যিনি নিজেকে মর্যাদার চূড়ান্ত আসনে সমাসীন করতে পেরেছিলেন, দুনিয়ায় থাকা অবস্থাতেই জান্নাতে নিজের প্রাসাদকে নিশ্চিত করেছিলেন, যিনি রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর উম্মতের শ্রেষ্ঠ নারীতে পরিণত হয়েছিলেন তিনি হচ্ছেন খাদিজা বিনতে আল-খুওয়াইলিদ (রা)। তার বাবার নাম খুওয়াইলিদ ইবনে আল-আসাদ। ফাতিমা বিনতে আল-যা’ইদাহ তার মা। তার বাবা যুদ্ধে মারা যান। তার বিয়ে হয়েছিল আতিক বিন আবিদ আল-মাখজুমি এর সাথে। তিনিও কিছুদিন পরে মারা যান। তবে তিনি কিভাবে মারা যান তা জানা নেই। এর কিছুদিন পরেই তার আবার বিয়ে হয় আবু হালা ইবন জারারাহ আত-তামিমি এর সাথে। কিন্তু তিনিও মারা যান অল্পদিনের মধ্যে। যার ফলে বিধবা হিসেবে তার পরিচিতি ঘটে।
তার বয়স তখনও তেমন ছিল না। কুরাইশদের মধ্যে অর্থসম্পদের দিক দিয়েও তিনি উঁচু অবস্থানেই ছিলেন। এজন্য তাকে বেশ সম্মানের চোখে দেখা হত। মক্কার কেউ কেউ তাকে মক্কার রাজকন্যা বলতেন আবার কেউ বলতেন খাদিজা আল-কুবরাঃ মহান খাদিজা। সেসময়ের অনেক পুরুষই তাকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি এবার বিয়ে নিয়ে কিছুটা সংশয়ে ভুগছিলেন কারণ ইতিমধ্যেই তাঁর দুবার বিয়ে হয়ে গিয়েছে।
তিনি কিছু পুরুষকে নিয়োগদান করেছিলেন যারা তাঁর হয়ে বানিজ্য করত এবং বানিজ্যের জন্য তারা উপদ্বীপের উত্তরে বা দক্ষিণে গমন করত। বানিজ্য শেষে তারা ফিরে আসত এবং লাভ যা হত তার একটা অংশ শর্তানুযায়ী তারা লাভ করত। কিন্তু তিনি তাদের ব্যাপারে পুরোপুরি নিশ্চিত ছিলেন না এ ব্যাপারে যে তারা সবকিছু ঠিকঠাক পরিচালনা করছে কিনা, ফাঁকি দিচ্ছে কিনা।
অন্যদিকে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) রাখাল হিসেবে কাজ শুরু করেন। এর ফলে তিনি কিছুটা অর্থের মালিক হন। আঠারো উনিশ বছর বয়সে তিনি বাজারে পা রাখেন সেই অর্থ দিয়ে। তিনি ক্রেতা ও বিক্রেতার একে অপরের সাথে পরিচয় ঘটিয়ে দিতেন এবং ফলশ্রুতিতে তাকে কমিশন দেয়া হত। খুব শীঘ্রই তিনি তার সততার জন্য পরিচিতি লাভ করেন। তার একাগ্রতা দেখে মানুষ প্রশংসা করতে থাকে। তখন থেকেই তার সুপরিচিত উপাধি আস-সাদিক আল-আমিন মানুষের কাছে মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। ধীরে ধীরে তার অর্থ বাড়তে থাকে, একপর্যায়ে তিনি নিজেই পণ্য ক্রয়-বিক্রয়ের সামর্থ্য অর্জন করে ফেলেন। ফলে ব্যবসায়ী হিসেবে সবার কাছে এবার তার নতুন পরিচয় পৌঁছে যায়। সবাই তাকে (সা.) পরিশ্রমী হিসেবে চেনে। তিনি কখনই অনৈতিকভাবে একপয়সাও উপার্জন করতেন না, কাউকে ভুলেও ঠকাতেন না। তিনি ক্রেতাকে খারাপ পন্য গছিয়ে দিতেন না, পরিমাণে কম দিতেন না। তার সততার কথা সবাই জেনে যায়। এ খবর খাদিজা (রা.) এর কানেও পৌঁছায়। তিনি তাঁর ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে তাঁর কাছে ব্যবসার প্রস্তাব পাঠান।
মুহাম্মদ (সা.) তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করেন। তিনি তাকে ব্যবসার কিছু শর্ত দেন এবং লভ্যাংশের ব্যাপারগুলি চূড়ান্ত হয় এবং রাসূলও (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এতে রাজি হয়ে যান। তিনি বললেনঃ ‘আমি আপনার সাথে আমার এক দাসকে পাঠাব, ওর নাম মাইসারাহ।’
মাইসারাহ রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর সাথে ব্যবসায়িক কাজে আশ শামে চলে গেলেন। তিনি দারুণ কিছু বিষয় লক্ষ্য করলেন রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর মধ্যে। তার মধ্যে অভূতপূর্ব সততা, একাগ্রতা ছিল। অলৌকিক বিষয়গুলোও তাঁর নজর এড়ায়নি। যেমন তিনি দেখতেন মেঘ তাঁর মাথার উপরে এসে তাকে ছায়া দিচ্ছে। একবার রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) গাছের নিচে বিশ্রাম নেবার জন্য দাঁড়ান। তখন এক সন্ন্যাসী সেখানে এসে মাইসারাহকে জিজ্ঞেস করে, ‘এই লোকটি কে?’ মাইসারাহ বলেনঃ ‘তিনি মুহাম্মদ ইবনে আব্দিল্লাহ আল-কুরাইশি আল-হাশিমি।’ তখন সন্যাসী বললেন, ‘না না, আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে। আমি কিতাবে পড়েছি যে এক লোক ঠিক এই মূহুর্তে এই গাছের ছায়ার নিচে এসে দাঁড়াবেন আর তিনিই হবেন সর্বশেষ জামানার নবী।’ মাইসারাহ এটা শুনে বিস্মিত হয়ে যান।
যাইহোক, তারা ব্যবসা সমাপ্ত করে আবার মক্কায় ফিরে আসেন। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এই যাত্রায় দ্বিগুণ লাভ করতে সমর্থ হয়েছিলেন। খাদিজা (রা.) এর পূর্ববর্তী কোন ব্যবসায়িক যাত্রাই এতটা লাভের মুখ দেখেনি। তিনি অভিভূত হয়ে যান এবং মাইসারাহকে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেন। মাইসারাহ বলেন, ‘আমি আমার জীবনে এত ভালো মানুষের সাথে পূর্বে কাজ করিনি। এমন চরিত্রও আগে কখনো দেখিনি। তিনি সৎ, বিশ্বাসযোগ্য, দয়ালু এবং উচ্চমার্গীয় চরিত্রের অধিকারী। কিন্তু তাঁর চাইতেও বড় বিষয়, আমি তাঁর সাথে থাকাকালীন সময়ে কিছু অলৌকিক দৃশ্য অবলোকন করেছি।’
খাদিজা (রা.) এর এক বান্ধবীর নাম ছিল নাফিসা। তিনি খাদিজা (রা.) কে জিজ্ঞেস করলেন তাঁর ব্যবসায়িক অবস্থা সম্পর্কে। খাদিজা (রা.) বলেন, ‘এতটা ভালো আগে কখনো যায়নি। আমি ব্যবসায়িক সঙ্গী হিসেবে মুহাম্মদ (সা.) নামের এক যুবককে খুঁজে পেয়েছি যিনি অত্যন্ত সৎ, সুন্দর চরিত্রের অধিকারী। তাঁর ব্যাপারে অভিযোগ করার মত কিছু পাইনি।‘ নাফিসা শুনে বললেন, ‘খাদিজা, বেশ অনেক দিন হয়ে গিয়েছে তুমি অবিবাহিত। বিয়ের ব্যাপারে তোমার আবার চিন্তাভাবনা করা উচিত।’ অবশ্য তাঁর বিয়ের ব্যাপারে তখনও নিয়মিত প্রস্তাব আসত প্রায় প্রতিদিনই। এমনকি সে সময়ে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)ও বিয়ের প্রস্তাব পাচ্ছিলেন। কিন্তু সেসব প্রস্তাবের কোনটাতেই তাঁর হৃদয় সায় দেয়নি।
নাফিসা খাদিজাকে (রা.) বিয়ের ব্যাপারে বলার পর তিনি জবাব দিলেন, ‘আমিও বিয়ের ব্যাপারে ভেবেছি তবে উপযুক্ত মানুষের অপেক্ষায় রয়েছি আমি।’ তাই নাফিজা এবার মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর নাম তাঁর কাছে পেশ করলেন। খাদিজা (রা.) বললেন, ‘আমিও উনার কথা ভেবেছি। উনার কাছে বিয়ের প্রস্তাব নিশ্চয়ই উত্তম হবে। কিন্তু কিভাবে আমি প্রস্তাব দেব?’ নাফিসা ব্যাপারটি তাঁর হাতে ছেড়ে দিতে বললেন। তিনি রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর কাছে গিয়ে বললেন, ‘আপনি কি খাদিজা (রা.) এর ব্যাপারে ভেবেছেন? তাঁর পরিবার অত্যন্ত সম্ভ্রান্ত। আপনি কি খাদিজা (রা.) এর কাছ থেকে বিয়ের প্রস্তাব পেলে গ্রহণ করবেন?’ রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, ‘নিশ্চয়ই। এরচেয়ে উত্তম প্রস্তাব কি হতে পারে?’ এরপরে তিনি বললেন, ‘আমার এ ব্যাপারে চাচার সাথে পরামর্শ করা প্রয়োজন।’ তিনি তাঁর চাচা আবু তালিবের কাছে গিয়ে বললেন, ‘ইয়া আম্মি, আমার কাছে খাদিজা (রা.) এর পক্ষ হতে প্রস্তাব এসেছে।’ আবু তালিব শুনে বললেন, ‘দারুণ প্রস্তাব। তাহলে তো ব্যাপারটিকে বাস্তবায়ন করতে হয়।’
আবু তালিব, মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এবং তাঁর আরেক চাচা হামজা (রা.) খাদিজা (রা.) এর চাচার কাছে গেলেন। সেখানে গিয়ে তারা সম্মানের সাথে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কে উপস্থাপন করলেন, ‘আমাদের ভাইপো মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আপনার ভাইঝি খাদিজাকে (রা.) বিয়ে করতে ইচ্ছুক।’ তারা সকলেই এই বিয়েতে সম্মত হলেন। তবে কিছু বর্ণনাতে এমন এসেছে যে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রস্তাবে সম্মত হয়েছিলেন কিন্তু বলেছিলেন তার বিয়ের প্রস্তুতির ব্যাপারে কিছু সময় প্রয়োজন হবে যেমন মাহর দিতে হবে, আর্থিকভাবে আরেকটু স্বাচ্ছন্দ্যশীল হতে হবে ইত্যাদি। খাদিজা (রা.) এর জবাবে বলেন এসবের কোনকিছুরই প্রয়োজন হবে না। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এই বিয়েতে মোহর হিসেবে ২০ টি উট দেন।
বিয়ের পর তারা সুখে-স্বাচ্ছন্দ্যে দিন কাটাতে থাকেন। তাদের জীবন আনন্দে কেটে যাচ্ছিল। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ২৫ বছর বয়সেই বিয়ে করেন। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে, বিয়ের বেশ অনেক বছর পর পর্যন্তও কোন উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটেনি। আমরা রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কে বুদ্ধিমান, মেধাবী এবং সম্মানিত হিসেবেই জানি। অথচ বিয়ের দশ বছরের মধ্যেও তিনি নিজেকে বড় ধরণের কিছুতে জড়ানোর চেষ্টাই করেন নি। কারণ তিনি সবচেয়ে গুরত্বপূর্ণ কাজে নিজেকে জড়িয়ে রেখেছিলেন আর তা হচ্ছে ঘর এবং পরিবার গঠন। তিনি তাঁর স্ত্রীর সাথে সময় কাটাচ্ছিলেন, সন্তানদের বড় করে তুলছিলেন। সেসময় তাদের ছয়জন সন্তান ছিল। এর মধ্যে দুজন পুত্র-সন্তান আব্দুল্লাহ এবং আল-ক্বাসিম। আল-ক্বাসিম আনুমানিক ২ বছর বয়সেই মারা যান। তিনি সেই বয়সে হাঁটতে পারতেন এবং প্রাণীর উপরেও চড়ে বসতে পারতেন। কিন্তু তাকে আল্লাহর কাছে ফিরে যেতে হয় সেই বয়সেই। অন্য পুত্র আব্দুল্লাহ ‘আত-তায়্যিব, আত-তাহির’ নামে পরিচিত ছিলেন। তিনিও শিশুকালেই মারা যান। যদিও ঘটনাগুলি দুঃখজনক কিন্তু এসব ঘটনা তাদের বড় কিছুর জন্য প্রস্তুত করছিল। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও খাদিজা (রা.) উভয়েই তাদের পিতামাতাকে হারিয়েছেন, নিকট আত্মীয়দের হারিয়েছেন আর এখন হারালেন তাঁর সন্তানদের।
খাদিজা (রা.) প্রতি সকালে উঠে তাঁর স্বামীকে বলতেন, ‘বাইরে বেরিয়ে পড়ুন, মানুষের কাছে আপনার দাওয়াত পৌঁছে দিন।’ পরবর্তী ছয়-সাত বছরে অনেক ঘটনা ঘটে। প্রতিপক্ষরা মনে করে, এই সমস্যাকে(!) দমানোর একমাত্র উপায় মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম), তাঁর পরিবার ও তাঁর অনুসারীদেরকে বয়কট করা। তাদেরকে একাকী রাখতে হবে এবং মক্কা থেকে বিতাড়িত করতে হবে। আবু তালিব মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম), তাঁর পরিবার ও তাঁর সকল অনুসারীদেরকে নিয়ে মক্কার বাইরে চলে গেলেন। সেই জায়গাটি আবু তালিবের অধীনে ছিল। সেখানে তারা তিন বছর মূল সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকেন। কেউ তাদের সাথে ব্যবসা-বানিজ্য বা বিনিয়োগ করত না। কেউ তাদেরকে খাবার দিত না, কথাও বলতে আসত না, কোন দয়া প্রদর্শন করত না। দিনের পর দিন পার হয়ে যেত কিন্তু তাদের খাবার মত কিছু থাকত না, পান করার মত কিছু থাকত না। শিশুরা ক্ষুধার তাড়নায় কাঁদত। তাদের মায়েরাও কাঁদত কারণ তাদের পেটে কিছু পড়েনি, তাদের বাচ্চাদেরও কিছু দিতে পারেনি। অনেক কবর খোঁড়া হয় এ সময়। মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়েছিল, পুষ্টিহীনতায় ভুগছিল। অবশেষে আল্লাহ অলৌকিক উপায়ে তাদের উপর থেকে এই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেন। সবাই আবার মক্কায় ফিরে আসে। খাদিজা (রা.) এর বয়স এসময়ে আরো বেড়ে যায়। তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। গত তিন বছরে নির্যাতিত মানুষগুলোর মা হিসেবে তিনি সকলের পরিচর্যা করেছিলেন। এতদিনের মানসিক ও শারিরীক শ্রম তাঁর উপরে যেন জেঁকে বসেছিল। তিনি আর বহন করতে পারছিলেন না। এর কয়েক মাস পরে তিনি শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন। রাসূলও (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এই সময়টিতে দাওয়াতী কাজ করতে পারেন নি তেমন। অবশেষে খাদিজা (রা.) শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন।
কিছু বর্ণনায় এসেছে, রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এই ঘটনায় এতটাই মুষড়ে পড়েন যে তিনি ঘর থেকেই বের হন নি। তিনি বাসায় ছিলেন তাঁর মেয়ে ফাতিমা (রা.) এর সাথে, মুষড়ে পড়া অবস্থা থেকে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার চেষ্টা করছিলেন। কয়েকদিন তাকে ঘরের বাইরে দেখা যায়নি। যখন তাঁর পরিবারের সদস্যরা তাঁর সাথে দেখা করতে আসল, তখন তাঁর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর চেহারায় কান্নার ছাপ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। তিনি তাঁর মেয়েকে জড়িয়ে ধরে রেখেছিলেন, মাতৃবিয়োগে নিজের কন্যাকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কয়েকদিন ঘর থেকে বের হন নি এই খবর পেয়ে এমনকি আবু লাহাবও রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর দরজায় এসে কড়া নাড়ে। যখন রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দরজা খুলে দিলেন তখন আবু লাহাব যে যুগ ধরে তাঁর বিরুদ্ধে লড়ছে সেও অন্তরে খারাপ বোধ করল এবং মানুষের কাছে যেয়ে বলল, ‘আমি আর আমার ভাতিজার বিরুদ্ধাচরণ করব না।’ আবু লাহাবের মত জঘন্য মানুষের হৃদয়ও নরম হয়ে গিয়েছিল এরূপ ঘটনায়।
তিনি খাদিজা (রা.) কে প্রচন্ড ভালোবাসতেন। তাঁর কথা কোনদিনও তাঁর স্মৃতি থেকে বিস্তৃত হয় নি। একদা তারই জামাই যুদ্ধবন্দী হয় রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর প্রতিপক্ষ হিসেবে। তাঁর জামাইকে ছাড়ানোর জন্য তাঁর মেয়ে জয়নব (রা.) মুক্তিপণ হিসেবে নেকলেস পাঠান। যখন নেকলেসটি তাঁর সামনে রাখা হল তখন তিনি দেখামাত্রই চিনে গেলেন তিনি এটা আগে কোথায় দেখেছেন। এটা খাদিজারই (রা.) নেকলেস যা তিনি তাঁর মেয়েকে দিয়েছিলেন। সেই নেকলেস দেখার সাথে সাথে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর চোখ দিয়ে অঝোর ধারায় অশ্রু প্রবাহিত হতে থাকে। অন্যরাও এই দৃশ্য দেখে ইমোশনাল হয়ে পড়েন। কেউ কেউ ক্ষমা চেয়ে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কে জিজ্ঞেস করছিলেন সবকিছু ঠিকঠাক আছে কিনা। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাদের বললেন, ‘তোমরা কেউই কিছু করনি। আমি শুধু আমার খাদিজার (রা.) এর পরনের নেকলেসটি চিনতে পেরেছি। সে ওটা আমাদের মেয়ে জয়নব (রা.) কে দিয়েছিল। এই নেকলেস দেখে আমার তাঁর কথা মনে পড়েছে।’
একদা রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর ঘরে বসেছিলেন, এসময় দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ শুনলেন। ঠিক এভাবেই খাদিজা (রা.) দরজায় কড়া নাড়তেন। কড়া নেড়েছিলেন তারই বোন হালা (রা.)। তিনি কড়া শুনামাত্রই উঠে দরজার দিকে গেলেন, বলতে লাগলেনঃ ‘হে আল্লাহ এটা যেন হালা হয়, এটা যেন হালা হয়।’ তিনি দরজা খুলে দেখলেন হালা (রা.)ই এসেছেন, তিনি তাকে আমন্ত্রণ জানিয়ে ঘরে বসতে দিলেন। তারপর খাদিজার (রা.) ব্যাপারে দীর্ঘ সময় ধরে কথা বললেন তাঁর সাথে। অথচ এতদিনে তাঁর মৃত্যুর যুগ পেরিয়ে গেছে।
রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর আরেক স্ত্রী আয়িশা (রা.) বলতেন, ‘কখনো কখনো মনে হত দুনিয়ায় বোধহয় খাদিজা (রা.) ব্যতীত আর কেউ নেই।’ তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সবসময় তাঁর ব্যাপারে কথা বলতেন, তাঁর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিষয়গুলিও বাদ দিতেন না।
ইবনে ইসহাক লিখেন, খাদিজা (রা.) রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর উপর আনিত প্রতিটি বিষয় বিশ্বাস করেন এবং তাঁর উপরে ইমান আনয়ন করেন। তিনি তাকে সকল ব্যাপারে সহায়তা করেন যেন রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বিজয়ী হতে পারেন। তিনিই প্রথম ব্যক্তি হিসেবে ইসলামে প্রবেশ করেন, তিনি রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কে সবার প্রথমে আল্লাহর রাসূল হিসেবে গ্রহণ করেন। আল্লাহ রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর উপর অর্পিত ভার খাদিজা (রা.) এর মাধ্যমে হালকা করে দিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন এক স্তম্ভের ন্যায় যার দেয়ালে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হেলান দিতেন। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যখন মানুষকে দাওয়াত দিতেন তখন যখন মানুষ তাঁর বিরোধিতা করত, যখন তাকে গালিগালাজ করত তখন তিনি কষ্ট পেতেন। তিনি এরপর বাড়ি চলে যেতেন এবং খাদিজা (রা.) এর সাথে কথা বলতেন। এর মাধ্যমে আল্লাহ তাঁর উপর থেকে দুঃখ, কষ্ট দূর করে দিতেন। যতবারই রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সমস্যায় নিপতিত হতেন ততবারই তিনি বাড়িতে যেতেন খাদিজা (রা.) এর কাছে এবং খাদিজাও (রা.) প্রস্তুত থাকতেন তাঁর হাত ধরে তাঁর দুঃখ নিবারণ করার জন্য। তাঁর চোখের দিকে স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে বলতেনঃ আপনি আল্লাহর রাসূল। আপনার দায়িত্ব সত্য প্রচার করা, আপনি সেই পথে অটল থাকুন যার দায়িত্ব আপনাকে দেয়া হয়েছে।’
একবার রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঘরে বসে ছিলেন। খাদিজা (রা.) উঠে বাইরে গেলেন দেখার জন্য যে রান্নার কি অবস্থা। এসময় জিবরাইল (আ.) রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর কাছে এসে বললেন, ‘খাদিজা (রা.) আপনার কাছে আসছেন একবাটি খাবার হাতে নিয়ে। যখন তিনি খাবার তিনি এসে আপনার সামনে রাখবেন তখন আপনি তাকে ধরে বলবেন, আল্লাহ তাকে তাঁর সালাম জানিয়েছেন।’
স্বয়ং আল্লাহ তাকে সালাম দিয়েছেন, তাকে সুসংবাদ জানিয়েছেন। আল্লাহ তাকে কনগ্র্যাচুলেট করছেন কারণ তিনি জান্নাতে নিজের জন্য এক প্রাসাদের অধিকারী হতে সক্ষম হয়েছেন যার দৈর্ঘ্য এতটাই বড় যে চক্ষু ক্লান্ত হয়ে যাবে তা মাপতে, যা হবে মনিমুক্তাখচিত, এতে থাকবেনা কোন খুঁত, থাকবেনা কোন শব্দ, থাকবেনা কোন খুঁটি, কোন বীম। সেখানে কোন কষ্ট, যাতনার অস্তিত্ব সেখানে নেই। আল্লাহ নিজে সেই প্রাসাদকে খাদিজা (রা.) এর জন্য প্রস্তুত করে রেখেছেন। আল্লাহ যে প্রস্তুত রেখেছেন সেটাও তাঁর বান্দীকে জানিয়ে দিতে চাচ্ছেন। তাকে সালাম জানিয়ে খাদিজা (রা.) কে এই বার্তাই পৌঁছাতে চাইলেন যে তিনি তাঁর অপেক্ষায় রয়েছেন। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যখন খাদিজা (রা.) কে বললেন তখন তিনি কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন। তিনি অবাক হয়ে বললেন, ‘আল্লাহ আমাকে সালাম জানিয়েছেন?’
খাদিজা (রা.) কে ছাড়া রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আরো ১২-১৩ বছর কাটিয়েছেন কিন্তু কখনই তাঁর স্মরণ থেকে তিনি বিস্তৃত হননি। তাঁর স্মৃতিকে নিজের ভেতরে জিইয়ে রেখেছিলেন, এটাই তো প্রকৃত ভালোবাসা। আর এটাই ছিল রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও খাদিজা (রা.) এর মধ্যকার ভালোবাসার গল্প, যার অনুরূপ কিছু এই দুনিয়া আর কখনো দেখিনি, আর কোনদিনও দেখবেনা।