তেলের জন্য ‘ঘাম’ ঝরছে বাইডেনের

ইউক্রেনে রুশ হামলার জবাবে রাশিয়ার ওপর একের পর এক অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা দিয়ে চলেছে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো। জবাবে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনও নানা রকমের হুমকি দিয়ে আসছেন। রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞার কারণে জ্বালানিসংকটের মুখে পড়েছে যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপের কয়েকটি দেশ। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে, জ্বালানি তেলের বাজারমূল্য ব্যারেলপ্রতি ১০০ মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। পরিস্থিতি সামলাতে দীর্ঘদিনের বন্ধুরাষ্ট্র সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের দ্বারস্থ হয়েছে ওয়াশিংটন। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে তেল সরবরাহের বিষয়ে এখনো সাড়া দেয়নি কেউই। বাইডেন প্রশাসনের সঙ্গে বিরোধের অর্থ, রিয়াদ ও আবুধাবি জ্বালানি তেল নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কঠিন দর-কষাকষি চালাতে পারে।

রাশিয়া-ইউক্রেন ইস্যুতে কঠোর অবস্থানের কারণে প্রশংসিত হয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। কিন্তু রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞার কারণে যুক্তরাষ্ট্র কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে গুরুতর জ্বালানি তেলের সংকটের মুখে পড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে কাছের মিত্রদের মধ্যে সৌদি আরব ও আরব আমিরাত (ইউএই) অন্যতম। এ দুটি দেশের সহায়তায় আপাতত পরিস্থিতি সামলানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট।

কিন্তু সৌদি আরব ও ইউএইর কাছ থেকে সহায়তার আভাস এখনো পায়নি হোয়াইট হাউস। সৌদি আরবের ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের মোহাম্মদ বিন জায়েদ পশ্চিমা বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাশীল নেতা বাইডেনের সঙ্গে এখনো ফোনালাপ করতে সম্মত হননি। এ এমন এক পরিস্থিতি, যা আমেরিকার পূর্ববর্তী প্রশাসনের সময় কল্পনাতীত ছিল।

বাইডেনের এই মুহূর্তের অগ্রাধিকার হলো উভয় দেশের কাছ থেকে জ্বালানি তেলের ব্যাপক সরবরাহ নিশ্চিত করা, যাতে রাশিয়ার ওপর সর্বোচ্চ অর্থনৈতিক চাপ তৈরি করা যায়। সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত যুক্তরাষ্ট্রে তেলের প্রধান সরবরাহকারী দেশ। আগামী নভেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রে মধ্যবর্তী নির্বাচনের আগে জ্বালানির তেলের দামও বেশ প্রভাব ফেলবে, যা কংগ্রেসে ডেমোক্র্যাটদের নিয়ন্ত্রণ হুমকিতে ফেলতে পারে।

মধ্যপ্রাচ্যের জ্বালানি তেলসমৃদ্ধ দেশগুলোর সঙ্গে ওয়াশিংটনের সম্পর্ক বর্তমানে নেতিবাচক অবস্থানে রয়েছে। যদিও রিয়াদ ও আবুধাবির পক্ষে এমন শর্তে আঞ্চলিক শৃঙ্খলাকে পুনরুদ্ধার করার একটি হিসাব রয়েছে। আরব বিশ্বের এই দুই নেতাই একটি বিষয় মোটামুটি স্পষ্ট করেছেন যে তাঁরা কম মূল্যে মীমাংসা করবেন না এবং তাঁরা জ্বালানি তেলের মূল্য বাড়াতে প্রস্তুত।

ওয়াশিংটনে নিযুক্ত সংযুক্ত আরব আমিরাতের রাষ্ট্রদূত ইউসেফ আল-ওতাইবা গত বুধবার বলেছেন, তাঁরা জ্বালানি তেলের উৎপাদন বাড়ানোর পক্ষে। ওপেককে তেল উৎপাদন বাড়ানোর ক্ষেত্রেও তাঁরা উৎসাহিত করবেন। ফলে তেলের বাজারমূল্য ১৩ শতাংশ কমে যেতে পারে। উৎপাদন বাড়ানোর কথা বললেও সরবরাহ বাড়ানোর জন্য কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। ফলে সপ্তাহের শেষ নাগাদ প্রতি ব্যারেল তেলের দাম প্রায় ১৩০ মার্কিন ডলার পর্যন্ত ওঠে, যা মধ্যবর্তী নির্বাচনে বাইডেন প্রশাসনকে বেশ অস্বস্তিকর পরিস্থিতে ফেলতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।

রাশিয়া থেকে তেল-গ্যাস আমদানিতে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার প্রভাবে হঠাৎ করে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম একলাফে অনেকটা বেড়ে গিয়েছিল। পরে আবার তা কমে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, রাশিয়ার তেলের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নির্ভরশীলতা সামান্যই। তাই তেলের বাজারে দীর্ঘ মেয়াদে নিষেধাজ্ঞার প্রভাব না-ও পড়তে পারে।

তবে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এই দুই দেশের সম্পর্কের স্থবিরতা শুধু তেলের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, এর সঙ্গে আরও অনেক কিছুই জড়িত। ক্ষমতায় আসার পর এখন পর্যন্ত রিয়াদে সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের সঙ্গে কথা বলেননি বাইডেন, যাতে বেশ ক্ষুব্ধ হয়েছে রিয়াদ। মূলত সাংবাদিক জামাল খাসোগি হত্যাকাণ্ড, ইয়েমেন যুদ্ধ, অধিকারকর্মীদের কারাগারে পাঠানো, কাতারের ওপর সৌদি আরবের নিষেধাজ্ঞার মতো ইস্যুগুলো যুক্তরাষ্ট্র-সৌদি আরব সম্পর্কে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

এর মধ্যে আবার আবুধাবির সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধ প্রায় তীব্র আকার ধারণ করেছে। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ইয়েমেন ইস্যুতে ভোটদানে সংযুক্ত আরব আমিরাতের বারবার বিরত থাকা যুক্তরাষ্ট্র ভালোভাবে নেয়নি। পশ্চিমা কূটনীতিকেরা এটিকে রাশিয়ার সমর্থনের সমার্থক হিসেবে দেখছেন।

ইরান-সমর্থিত হুতি বিদ্রোহীদের বৈশ্বিক সন্ত্রাসী তালিকা থেকে বাদ দিয়েছে বাইডেন প্রশাসন। এতে ক্ষুব্ধ হয়েছে সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত। কারণ, ইরানের সঙ্গে পারমাণবিক চুক্তি পুনরায় চালু করার বিষয়ে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছিল তারা।

রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের কারণে সৃষ্ট সংকট মোকাবিলায় গত সপ্তাহে ভেনেজুয়েলার দ্বারস্থ হয়েছিল হোয়াইট হাউস। এর মধ্যে অবশ্য সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের সঙ্গে সম্পর্ক মেরামতের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র।

এর অংশ হিসেবে গত মাসে বাইডেন প্রশাসনের হোয়াইট হাউসের মধ্যপ্রাচ্য নীতিবিষয়ক সমন্বয়কারী ব্রেট ম্যাকগার্ক ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিশেষ দূত আমোস হোচস্টেইনকে সৌদি যুবরাজের (ক্রাউন প্রিন্স) সঙ্গে বৈঠকের জন্য রিয়াদে পাঠিয়েছিল।

গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে অভিযান শুরু করে রাশিয়া। যুদ্ধ বন্ধে রাশিয়া ও ইউক্রেনের কর্মকর্তারা কয়েক দফায় বৈঠকে বসেন। তবে প্রতিবারই কোনো রকম সমঝোতা ছাড়াই বৈঠক শেষ হয়েছে। যুদ্ধ বন্ধে কূটনৈতিক তৎপরতা এখনো চলছে। ভারত, চীন, ইসরায়েল ও আরব বিশ্বের কয়েকজন নেতা পুতিন ও জেলেনস্কির সঙ্গে মধ্যস্থতার বিষয়ে নিজেদের আগ্রহের কথা জানিয়েছেন।

আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম) গত শুক্রবার জানিয়েছে, ইউক্রেনে রুশ হামলা শুরুর পর এ পর্যন্ত ২৫ লাখের বেশি মানুষ ইউক্রেন ছেড়েছে।
ইউক্রেনে রুশ বাহিনীর হামলার পরিস্থিতি তুলে ধরে আরেকটি তথ্য জানিয়েছে জাতিসংঘের কো-অর্ডিনেশন ফর হিউম্যানিটেরিয়ান অ্যাফেয়ার্স। সংস্থাটির তথ্যমতে, রুশ বাহিনীর হামলায় ইউক্রেনের ভেতরে কমপক্ষে ১৮ লাখ ৫০ হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে।

ইউক্রেনে হামলা শুরুর পর থেকে দলে দলে মানুষ ইউক্রেন ছেড়ে পালাচ্ছে। জাতিসংঘের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর অল্প সময়ের ব্যবধানে এত শরণার্থীর ঢল এর আগে দেখেনি ইউরোপ।

Leave a Comment