকারি আমাদের পচাব্দী গাজীর প্রিয় ছিল বেলজিয়ান হ্যামারলেস বন্দুক। এই বন্দুক দিয়েই তিনি তাঁর জীবনের শেষ ও ৫৭তম বাঘটি মেরেছিলেন।’ কথায় কথায় জানালেন আশঙ্কাজনকভাবে বাঘ কমে যাওয়ায় ওই সময় বাঘ শিকার নিষিদ্ধ ছিল। একে একে ২৬ জন বাওয়ালিকে খেয়ে ফেলার পর বাঘ ধরতে পরোয়ানা জারি করেছিল সরকার। এই পুরো ঘটনাটির বিবরণ পাওয়া যায় ১৯৮৭ সালের রহস্য পত্রিকায়। বন্দুকটিও উপহার দিয়েছিলেন নাসিরউদ্দীন। এখন তাহলে কী ধরনের বন্দুক, রাইফেল , রিভলবার ও পিস্তল জনপ্রিয়?

আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবসায়ীরা বলছেন, ব্রিটিশ উপনিবেশ হওয়ায় একসময় দেশে ‘ইংলিশ গানের’ আধিপত্য ছিল। পার্ডি, হল্যান্ড অ্যান্ড হল্যান্ডসহ বেশ কিছু বন্দুক প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের পণ্য ঢাকার বাজারে পাওয়া যেত। পরে জার্মানি, বেলজিয়াম, স্পেন থেকে বন্দুক আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি ও ব্রাজিল থেকে রিভলবার আসতে শুরু করে। গুলি আসে জার্মানি, তুরস্ক, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে। তবে ব্যবসায়ীদের দাবি বন্দুক-পিস্তলের যত ধরনই আসুক দেশে, নানা কারণে বিক্রি নেই। শিকার নিষিদ্ধ, তার ওপর নিবর্তনমূলক নানা আইনকানুনে বিক্রি কমেছে অনেক।

বিভিন্ন সময় বৈধ অস্ত্র অবৈধ ব্যবহারের অভিযোগ উঠেছে। সাত খুনের ঘটনায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি নূর হোসেন ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা ছটি বৈধ অস্ত্রের মালিক ছিলেন, যেমন ছিলেন জি কে শামীমের দেহরক্ষীরা। বছর দুয়েক আগে ময়মনসিংহ থেকে একজন অস্ত্র ব্যবসায়ী গ্রেপ্তার হয়েছিলেন অস্ত্র অপব্যবহারের অভিযোগে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, যাচাই-বাছাইয়ের কাজটা তাঁরা করেননা। সেখানে ত্রুটি থেকে যাচ্ছে বলেই এমন ঘটছে।

যাচাই-বাছাই কী করে হয় জানতে কথা হয় ঢাকা জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট (আগ্নেয়াস্ত্র) শাহনাজ পারভীনের সঙ্গে। তিনি রংপুর ডেইলীকে বলেন, কে আগ্নেয়াস্ত্র পাবেন, আর কে পাবেন না, তা পুরোপুরি জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের বিবেচনার ওপর নির্ভর করে। আবেদনপত্র জমা পড়লে পুলিশের ওপর ওই ব্যক্তি সম্পর্কে খোঁজখবর করার দায়িত্ব পড়ে। তাঁর আয়করের তথ্যও যাচাই করা হয়। সব ঠিক থাকলে আগ্রহী ব্যক্তিকে ডাকা হয় সাক্ষাৎকারে। সেখানে উৎরাতে পারলে লাইসেন্স পাওয়া যাবে। আবার রিভলবারের অনুমতি জেলা ম্যাজিস্ট্রেট দেন না। এর অনুমতি দেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিজে। তাঁরা সব তথ্যসহ মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে দেন।

শামসুদ্দীন আহমেদ অ্যান্ড সন্সের স্বত্বাধিকারী আবরার আহমেদ বলছিলেন, এই ব্যবসায় এতটুকু অসততার সুযোগ নেই। মুক্তিযুদ্ধের সময়কার একটা ঘটনা বলছিলেন তিনি। জুন-জুলাইয়ের দিকে তিনি ও তাঁর বড় ভাই বাবা ফাখরুদ্দীন আহমেদের সঙ্গে দোকানে বসা। একজন পাকিস্তানি মিলিশিয়া টেবিলের ওপর একটা পিস্তল ফেলে দিয়ে মেমো চান। আদালতকে দেখাবেন, পিস্তলটি তিনি শামসুদ্দীন আহমেদ অ্যান্ড সন্স থেকে কিনেছেন।

ফাখরুদ্দীন আহমেদ রাজি হননি। একপর্যায়ে ছেলেদের সামনেই বুকে বন্দুক ধরেন পাকিস্তানি মিলিশিয়া। ফাখরুদ্দীন বললেন, ‘লুট করে আনা অস্ত্রের মেমো আমি দেব না। প্রতিদিনই তো মানুষ মারছ। মেরে ফেলতে পার, কিন্তু যা চাইছ তা পাবে না।’ আবারও আসবেন এই হুমকি দিয়ে চলে যান সেই মিলিশিয়া । তবে আর ফেরেননি। তাঁরা এখনো বাবার সেই আদর্শ মেনে চলছেন।

ব্যবসায়ীরা এখন চান নজরদারি যাচাই-বাছাই কঠোরভাবে হোক। সেই সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, দক্ষিণ আফ্রিকাসহ বহু দেশের মতো বাংলাদেশেও শিকারের অনুমতি দেওয়া হোক। যে প্রাণী বিলুপ্তপ্রায় সে প্রাণীগুলো এর আওতামুক্ত থাকুক। এমন সুযোগ দেওয়া হোক যেন আগ্রহীরা টাকার বিনিময়ে শিকারের অনুমতি পান। টাকাটা প্রাণীর বিস্তারে খরচ হোক। তবুও টিকে থাকুক তাঁদের ব্যবসা।

Leave a Comment