জ্বর, সর্দি, কাশি ও গলা ব্যথার ওষুধ সংকটের যত কারণ

ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগর উপজেলায় দিন দিন করোনা উপসর্গ নিয়ে রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। ঠান্ডা, জ্বর, সর্দি মাথা ও গলা ব্যথার ওষুধের সংকটও দেখা দিয়েছে এ উপজেলার সর্বত্র। ওষুধের সংকটের সংকটের পেছনে একাধিক কারণ রয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।  

সরেজমিনে দেখা গেছে, উপজেলার কাইতলা, শিবপুর, বিদ্যাকুট ,মিরপুর, ওয়ারক, জুলাইপাড়া, সলিমগঞ্জ,  বাঙ্গরা, জিনোদপুর, আহমদপুর, বাড়িখলা, নবীনগর পশ্চিম ইউনিয়ন চরলাপাং, নবীপুর, আলমনগর, রসুল্লাবাদ, ভোলাচং, ভেলানগর, বীরগাঁও, বাইশমোজা, গাছতলা, বরিকান্দি, শ্যামগ্রামের ফার্মেসিতে জ্বর, সর্দি, কাশি গলা ও মাথা ব্যথার ওষুধের সংকট দেখা দিয়েছে।

ক্রেতারা জানান, ফেক্সোফেনাডিন, এজিথ্রোমাইসিন, মন্টিলুকাস্ট ১০, প্যারাসিটামল ৫০০, নাপা, নাপা এক্সট্রা,  নাপা এক্সটেন্ড, এক্সপা, এক্সপা এক্সআর, মোনাস টেন, ফেনাডিন ১২০, নাপা সিরাপ, জিংক বি ওষুধের সংকট রয়েছে এসব বাজারে।

ক্রেতা দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘আমি দশ-বারোটা ফার্মেসি ঘুরেছি, প্যারাসিটামল জাতীয় কোনো ওষুধ খুঁজে পাচ্ছি না। আমার ঘরে বাচ্চাসহ প্রায় সবাই জ্বর-সর্দি-ঠান্ডায় ভুগছি। এখন সাধারণ কয়েকটা ওষুধ খুঁজেও পাই না’। 

কবির আহমেদ ও সাব্বির জানান, ‘ঘরের সবাই ঠান্ডা-জ্বরে অসুস্থ। গ্রামের বাজারে ওষুধ না পেয়ে নবীনগর আসছি কিনতে। লকডাউনে অনেক কষ্ট হয়েছে। নবীনগরেও ওষুধ পাই না। একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আমাদের কেউ বাঁচাতে পারবে না’।

কথা হয় রোগীর আত্মীয় মিলাদ হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমার চাচা করোনায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি। প্রেসক্রিপশন অনুসারে কিছু ওষুধ পাচ্ছি না’। 

কথা হয় করোনা উপসর্গ নিয়ে ওষুধ কিনতে আসা মোহাম্মদ হাফিজ মিয়ার সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমি নিজেই করোনার উপসর্গ নিয়ে ওষুধ খুঁজে পাই না। দামি দামি ওষুধ পাওয়া যায়, সাধারণ জ্বর, কাশি, গলা ব্যথার ওষুধ খুঁজে পাই না। প্যারাসিটামল জাতীয় কয়েকটা ওষুধ কিনেছি ২০ টাকার পাতা ওষুধ ৫০ টাকায় পাইছি। এতেও আলহামদুলিল্লাহ’।

ডাক্তার শান্তি ক্লিনিক অ্যান্ড ফার্মেসির মালিক নবীনগর বাজার ওষুধ ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি সুবীর রঞ্জন সাহা বলেন, ‘প্যারাসিটামল ওষুধ যে জিনিস দিয়ে তৈরি হয় র ম্যাটেরিয়ালস, এটাই আন্তর্জাতিক মার্কেট থেকে আসতেছে না। যে কারণে কোম্পানিগুলো উৎপাদন করতে পারছে না। এ কারণে বাজার সংকট। গত দেড় মাস যাবৎ সাপ্লাই দিচ্ছে না। এখন যারা অতিরিক্ত দাম দিয়ে কিনে আনছেন, যেমন পাঁচ শ টাকার বক্স এখন এক হাজার টাকায়ও পাওয়া যাচ্ছে না। যারা কিছু কিছু দূরদূরান্ত থেকে সংগ্রহ করছে, তারা টুকটাক বিক্রি করতে পারছে। এইটা ন্যাশনাল সমস্যা, বিশেষ করে প্রথম সারির বড় কোম্পানিগুলোর একই সমস্যা। দেশে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে এই ওষুধগুলো চাহিদাও বেড়ে যাচ্ছে’।

নবীনগর বাজারের মা ফার্মেসির মালিক সুমন দত্ত জানান, ‘নবীনগরে অবস্থা ভালো না। হঠাৎ করে করোনার কারণে রোগীর চাপ বেড়ে গেছে। আমরা ওষুধ পাচ্ছি না। অর্ডার করেও সাড়া পাচ্ছি না’।

ওষুধ বিক্রেতা এক প্রতিনিধি বলেন, ‘চাহিদার তুলনায় প্রোডাকশন করে কুলাতে পারছি না। আমি গত সপ্তাহে দশটি দোকানের নামে অর্ডার করেছি প্রায় এক লাখ টাকার ওষুধ, কিন্তু আমাকে বার শ টাকার ওষুধ দেওয়া হয়েছে কোম্পানি থেকে’।

ভৌমিক ফার্মেসির মালিক প্রবীর ভৌমিক বলেন, ‘কিছু কিছু ওষুধ মার্কেটে সংকট, বিশেষ করে প্যারাসিটামল গ্রুপ ফেক্সোফেনাডিন, এজিথ্রোমাইসিন, মন্টিলুকাস্ট টেন, প্যারাসিটামল ৫০০- এগুলোর খুবই সংকট। তাই আমরা চাহিদার কারণে কুমিল্লা, ঢাকা, চট্টগ্রাম থেকে বেশি দামে কিছু ওষুধ কিনে বিক্রির চেষ্টা করছি’।

বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির এরিয়া ম্যানেজার মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘এ সময়ে প্যারাসিটামল গ্রুপটার একটু সংকট। কারণ হিসেবে আমাদের ম্যানেজমেন্ট বলছে, আমাদের প্রোডাকশনের যে ক্যাপাসিটি তার তুলনায় মার্কেটের ডিমান্ড বেশি। চাহিদা অনুসারে প্রোডাক্ট দিতে পারতেছি না। আমরা জুলাই মাসের প্রথম থেকে মাল সংকটে ভুগছি, কবে নাগাদ উৎপাদন বাড়াবে আমরা সেটা দিন-তারিখ বলতে পারছি না। তবে কিছুদিনের মধ্যেই আশা করি সংকট কাটিয়ে উঠতে পারব’।

ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির এরিয়া ম্যানেজার তোফায়েল চৌধুরী বলেন, ‘সবার একই অবস্থা ভাইয়া। মূল কথা হলো, আমাদের ইয়ারলি একটা বাজেট থাকে। যেমন আমাদের বছরে এক কোটি বক্স দরকার। এখনকার যে পরিস্থিতি, দেখা গেছে সবারই প্যারাসিটামল প্রয়োজন পড়তেছে। কারণ করোনার কারণে প্রায় মানুষের শরীরে জ্বর, সর্দি, কাশি ,গলা ব্যথা এসব কারণে প্যারাসিটামল স্টেটমেন্ট দেওয়া লাগতেছে, যে কারণে প্রতি ঘরে ঘরে প্রয়োজন পড়ছে। এ কারণে দেখা যাচ্ছে সংকট। কোম্পানিগুলো উৎপাদনের সঙ্গে চাহিদা মেলাতে পারছে না। আবার কারো কারো দেখা যায় কাঁচামাল লকডাউনে আটকে আছে, এটাও একটা সংকট আমাদের কোম্পানির। আশা করছি সপ্তাহ বা ১০ দিনের মধ্যে আমাদের তিনটি প্যারাসিটামল গ্রুপের মধ্যে একটি গ্রুপ পাব। তবে নবীনগর মার্কেটে চাহিদা আছে আমার কাছে প্রায় দুই হাজার প্যাকেট কিন্তু দিতে পারব দুই থেকে আড়াই শ প্যাকেট’।

ল্যাবএইড ফার্মাসিউটিক্যাল এর বিক্রয় প্রতিনিধি রিয়াজুল হাসান সুমন বলেন, ‘কোন কোম্পানিতে এ ওষুধগুলো দিতে পারছে না করোনার কারণে চাহিদার তুলনায় দোকানদারকে মাল দিতে পারছি না’।

তিনি আরো বলেন, ‘করোনা সংকটের কারণে ধরেন আমাদের কোম্পানিতে ১০ হাজার বক্স আছে। বড় মাপের ব্যবসায়ীরা এ সংকটের সময় ১০ জন মিলে ১০ হাজার প্যাকেট নিয়ে নেয়। তারা এখন ২৫ টাকার পাতা ৫০ টাকায় বিক্রি করছে কুমিল্লা, চট্টগ্রাম ও ঢাকায়। লকডাউনে কাঁচামালের সংকট থাকায় কোম্পানি চাহিদা মোতাবেক সাপ্লাই দিতে পারছে না’।

স্কয়ার কোম্পানি লিমিটেডের বিক্রয় প্রতিনিধি মো. হুমায়ুন কবির বলেন, ‘এভেলেবেল ওষুধ কোম্পানি থেকে পাচ্ছি না। শর্ট সাপ্লাই মাঝে মাঝে আসে আবার মাঝে মাঝে আসে না। সারা দেশেই এ সংকট। আমার মার্কেটের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, গ্রামে-গঞ্জে হঠাৎ করে জ্বর , কাশি, গলা ব্যথা দেখা দেওয়ায় অনেকে ফার্মেসি থেকে পাঁচ পাতা, ১০ পাতা কেউ এক বক্স টাকা দিয়ে কিনে নিচ্ছেন। তাই আমি প্রত্যেক কেমিস্ট্রির কাছে অনুরোধ করেছি, আপনারা কাউকে প্রয়োজনের তুলনায় এ ওষুধগুলো বেশি দেবেন না। আশা করছি অল্প কিছুদিনের মধ্যেই মার্কেটে এভেলেবেল হয়ে যাবে’।

উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা হাবিবুর রহমান বলেন, ‘আমি মার্কেটে খোঁজখবর নিয়েছি। কিছু কিছু কোম্পানির প্যারাসিটামল গ্রুপ সংকট আছে বাজারে, এটা আন্তর্জাতিক সমস্যা। এ উপজেলায় দিন দিন করোনার উপসর্গ রোগীর সংখ্যা বেড়ে চলছে, যে কারণে এ জাতীয় ওষুধগুলো ঘরে ঘরে প্রয়োজন হচ্ছে। আমি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলেছি, আশা করছি অচিরেই এর সমাধান হবে’।

Leave a Comment