খাদ্যে ব্যবহৃত টেস্টিং সল্টের মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকি

বর্তমানে বিভিন্ন খাবারে টেস্টিং সল্ট ব্যবহার করা হচ্ছে। নুডুলস থেকে শুরু করে ফাস্ট ফুড ও চাইনিজে অহরহ ব্যবহৃত হচ্ছে টেস্টিং সল্ট। টেস্টিং সল্ট মনোসোডিয়াম গ্লুটামেট নামে পরিচিত। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা টেস্টিং সল্ট ব্যবহারের মারাত্মক পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক করেছেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে সাধারণত টেস্টিং সল্টের সাথে খাওয়া খাবার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে যেমন বুক জ্বালাপোড়া, বুকে এবং পেটে ব্যথা এবং বমি হওয়া। পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদী উপসর্গও দেখা যেতে পারে যেমন উচ্চ রক্তচাপ, বন্ধ্যাত্ব, মাইগ্রেন ইত্যাদি। এ ছাড়া এই টেস্টিং সল্ট নিউরোট্রান্সমিটারের ভারসাম্যহীনতা, মাথাব্যথা, খিঁচুনি, ক্লান্তি, স্থূলতা, উচ্চ রক্তচাপ এবং অনিদ্রার কারণ।

যারা টেস্টিং সল্ট বা মনোসোডিয়াম গ্লুটামেট খাচ্ছেন তারা শেষ পর্যন্ত স্বাদের অনুভূতি হারিয়ে ফেলতে পারেন। তাদের মনোযোগ কমে যেতে পারে। “চাইনিজ” ছাড়া অন্যান্য খাবার তাদের কাছে কম সুস্বাদু মনে হতে পারে। তারা বিভিন্ন বিষয়ে মনোনিবেশ করতেও অক্ষম হয়ে পড়তে পারেন।

এই ধরনের ব্যক্তিরা খুব দ্রুত বিরক্ত হয়ে যেতে পারেন। তাদের ভালো ঘুম হবে না। কারণ টেস্টিং সল্ট মানবদেহের কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রকে প্রভাবিত করে।

অধ্যাপক ফারুক বলেন, টেস্টিং সল্ট মিশিয়ে নিয়মিত খাবার খেলে বমি, মাথাব্যথা, খিঁচুনি, ক্লান্তি, বুকে চাপ এবং গলায়, হাতের তালুতে বা পায়ের তলায় জ্বালাপোড়া হয়।

রেস্তোরাঁ গুলোতে টেস্টিং সল্ট ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। বিশেষ করে ফাস্ট ফুড রেস্তোরাঁয়। যেখানে টেস্টিং সল্ট প্রচুর পরিমাণে খাবারের সাথে মেশানো হয়। সূত্র থেকে জানা গেছে যে, টিনজাত মাংসেও এই লবণ খাদ্য সংরক্ষণে ব্যবহার করা হয়। যেসব খাবারে এই লবণ ব্যবহার করা হয় খাবারের স্বাদ বৃদ্ধির করার জন্য, এটি সেই নির্দিষ্ট খাবারের প্রতি আসক্তি তৈরী করে। এই রাসায়নিক দ্রব্যটি অধিক পরিমাণে ব্যবহার করার ক্ষতিকর প্রভাব ব্যাপক। একজন চিকিত্সক বলেছেন, “যদি কেউ দীর্ঘ দিন ধরে অপ্রয়োজনীয়ভাবে অতিরিক্ত পরিমাণ লবণযুক্ত বা মিশ্রিত খাবার খায় তবে সে সেই নির্দিষ্ট খাবারে আসক্ত হয়ে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।”

তিনি বলেন, প্রাকৃতিক ফ্লেভারের অনুকরণে অনেকগুলো কৃত্রিম ফ্লেভার তৈরী করেছে ফুড ইন্ডাস্ট্রি। এটা করা হয়েছে ন্যাচারাল প্যাকেজকৃত খাবারের স্বাদ বৃদ্ধি করার জন্য। এই স্বাদ বর্ধকদের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য হল খাবার তৈরির সময় খাবারের সাথে এগুলো যোগ করা হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাসিউটিক্যাল টেকনোলজি বিভাগের অধ্যাপক এ বি এম ফারুক বলেছেন, “যেসব খাবারে অতিরিক্ত মাত্রায় টেস্টিং সল্ট থাকে যেমন ফ্রায়েড চিকেন, প্রি প্যাকেজড নুডুলস, পটেটো চিপস, বার্গার, স্যুপ এবং ফাস্ট ফুড আইটেম ইত্যাদি খেলে ধীরে ধীরে কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র দুর্বল হয়ে যেতে পারে। ভবিষ্যতে এটি পারকিনসন বা আলঝেইমার রোগের কারণ হতে পারে।”

বেশিরভাগ ভোক্তা খাবারে টেস্টিং সল্টের অতিরিক্ত ব্যবহার সম্পর্কে সচেতন নন। মানুষের মধ্যে ‘ফাস্ট ফুড’ খাওয়ার ক্রমবর্ধমান প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। দিন দিন এটা বেড়েই চলেছে। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের ফাস্ট ফুড যেমন ফ্রায়েড চিকেন, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, পাস্তা, পিৎজা, বার্গার, শর্মা, স্যান্ডউইচ, গরুর মাংস বা চিকেন রোল খাওয়ার প্রতি আসক্তি বৃদ্ধির অন্যতম কারণ টেস্টিং সল্ট। এসব আইটেমের পাশাপাশি মিক্সড ফ্রাইড রাইসের উপর বিভিন্ন আইটেম তো রয়েছেই।

ঢাকা নগরীর স্কয়ার হাসপাতালের মেডিসিন বিশেষজ্ঞ হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘শহরে বসবাসকারী মানুষের মধ্যে ফাস্ট ফুড খাওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। ফাস্ট ফুড আউটলেটগুলো সর্বদা টেস্টিং সল্ট ব্যবহার করছে কারণ এগুলো খাবারের স্বাদ বাড়ায়। অভিভাবকদের কখনোই তাদের সন্তানদের আলুর চিপস এবং রাস্তার পাশের খাবার কিনে দেওয়া উচিত নয়।”

তিনি রেস্তোরাঁ ও প্যাকেটজাত খাবার, বিশেষ করে আমদানিকৃত খাবারে লবণ ব্যবহারের বিষয়ে একটি আইন প্রণয়নের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। নাম প্রকাশ না করার শর্তে কাওরান বাজার এলাকার এক ফাস্ট ফুড ব্যবসায়ী টেস্টিং সল্টের ক্ষতিকর প্রভাবের কথা জেনেও অতিরিক্ত পরিমাণে টেস্টিং সল্ট ব্যবহার করার কথা স্বীকার করেন। তিনি বলেছেন যে তিনি যদি বার্গার, স্যান্ডউইচ এবং চাইনিজ খাবারের মতো খাবার তৈরিতে টেস্টিং সল্ট না মেশান তবে তার গ্রাহকরা তার রেস্টুরেন্টের খাবার খাবে না।

তিনি বলেন, “আমার কাস্টোমাররা স্বাদের জন্য আমার রেস্টুরেন্টে আসেন। আমরা নিয়মিত খাবারে টেস্টিং সল্ট মেশানো খাবার রান্না করি এবং এটা দীর্ঘদিন ধরেই করে আসছি। এটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।” পুষ্টি বিশেষজ্ঞ রাবেয়া সুলতানা টেস্টিং সল্ট গ্রহণের মারাত্মক প্রভাবের কথা উল্লেখ করেছেন।  বিশেষ করে মাংস, মাছ, স্যুপ, সসেজ, কেচাপ, মেয়োনিজ এবং সয়া সসের মতো টিনজাত খাবারে যে টেস্টিং সল্ট অধিক পরিমাণে মেশানো হয় সেটার ক্ষতিকর প্রভাবের প্রতি জোর দিয়েছিলেন তিনি।

সুলতানা বলেন, “চীন থেকে আমদানিকৃত প্রি-প্যাকেজড খাবার যেমন নুডুলস, স্যুপ, টমেটো সস, ভুট্টার মধ্যে অতিরিক্ত পরিমাণে রাসায়নিক পদার্থ থাকে। ফাস্ট ফুড আইটেমগুলোতে সাধারণত প্রচুর পরিমাণে মনোসোডিয়াম গ্লুটামেট থাকে। এটা আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য খুবই উদ্বেগজনক। গর্ভবতী মহিলাদের অনেক সময় এসব খাবার অতিরিক্ত খাওয়ার কারণে গর্ভপাত হয়ে যাচ্ছে।”

মনোসোডিয়াম গ্লুটামেটকে প্রাকৃতিক ফ্লেভারের চেয়ে গুরত্ব দেওয়া হচ্ছে বেশী। কারণ এটা তুলনামূলকভাবে খুব সস্তা, বেশিরভাগ মুদির দোকানে সহজেই পাওয়া যায়। যেহেতু গুঁড়ো আকারে পাওয়া যায় তাই মেশানোও সহজ। উপরন্তু, এটা অন্যান্য স্বাদ বর্ধক থেকে ভিন্ন। এটা কেনার জন্য কোনো বিশেষ পারমিট বা আমদানি লাইসেন্সের প্রয়োজন হয় না। অথচ এটি অন্যান্য স্বাদ বর্ধকে প্রয়োজন হয়।

প্রখ্যাত জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. মুহাম্মদ আদুস সবুর বলেন, শহরাঞ্চলে বসবাসকারী মানুষের মধ্যে চাইনিজ খাবার বা ফাস্টফুড গ্রহণের প্রবণতা রয়েছে। এবং এ ধরনের খাবারে টেস্টিং সল্ট ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। তিনি বলেন, “এটা খুবই উদ্বেগজনক।”

যারা নিয়মিত চাইনিজ খাবার গ্রহণ করেন তাদের বিশেষ কিছু অসুখ হয় কারণ রেস্তোরাঁগুলো প্রচুর পরিমাণে মনোসোডিয়াম গ্লুটামেট ব্যবহার করে। আজকাল ফাস্টফুডের আউটলেটগুলোও যথেচ্ছ পরিমাণে এই রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করছে।

কোন খাবারের আইটেমগুলিতে টেস্টিং সল্ট থাকে তা বোঝা সহজ কারণ এসব আইটেমগুলোতে নোনতা স্বাদ থাকে। তিনি বলেন, দেশে যেসব আলুর চিপস বিক্রি হয় সেগুলোতে অনুমোদিত সীমার চেয়ে অনেক বেশী মাত্রায় টেস্টিং সল্ট থাকে।

পরিচালক (অসংক্রামক রোগ) অধ্যাপক ডা. এনায়েত হোসেন বলেন, মনোসোডিয়াম গ্লুটামেট একটি রাসায়নিক পদার্থ যা মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।

তিনি আরও বলেন, খাদ্যদ্রব্যে টেস্টিং সল্টের অতিরিক্ত ব্যবহারের বিরূপ প্রভাব সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করতে আমরা দেশব্যাপী প্রচারণা চালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছি।

Leave a Comment