টাইটান সাবমারসিবল বিস্ফোরণ

২০২৩ সালের ১৮ জুন ওশনগেট নামক একটি পর্যটন ও এক্সপেডিশন কোম্পানি দ্বারা পরিচালিত একটি মনুষ্যবাহী সাবমারসিবল কানাডার নিউফাউন্ডল্যান্ডের উপকূলে উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরে বিখ্যাত টাইটানিক জাহাজের ধ্বংসাবশেষ দেখতে যায়। কিন্তু সেই অভিযানে যেয়ে সে নিজেই বিস্ফোরিত হয়। সাবমারসিবলে যে পাঁচ জন ছিলেন তারা সবাই নিহত হয়েছেন।

টাইটান নামের ডুবোজাহাজটিতে ছিলেন ওশানগেটের সিইও স্টকটন রাশ; ফরাসি গভীর সমুদ্র অভিযাত্রী এবং টাইটানিক বিশেষজ্ঞ পলহেনরি নারজিওলেট; ব্রিটিশ ধনকুবের ব্যবসায়ী হামিশ হার্ডিং; পাকিস্তানিব্রিটিশ বিলিয়নিয়ার ব্যবসায়ী শাহজাদা দাউদ এবং তার ছেলে সুলেমান।

সাবমারসিবলটি টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ দেখতে ৩৮০০ মিটার বা ১২৪৬৭ ফুট গভীরতায় নামছিল। কিন্তু এক পর্যায়ে এটি পৃষ্ঠের সাথে যোগাযোগ হারিয়ে ফেলে। একটি অনুসন্ধান মিশন পরিচালনা করা হয়। কিন্তু পরের দিন সাবমারসিবলটি খুঁজে পাওয়া যায়নি। সাবমারসিবলটির ধ্বংসাবশেষের কিছু অংশ খুঁজে পাওয়া যায় যা থেকে বোঝা যায় যে এটি মারাত্মক একটি ইমপ্লোশনের ভেতর দিয়ে গিয়েছে অর্থাৎ সাবমারসিবলটি তার ভেতরের দিকে বিস্ফোরিত হয়েছে।

ইমপ্লোশন কেন হল তা নিয়ে এখনো অনুসন্ধান চলছে। তবে এই দুর্ঘটনার পেছনে কি কি সম্ভাব্য ফ্যাক্টর থাকতে পারে তা নিয়ে আলোচনা করা যাক।

প্রথমত, ডিজাইনে ত্রুটি। টাইটান সাবমারসবিলটি ছিল মূলত প্রায় নতুন এক ধরনের ডিজাইন। এর গাঠনিক সামর্থ্য নিয়ে আগে থেকেই প্রশ্ন চলে আসছিল। ২০২২ সালে টাইটানিক ডাইভে যাওয়ার সময় এটির ব্যাটারি ফেইলার হয়। ফলে এটাকে একটা লিফটিং প্ল্যাটফর্মে লাগিয়ে তোলা হয়েছিল সেবার। এতে এর বাইরের বিভিন্ন যন্ত্রাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

দ্বিতীয়ত, অপারেশনাল ত্রুটি। সম্ভবত টাইটানের ক্রুরা কোনো ভুল করেছিল যার কারণে ইমপ্লোশন অর্থাৎ ভেতরের দিকে বিস্ফোরণ ঘটে। হতে পারে সাবমারসিবলটি যে গভীরতায় নিরাপদে নামতে পারে তারা তার চেয়েও বেশি গভীরে নেমে গিয়েছিলেন।

যান্ত্রিক কারণেও হয়তো বিস্ফোরণটি ঘটে থাকতে পারে। হয়তো সাবমেরিনের কোনো জায়গা ফেটে গিয়েছিল পানির প্রচণ্ড চাপে।

টাইটান সাবমারসিবলের এই ঘটনাটি ছিল মারাত্মক এক ট্র্যাজেডি। ডুবোজাহাজে করে পানির নিচে অভিযানে যাওয়ার ভবিষ্যতকে এটি এক প্রকার প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। তারপর মনুষ্যচালিত ডুবোজাহাজের নিরাপত্তার ব্যাপারেও গুরুতর প্রশ্ন উত্থাপন করে। এই দুর্ঘটনাটি নিয়ে তদন্ত চলছে। আশা করা যায়, এখান থেকে যে ফলাফল পাওয়া যাবে তা ভবিষ্যতে সাবমারসিবল দুর্ঘটনা রোধে কাজে লাগানো যাবে।

ওশানগেটের পরিচয়

২০১১ সালে প্রাক্তন নেভি সিল এবং কমার্শিয়াল পাইলট স্টকটন রাশ ওশনগেট প্রতিষ্ঠা করেন। কোম্পানির লক্ষ্য হল সমুদ্রকে সকলের কাছে অ্যাক্সেসযোগ্য করে তোলা।ওশানগেট কোম্পানি টাইটানিক এর দুর্ঘটনাস্থল, মারিয়ানা ট্রেঞ্চ এবং গ্রেট ব্যারিয়ার রিফসহ বিভিন্ন জায়গায় ডুবো অভিযানের সুযোগ করে দেয়।

টাইটান ছিল ওশানগেটের ফ্ল্যাগশিপ সাবমার্সিবল। এটি গভীর সমুদ্রের চরম চাপ সহ্য করার উপযোগী করে ডিজাইন করা হয়েছিল। সাবমার্সিবলটিতে বেশ কিছু সেফটি ফিচার ছিল। যেমন, একটি রিডানডান্ট হাল, ব্যাকআপ অক্সিজেন সরবরাহ ইত্যাদি।

দুর্ঘটনার প্রভাব

টাইটান বিস্ফোরণ সাবমার্সিবল পর্যটন শিল্পে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলেছে। বিস্ফোরণের কারণ নির্ণয় না হওয়া পর্যন্ত অনেক কোম্পানি তাদের কার্যক্রম স্থগিত করেছে। এর ফলে সাবমার্সিবল ট্যুরিজম ট্রিপের সংখ্যা কমে গেছে।

এছাড়াও, টাইটান বিস্ফোরণ সাবমার্সিবল ট্যুরিজমের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ তৈরি করেছে। কিছু লোক মনে করে, সাবমারসিবল পর্যটন যে অত্যন্ত বিপজ্জনক টাইটান দুর্ঘটনা তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। অন্যদিকে অন্যরা মনে করে, টাইটান দুর্ঘটনা কেবলই একটি দুর্ঘটনা। এটিকে এখনো অনিরাপদ বলা যাবে না।

সাবমার্সিবল পর্যটন শিল্পে টাইটান বিস্ফোরণের দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব কেমন হবে তা এখনও বোঝা যাচ্ছে না। যাইহোক, এটা স্পষ্ট যে শিল্পটি পুনরায় কাজ শুরু করার আগে নিরাপত্তার উন্নতির জন্য পদক্ষেপ নিতে হবে।

সাবমারসিবলে নিরাপত্তা বৃদ্ধির উপায়

সাবমার্সিবল ট্যুরিজমের নিরাপত্তার উন্নতির জন্য বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। এর মধ্যে রয়েছে:

  • সাবমারসিবলে আরও কঠোর নিরাপত্তা পরীক্ষা পরিচালনা করা।

  • সাবমার্সিবল অপারেশনের জন্য কঠোর নিরাপত্তা প্রোটোকল বাস্তবায়ন করা।

  • সাবমার্সিবল অপারেটর এবং যাত্রীদের আরও প্রশিক্ষণ প্রদান করা।

এই পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করে ডুবোজাহাজ পর্যটন শিল্প ভবিষ্যতের অভিযানগুলো নিরাপদ এবং সফল হয় তা নিশ্চিত করতে সহায়তা করবে।

শেষ কথা

টাইটান বিস্ফোরণ একটি মর্মান্তিক ঘটনা। যা পাঁচ জনের জীবন কেড়ে নিয়েছে। তবুও মনে রাখতে হবে যে ডুবোজাহাজ পর্যটনকে এখনো নিরাপদ বলা যায়। অধিকাংশ ডুবোজাহাজ অভিযানেই তেমন কোনো দুর্ঘটনা ঘটে না।

তবে এই শিল্প পুনরায় পুরোদমে শুরু হওয়ার আগে এর নিরাপত্তা উন্নীত করতে হবে। যথাযথ নিরাপত্তা প্রোটোকল গ্রহণ করলে ডুবোজাহাজে করে পর্যটন নিরাপদ ও ফলপ্রসূ অভিজ্ঞতা বয়ে আনবে।

Leave a Comment