ইকরিমা ইবনু আবু জেহেল রা. – এর জীবনী

আবু জেহেল নামটি শুনলেই প্রতিটি মুমিন হৃদয়ে এক সমুদ্র ঘৃণার ঢেউ বয়ে যায়। শত কোটি টাকা দিলেও কেউ নিজ সন্তানের নাম আবু জেহেল রাখতে রাজি হবে না। সম্ভবত কোনো অমুসলিমও না। আবু জেহেল রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের নবুয়ত প্রাপ্তির সূচনা থেকে তার জীবনের অন্তিম নিঃশ্বাস পর্যন্ত প্রাণপণে ইসলামের বিরোধিতা করেছে। মুসলিমদের ওপর চালিয়েছে লোমহর্ষক নির্যাতন। কিন্তু সেই আবু জেহেলের ঘর থেকেই উন্মেষ ঘটে এক মুসলিম তরুণের। তার নাম ইকরামা ইবনু আবু জেহেল।

মক্কার অধিকাংশ সম্ভ্রান্ত যুবক ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করে। ত্যাগ করে নিজেদের জাহিলিয়াতের আভিজাত্য। সেই যুবকদের একজন আবু জেহেলের পুত্র ইকরামা। তবে ইসলামের সূচনার দিকে ইকরামা ছিলেন পিতার মতোই ইসলাম বিদ্বেষী। পিতার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে শুরু থেকেই ইসলামের নাম-নিশানা মুছে ফেলতে সচেষ্ট ছিলেন। মাত্রই অঙ্কুরিত হওয়া ইসলাম নামক পুষ্পকলিকে মিশিয়ে দিতে চেষ্টা করেন মাটির সাথে। বদরের প্রান্তরে পিতা আবু জেহেলের নেতৃত্বে মুসলিমদের বিরুদ্ধে সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নেন। পিতার অন্তিম মূহুর্তের প্রত্যক্ষদর্শী হন ছেলে ইকরামা। অন্তরে জ্বলে ওঠে প্রতিশোধের আগুন। উহুদ যুদ্ধে মুশরিক বাহিনীর ডান পাশের নেতৃত্বে খালিদ বিন ওয়ালিদ, আর বাম পাশে ইকরামা ইবনু আবু জেহেল। মুসলিম বাহিনীর অসতর্কতার সুযোগ নিয়ে তাদেরকে কঠিন পরীক্ষায় ফেলে দেয় মুশরিক বাহিনী। আহত হন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব প্রিয়নবি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম। আবু সুফিয়ানের ভাষায় যা ‘বদরের প্রতিশোধ’। খায়বার যুদ্ধের সময় কাফিররা মদিনা অবরোধ করে রাখে। এক পর্যায়ে একটি সংকীর্ণ রাস্তা দিয়ে মদিনায় প্রবেশের চেষ্টা করে মুশরিক বাহিনীর সদস্য ইকরামা। কিন্তু মুসলিম বাহিনীর কাছে ধরাশায়ী হয়ে কোনোমতে জীবন নিয়ে পালিয়ে যায় সে। হুদায়বিয়ার সন্ধির পর প্রেক্ষাপট পরিবর্তন হতে শুরু করে। আল্লাহ তাআলা মুসলিমদের সব দিক থেকে সমৃদ্ধি দান করেন। দুর্বল হতে থাকে মক্কার কুরাইশরা।

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম মক্কা বিজয়ের জন্য রওনা দিলেন। মুসলিম বাহিনীর সেনাপতি খালিদ বিন ওয়ালিদকে নির্দেশ দেয়া হল কেউ আক্রমণ না করলে মুসলিম বাহিনী যাতে কাউকে আঘাত না করে। পরাজয় সুনিশ্চিত জেনে মক্কাবাসী মুসলিম বাহিনীর মোকাবেলা করার সাহস করল না। কিন্তু কতিপয় যুবক ইকরামা ইবনু আবু জেহেলের নেতৃত্বে মুসলিমদের বাধা প্রদানের চেষ্টা করে। খালিদ বিন ওয়ালিদের সুনিপুণ দক্ষতায় তারা পরাজিত হয়। মক্কা বিজয়ের পর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম সবার জন্য সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন। কিন্তু কিছু সংখ্যক ব্যক্তির ব্যাপারে তিনি বলেন,

তারা কাবার গিলাফের মধ্যে লুকালেও তাদেরকে হত্যা করা হবে। ইকরামা ছিলেন তাদের অন্তর্ভুক্ত।

তাই তিনি পালিয়ে ইয়েমেনের দিকে পথ ধরেন। এ সময় আবু সুফিয়ান এর স্ত্রী হিন্দার নেতৃত্বে এক দল কুরাইশ নারী রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম এর নিকট ইসলাম গ্রহণ করেন। তাদের মধ্যে ছিলেন ইকরামার স্ত্রী উম্মু হাকিম। তিনি সুযোগ পেয়ে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম এর নিকট নিজ স্বামীর জন্য নিরাপত্তা কামনা করেন। মহান হৃদয়ের অধিকারী রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম তার আবেদন গ্রহণ করেন। উম্মু হাকিম ইকরামার কাছে গিয়ে জানালেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম তাকে নিরাপত্তা দান করেছেন। স্বামীকে বললেন, আমি পৃথিবীর সবচেয়ে নিষ্পাপ আর পবিত্র ব্যক্তির কাছ থেকে তোমার জন্য নিরাপত্তার চাদর নিয়ে এসেছি।

প্রথমে বিশ্বাস করতে না চাইলেও পরবর্তীতে স্ত্রীর কথায় আশ্বস্ত হয়ে তিনি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের সাথে দেখা করার জন্য রাজি হন। পথিমধ্যে রাত্রিযাপনকালে ইকরামা স্ত্রীর সাথে মিলিত হতে চাইলে উম্মু হাকিম রা. অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেন। তিনি বলেন, তুমি মুশরিক আর আমি মুসলিম। তুমি আমার জন্য হালাল নও। ইকরামা বিস্মিত হয়ে বললেন, তোমার আর আমার মিলনে যে বিষয় বাধা হতে পারে তা নিঃসন্দেহে একটা সুবিশাল বিষয়।

পর দিন তারা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের নিকট হাজির হওয়ার জন্য রওনা দেন। ইকরামা মক্কার নিকট এসে পৌঁছাতেই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বলেন – “কিছুক্ষণের মধ্যেই ইকরামা ইবনু আবু জেহেল মুমিন ও মুহাজির হিসেবে তোমাদের মধ্যে উপস্থিত হবে। তোমরা তার পিতাকে মন্দ বল না বা গালি দিও না। কেন না মৃতব্যক্তিকে গালি দিলে জীবিতরা কষ্ট পায়। অথচ মৃত ব্যক্তি তা শুনতে পায় না।”

কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা এসে হাজির হলেন। ইকরামা বললেন – ইয়া রাসুলুল্লাহ, উম্মু হাকিম বলেছে আপনি আমাকে নিরাপত্তা প্রদান করেছেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম সম্মতি সূচক ইঙ্গিত করলেন।

ইকরামা বললেন, “আপনি আমাকে কিসের দিকে আহ্বান করেন?”

“আমি তোমাকে এই সাক্ষ্য দিতে আহ্বান করছি যে আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই। আমি আল্লাহর বান্দা ও মনোনিত রাসুল। আর সালাত কায়েম করবে ও জাকাত প্রদান করবে।”

এভাবে তিনি এক এক করে ইসলামের সবগুলো রুকন উল্লেখ করেন।

ইকরামা বলেন – আল্লাহর শপথ! আপনি আমাকে ন্যায় ও সত্য ছাড়া আর কিছুর দিকেই আহ্বান জানাননি। এবং উত্তম কাজ ছাড়া অন্য কিছুর নির্দেশও দেননি।

অতঃপর রচিত হয় ইতিহাসের এক নতুন অধ্যায়। সারা জীবন ইসলামের বিরোধিতা করা ইকরামা তাওহিদ ও রিসালাতের সাক্ষ্য প্রদান করেন। এবং নিজেকে একজন মুসলিম মুজাহিদ ও মুহাজির হিসেবে ঘোষণা করেন। দলভুক্ত হয়ে যান মুসলিম ইতিহাসের সবচেয়ে পরিশুদ্ধ ও সোনালি মানুষদের দলে।

ইসলাম গ্রহণের পর ইকরামা রা. বলেন – আমি এত দিন ইসলামের বিরুদ্ধে যত কিছু ব্যয় করেছি এখন থেকে ইসলামের পথে তার দ্বিগুণ করব। ইসলামের বিরুদ্ধে যতগুলো যুদ্ধ করেছি, এখন থেকে ইসলামের বিজয়ের জন্য তার দ্বিগুণ যুদ্ধ করব।

এরপর থেকে এমন কোনো মুসলিম বাহিনী প্রেরণ করা হয় নি যার সম্মুখ ভাগে ইকরামা রা. ছিলেন না। তিনি সর্বদা কুরআন তিলাওয়াত ও নেক আমলে ব্যস্ত থাকতেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের সাথে করা ওয়াদা সম্পূর্ণ রূপে বাস্তবায়ন করেন তিনি। ইয়ারমুকের যুদ্ধে যখন ক্ষণিকের জন্য মুসলিম বাহিনী কোণঠাসা হয়ে পড়ে তখন ইকরামা রা. দ্রুতগামী ঘোড়া থেকে নেমে নিজ তলোয়ারের কোষ ভেঙ্গে ফেলেন, যাতে আর কখনো তা কোষবদ্ধ না হয়। আক্রমণ করতে করতে শত্রুবাহিনীর ভেতরে ঢুকতে থাকেন। এ অবস্থা দেখে খালিদ বিন ওয়ালিদ রা. তাকে তা করতে বারণ করেন।

তিনি জবাবে বলেন – আপনি তো আমার আগেই ইসলাম গ্রহণ করেছেন। ইসলামের জন্য অনেক যুদ্ধ করেছেন। কিন্তু আমি ইসলামের বিরোধিতায় লিপ্ত ছিলাম। আমাকে বাধা দিবেন না। আমি আমার অতীতের কাফফারা আদায় করতে চাই।

অতঃপর এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে রোমানদের পরাজয় ঘটে। উড্ডিন হয় কালিমার পতাকা। এই যুদ্ধে শাহাদাতের অমীয় শুধা পান করে ওপারে পাড়ি জমান ইকরামা ইবনু আবু জেহেল রা.। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এ মহান সাহাবিকে জান্নাতের সর্বোচ্চ মাকাম দান করুন। আমিন।

 

 

Leave a Comment