কে এই ইয়েভহেন মুরাইয়েভ

ইউক্রেনের ক্ষমতায় একজন রুশপন্থী নেতাকে বসাতে চায় ক্রেমলিন। এই অভিযোগ তুলেছে যুক্তরাজ্য। একই সঙ্গে দেশটি বলেছে, সামরিক আগ্রাসনের পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ইউক্রেনের সাবেক রাজনীতিবিদদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন রাশিয়ার গোয়েন্দারা।যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দাবি করেছে, কিয়েভে একটি নতুন সরকারের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য ইউক্রেনের রাজনীতিবিদ ইয়েভহেন মুরাইয়েভকে বিবেচনা করছে রাশিয়া।যুক্তরাজ্যের এমন অভিযোগ অস্বীকার করেছে রাশিয়া। মুরাইয়েভ নিজেও এই দাবি নাকচ করেছেন বলে অবজারভার পত্রিকা জানিয়েছে।

মুরাইয়েভ কে?
মুরাইয়েভের জন্ম ১৯৭৬ সালে। তিনি রাশিয়ার সীমান্তের কাছের পূর্বাঞ্চলীয় শহর খারকিভে জন্ম নেন।ইউক্রেনে পশ্চিমাপন্থী নেতৃত্বের বিরোধিতাকারী রাজনীতিবিদদের মধ্যে অন্যতম মুরাইয়েভ। ২০১৪ সালের গণবিক্ষোভের পর এই পশ্চিমাপন্থী নেতারাই ইউক্রেনের ক্ষমতা গ্রহণ করেন।মুরাইয়েভ ইউক্রেনের সাবেক প্রেসিডেন্ট ভিক্টর ইয়ানুকোভিচের মিত্র হিসেবে খারকিভে তাঁর রাজনৈতিক জীবন শুরু করেন। ইয়ানুকোভিচ ২০১৪ সালের ময়দান স্কয়ার অভ্যুত্থানের পর রাশিয়ায় পালিয়ে যান।

২০১৪ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ইউক্রেনের একজন আইনপ্রণেতা ছিলেন মুরাইয়েভ। তিনি মস্কো-সমর্থিত ইয়ানুকোভিচের পার্টি অব রিজিয়নসের সদস্য ছিলেন।পরে একাধিক দল নিয়ে গঠিত অপজিশন ব্লকের হয়ে রাজনীতি শুরু করেন মুরাইয়েভ। কিন্তু ২০১৬ সালের জুনে তিনি এই ব্লক থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নেন। একপর্যায়ে একই ঘরানার লোকজন নিয়ে তিনি নিজেই ‘ফর লাইফ’ নামের পার্টি প্রতিষ্ঠা করেন।২০১৮ সালে মুরাইয়েভ ‘নাশি’ নামের আরেকটি পার্টি প্রতিষ্ঠা করেন।মুরাইয়েভ ২০১৯ সালের নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে নিবন্ধন করেছিলেন। কিন্তু ভোটের আগে তিনি তাঁর প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নেন।

রাজনৈতিক মতাদর্শ
মুরাইয়েভ অতীতে এমন রাজনৈতিক মতাদর্শ প্রচার করেছেন, যার সঙ্গে ইউক্রেন সম্পর্কে রাশিয়ার দৃষ্টিভঙ্গির মিল পাওয়া যায়। তিনি ময়দান স্কয়ারের গণবিক্ষোভকে পশ্চিমা-সমর্থিত ‘ক্যু’ মনে করেন।গত বছর মুরাইয়েভ ইউক্রেনের পূর্ব ডনবাস অঞ্চলের যুদ্ধকে সরকার ও বিদ্রোহীদের মধ্যকার একটি অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব হিসেবে বর্ণনা করেন। তাঁর এই দৃষ্টিভঙ্গি ইউক্রেন ও পশ্চিমাদের বিপরীত। ইউক্রেন ও পশ্চিমাদের মতে, এটি ছিল ইউক্রেন ও রাশিয়া-সমর্থিত প্রক্সিদের মধ্যকার সংঘাত।২০২১ সালে মুরাইয়েভ বলেছিলেন, ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি পশ্চিমা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।

মুরাইয়েভ রাশিয়ার মতোই ইঙ্গিত দিয়েছিল যে ইউক্রেন শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে রাশিয়া-সমর্থিত বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দখলকৃত অঞ্চল পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করতে পারে। তবে কিয়েভ এ ধরনের কোনো পরিকল্পনার কথা অস্বীকার করেন।মুরাইয়েভ বলেছিলেন, জেলেনস্কি একজন জিম্মি। তাঁকে যুক্তরাজ্যের এম ১৬ বা যুক্তরাষ্ট্রের সিআইএ—যে কারও দ্বারা ব্ল্যাকমেল করা হচ্ছে। ভবিষ্যতে তাঁরা ডনবাসে একটি আক্রমণ চালাতে জেলেনস্কিকে বাধ্য করতে পারে। আর তেমনটি হলে, তা একটি পূর্ণমাত্রার যুদ্ধের রূপ নেবে।মুরাইয়েভ বলেছিলেন, রাশিয়াকে এই উত্তেজনার মধ্যে টেনে আনার অর্থ হবে—একদিকে ইউক্রেনের হাজারো মানুষের মৃত্যু, অন্যদিকে ভূখণ্ডগত বিচ্ছিন্নতা।

মুরাইয়েভের প্রভাব কতটা
ইউক্রেনের মস্কোপন্থী ব্যবসায়ী ভিক্টর মেদভেদচুকের চেয়ে মুরাইয়েভ কম পরিচিত। মেদভেদচুক একজন আইনপ্রণেতাও। তিনি বলে থাকেন, তাঁর মেয়ের গডফাদার হলেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। রাষ্ট্রদ্রোহের মামলায় গত বছর মেদভেদচুকের মেয়েকে গৃহবন্দী করা হয়েছিল। মুরাইয়েভের ‘ন্যাশ’ নামের একটি টিভি চ্যানেল আছে। এই টিভি চ্যানেলটির সম্প্রচার ২০১৮ সালে শুরু হয়। চ্যানেলটির আনুষ্ঠানিক মালিক মুরাইয়েভের বাবা। এই চ্যানেল ব্যবহার করে মুরাইয়েভ তাঁর নাম-যশ-প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা অব্যাহত রাখছেন।

২০২১ সালের ডিসেম্বরে রাজুমকভ সেন্টার নামের থিঙ্কট্যাংকের একটি জরিপ অনুসারে, মুরাইয়েভ ২০২৪ সালের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সম্ভাব্য প্রার্থীদের মধ্যে ৬ দশমিক ৩ শতাংশ জনসমর্থন নিয়ে সপ্তম স্থানে ছিলেন। রেটিং গ্রুপ নামের আরেকটি সংস্থার জরিপে তাঁকে পঞ্চম স্থানে রাখা হয়।২০১৭ সালে মুরাইয়েভ তাঁর সম্পত্তির হিসাব দাখিল করেন। ইউক্রেনের আইনপ্রণেতাদের বাধ্যতামূলকভাবে এই হিসাব দিতে হয়। দাখিলকৃত হিসাবে তিনি ২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, ১ মিলিয়ন ইউরো ও ১৩ মিলিয়ন ইউক্রেনীয় মুদ্রার নগদ সম্পদ ঘোষণা করেন।

যুক্তরাজ্যের অভিযোগ সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া
মুরাইয়েভ যুক্তরাজ্যের অভিযোগ নাকচ করেছেন। তিনি অবজারভার পত্রিকাকে বলেছেন, এই অভিযোগ খুব একটা যৌক্তিক নয়।এক ফেসবুক পোস্টে এ নিয়ে আরও মন্তব্য করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন মুরাইয়েভ। এই পোস্টে তিনি জেমস বন্ড আদলে নিজের একটি ফটোশপ করা ছবি দিয়েছেন।পরবর্তী এক ফেসবুক পোস্টে মুরাইয়েভ ইউক্রেনকে পশ্চিমাপন্থী ও রুশপন্থী রাজনীতিবিদদের মধ্যে বিভক্ত করার প্রবণতা অবসানের আহ্বান জানান। তিনি বলেন, তাঁর দেশের নতুন নেতা দরকার।যুক্তরাজ্যের অভিযোগকে ‘গুজব’বলে উড়িয়ে দিয়েছে রাশিয়া।অভিযোগের ব্যাপারে ইউক্রেন সরকারের তাৎক্ষণিক কোনো মন্তব্য ছিল না।মুরাইয়েভকে একজন অদ্ভুত প্রকৃতির মানুষ হিসেবে দেখেন ইউক্রেনের রাজনৈতিক বিশ্লেষক ভলোদিমির ফেসেনকো।ফেসেনকোর দৃষ্টিতে, মুরাইয়েভ তাঁর সব রুশপন্থিতার জন্য ক্রেমলিনের খুব কাছের মানুষ নন, বিশেষ করে মেদভেদচুকের তুলনায়।বার্তা সংস্থা রয়টার্স অবলম্বনে।

Leave a Comment