কাদের ঝুঁকি বেশি উচ্চ রক্তচাপ বা হাইপারটেনশন কীভাবে হয়

কাদের ঝুঁকি বেশি উচ্চ রক্তচাপ বা হাইপারটেনশন কীভাবে হয়

হাইপারটেনশন বা উচ্চ রক্তচাপ নিয়ে মানুষের মধ্যে নানা ধরণের ভুল ধারণা আছে। অনেকে মনে করেন, কারো অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা করার প্রবণতা থাকলে হয়ত সেটিকে হাইপারটেনশন বলে। কেউ মনে করেন কারো উচ্চ রক্তচাপ থাকলে হয়ত উদ্বেগ উৎকণ্ঠার সময় যে বুক ধড়ফড় করে সেটাই হাইপারটেনশন।

 

চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায়, উচ্চ রক্তচাপেরই আরেক নাম হাইপারটেনশন। যুক্তরাজ্যের স্বাস্থ্যসেবা সংস্থা এনএইচএস হাইপারটেনশনকেই হাই ব্লাড প্রেশার বা উচ্চ রক্তচাপ বলে বর্ণনা করছে।বিশ্বব্যাপী প্রায় ১৫০ কোটি মানুষ উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন।বাংলাদেশে এক চতুর্থাংশ মানুষ হাইপারটেনশন বা যাকে সাধারণভাবে আমরা উচ্চ রক্তচাপ বলে জানি, তাতে ভুগছেন বলে চিকিৎসকেরা বলছেন। আর তাতে পুরুষের চেয়ে নারীরা বেশি ভুগছেন।

 

মে মাসের ১৭ তারিখ বিশ্বব্যাপী হাইপারটেনশন দিবস পালন করা হয়, দিনটিকে সামনে রেখে চলুন জেনে নিই হাইপারটেনশন নিয়ে মৌলিক কিছু বিষয়াবলী।উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ কোন সময়ে সবচেয়ে ভাল কাজ করে । উচ্চ রক্তচাপ নীরব এই ঘাতক থেকে বাঁচতে আপনি যা করতে পারেন।

কেন হয় হাইপারটেনশন বা উচ্চ রক্তচাপ?
এক সময় ধরে নেয়া হত কেবল বয়স্ক মানুষ অর্থাৎ ৪০ বছরের বেশি হলেই কারো উচ্চ রক্তচাপের আশঙ্কা তৈরি হয়।এখন চিকিৎসকেরা বলছেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অল্পবয়সীদের মধ্যেও এ রোগ দেখা যাচ্ছে।

 

বাংলাদেশ কার্ডিওভাসকুলার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের সভাপতি এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের হৃদরোগ বিভাগের অধ্যাপক এসএম মুস্তাফা জামান বলেছেন, সবচেয়ে বড় শঙ্কার ব্যাপার হচ্ছে, বেশিরভাগ মানুষ নিজেরা হাইপারটেনশনে ভুগছেন সে সম্পর্কে জানেন না।তার কারণে হার্ট অ্যাটাক বা হার্ট ফেইলিওরের মত বড় ধরণের কোন অসুস্থতায় আক্রান্ত হয়ে থাকে যার পরিণতিতে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।তবে নিয়মিত রক্তচাপ পরীক্ষা এবং চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী চললে এ নীরব ঘাতকের হাত থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব ।সেজন্য সবার আগে প্রয়োজন শনাক্ত করা যে আপনার রক্তচাপ বিপৎসীমার নিচে আছে কি না, আর না থাকলে কী করতে হবে।কিভাবে বোঝা যাবে একজন মানুষ উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন কি-না?

লক্ষণ কী?
আফসানা সুলতানা একজন ব্যাংকার। দুই হাজার কুড়ি সালে প্রায় মাসখানেক ধরে তার ঘাড় ব্যথা, বুক ধড়ফড় করা এবং বমি বমি ভাব হচ্ছিল।তিনি ভেবেছিলেন হয়ত দীর্ঘসময় কম্পিউটারে কাজ করছেন বলে ঘাড় ব্যথা হচ্ছে। সাথে খাওয়া-দাওয়ায় অনিয়মের কারণে গ্যাস হয়ে হয়ত বমি ভাব হচ্ছে।নিজে নিজে ওষুধের দোকান থেকে ওষুধ কিনে খাচ্ছিলেন। লাভ হচ্ছিল না।

 

এরপর একদিন হঠাৎ তিনি বাড়িতে অজ্ঞান হয়ে যান। হাসপাতালে নেয়ার পর চিকিৎসকেরা জানান যে তার একটি মাইল্ড স্ট্রোক হয়েছে। এবং তার রক্তচাপ অনেক বেশি।কয়েকদিন হাসপাতালে চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে থাকার সময় দেখা গেল উচ্চ রক্তচাপ ছাড়া তার আর কোন বড় সমস্যা মানে হৃদরোগ, ডায়াবেটিস কিংবা কিডনি রোগ নেই।তখন চিকিৎসকেরা জানান উচ্চ রক্তচাপের কারণেই তার স্ট্রোক হয়েছিল।এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আফসানা সুলতানার যে লক্ষণগুলো ছিল সেগুলোই কি উচ্চ রক্তচাপের লক্ষণ?চিকিৎসকেরা বলছেন, না।

 

অধ্যাপক এসএম মুস্তাফা জামান বলেছেন, বাংলাদেশে হাইপারটেনশনের যে রোগীরা আসেন তাদের মধ্যে তিন ভাগের একভাগ রোগী জানেনই না যে তারা হাইপারটেনশনে ভুগছেন।একভাগ রোগী আসেন ঘাড় ব্যথা, মাথা ব্যথা, বমি ভাব বা বমি হওয়া, শরীর খারাপ এমন ধরণের উপসর্গ নিয়ে।

 

আর একভাগ রোগী আসেন উচ্চ রক্তচাপের ফলে হওয়া জটিলতা নিয়ে, যেমন হার্ট ফেইলিওর বা হার্ট অ্যাটাক এবং স্ট্রোক হবার পর।সাধারণভাবে তিনি কয়েকটি লক্ষণের কথা বলেছেন, যেমন ঘাড় ও মাথা ব্যথার পাশাপাশি মাথা ঘোরা, অল্পে রেগে যাওয়া, রাতে ভালো ঘুম না হওয়া, অস্থির লাগা– এমন লক্ষণ দেখা গেলে সতর্ক হতে হবে, এবং রক্তচাপ পরিমাপ করে দেখতে হবে।

 

কখন বোঝা যাবে উচ্চ রক্তচাপ বা হাইপারটেনশন হয়েছে?হৃৎপিণ্ডের ধমনীতে রক্ত প্রবাহের চাপ বেশি থাকলে তাকে উচ্চ রক্তচাপ বা হাই ব্লাড প্রেশার বলা হয়।অধ্যাপক জামান বলেছেন, যখন কোন মানুষের রক্তচাপ পরিমাপের দুটি একক, অর্থাৎ সিস্টলিক প্রেশার, যাকে প্রেশারের উপরের পরিমাপক বলা হয়, এবং ডায়াস্টলিক প্রেশার, যাকে সহজভাবে নিচের দিকের রক্তচাপ পরিমাপক বলা হয়, সেখানে নির্ধারিত মাত্রার উপরে রক্তচাপ চলে যায়।

 

একজন সুস্থ মানুষের রক্তচাপ থাকার কথা ১২০/৮০ মিলিমিটার মার্কারি। সেটি যদি কারো পরপর দুইদিন ১৪০/৯০ এর বেশি থাকলে তখন সেটিকে উচ্চ রক্তচাপ বলে চিহ্নিত করা হয়।তবে রোগীর বয়স ৮০ বছর বা তার বেশি হলে রক্তচাপের পরিমাপক বেশি হবে।উচ্চ রক্তচাপ শনাক্ত, খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন এবং ওষুধ গ্রহণ করতে হবে নিয়মিত

 

কীভাবে বাড়ে রক্তচাপ?

অধ্যাপক জামান বলেছেন, উচ্চ রক্তচাপ কিভাবে বাড়ে সেটি নির্দিষ্ট করে জানা যায় না।তবে, অনেক সময়ই উচ্চ রক্তচাপের প্রাথমিক কারণের সাথে বংশগতির সম্পর্ক থাকে।তবে যাদের অল্প বয়সে উচ্চ রক্তচাপ শনাক্ত হয়, তাদের রক্তচাপ বেশি থাকার কিছু কারণ দেখা যায়, যার কারণে কারো রক্তচাপ বেড়ে যেতে পারে।কিডনি সমস্যা।রক্তনালী সরু হয়ে গেছে।হরমোন সমস্যা।থাইরয়েড সমস্যা, পিটুইটারি গ্লান্ডের সমস্যা।মস্তিষ্কে কোন সমস্যা থাকলে।স্টেরয়েড গ্রহণের ধারাবাহিকতা থাকলে।

 

উচ্চ রক্তচাপ থেকে বাঁচতে কী করতে হবে
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, উচ্চ রক্তচাপের কারণে প্রতি বছর বিশ্বে প্রায় ৯৪ লাখ মানুষ মারা যান, এবং এটি পৃথিবীতে অসুখে ভুগে মারা যাওয়ার প্রধান কারণ।অধ্যাপক জামান বলেছেন, উচ্চ রক্তচাপের কারণে শরীরের মাথা থেকে পা পর্যন্ত আক্রান্ত হতে পারে।প্রথমেই এ থেকে স্ট্রোক হতে পারে, যা থেকে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হতে পারে। এরকম ক্ষেত্রে রোগীর মৃত্যুর সম্ভাবনা থাকে।

 

স্ট্রোক থেকে অন্ধত্ব, শরীরের বিভিন্ন প্রত্যঙ্গ অবশ হয়ে যাওয়া এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। থেকে হার্ট অ্যাটাক এবং হার্ট ফেইলিওর হতে পারে।এছাড়া উচ্চ রক্তচাপের কারণে কিডনি বিকল হয়ে যেতে পারে।ফলে চিকিৎসকেরা মনে করেন, সতর্ক হওয়া ছাড়া উপায় নেই।

যেসব পদক্ষেপের মাধ্যমে সুস্থ থাকতে পারবেন :

খাবারে আলগা লবণ বাদ দিতে হবে ।ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।শাক-সবজি, ফলমূল বেশি করে খেতে হবে।নিয়মিত কায়িক পরিশ্রম করতে হবে।নিয়মিত রক্তচাপ পরিমাপ করতে হবে।রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।তামাক ও তামাক জাতীয় বস্তু ত্যাগ করতে হবে।পরিমিত ঘুমাতে হবে।স্ট্রেস বা মানসিক চাপ কমাতে হবে।চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ সেবন করতে হবে, চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ খাওয়া বন্ধ করা যাবে না ।

 

উচ্চ রক্তচাপ বিষয়ক গাইডলাইন
বাংলাদেশের সরকারের উচ্চ রক্তচাপ বিষয়ক একটি গাইডলাইন আছে, যাতে কম ওষুধ সেবন করে এবং জীবনযাপন পদ্ধতিতে পরিবর্তন এনে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টাকে উৎসাহিত করা হয়েছে।এই গাইডলাইন তৈরির সাথে ছিলেন অধ্যাপক জামান, তিনি বলেছেন গাইডলাইনের নির্দেশনা অনুযায়ী দেশব্যাপী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে রক্তচাপ পরিমাপের ব্যবস্থা করা হয়েছে।সেইসঙ্গে একটি চার্ট বা টেবিল করে দেয়া হয়েছে, যেখানে উচ্চ রক্তচাপ কত থাকলে কী ব্যবস্থা নিতে হবে, এবং কী ওষুধ খেতে হবে, সেগুলো চিহ্নিত করে দেয়া হয়েছে।

By নিজস্ব প্রতিবেদক

রংপুরের অল্প সময়ে গড়ে ওঠা পপুলার অনলাইন পর্টাল রংপুর ডেইলী যেখানে আমরা আমাদের জীবনের সাথে বাস্তবঘনিষ্ট আপডেট সংবাদ সর্বদা পাবলিশ করি। সর্বদা আপডেট পেতে আমাদের পর্টালটি নিয়মিত ভিজিট করুন।

Related Post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *