আর আমি মূসার মায়ের প্রতি নির্দেশ পাঠালাম, ‘তুমি তাকে দুধ পান করাও। অতঃপর যখন তুমি তার ব্যাপারে আশঙ্কা করবে, তখন তাকে দরিয়ায় নিক্ষেপ করবে। আর তুমি ভয় করবে না এবং চিন্তা করবে না। নিশ্চয় আমি তাকে তোমার কাছে ফিরিয়ে দেব এবং তাকে রাসূলদের অন্তর্ভুক্ত করব’। অতঃপর ফির‘আউনের লোকজন তাকে কুড়িয়ে নিল। এর পরিণামতো এই ছিল যে, সে তাদের শত্রু ও দুঃখের কারণ হবে। ফির‘আউন, হামান ও তাদের বাহিনী ছিল অপরাধী। আর ফির‘আউনের স্ত্রী বলল, ‘এ শিশুটি আমার ও তোমার চক্ষু শীতলকারী, তাকে হত্যা করো না। আশা করা যায়, সে আমাদের কোন উপকারে আসবে। অথবা আমরা তাকে সন্তান হিসেবে গ্রহণ করতে পারি’। অথচ তারা উপলব্ধি করতে পারেনি। আর মূসার মায়ের অন্তর বিচলিত হয়ে উঠেছিল। সে তো তার পরিচয় প্রকাশ করেই দিত, যদি আমি তার অন্তরকে দৃঢ় করে না দিতাম, যাতে সে আস্থাশীলদের অন্তর্ভুক্ত হয়। (সূরা কাসাস ২৮:৭-১০)
মুসা (আ.) এর মায়ের অন্তর বিচলিত হয়ে উঠেছিল যখন তিনি জানতে পারেন তার পুত্র ফিরআউনের হাতে। তিনি পারলে ফিরআউনের দরজায় গিয়ে নক করেন তার পুত্রকে ফিরে পাবার জন্য। মুসা (আ.) তার নিজের বাড়িতে বড় হন নি বরং বড় হয়েছেন ফিরআউনের ঘরে, যে নিজেকে স্রষ্টা বলে দাবি করত। সেখানে তার মায়ের ভূমিকা পালন করেন আসিয়া (আ.)।
ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিতঃ রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, জান্নাতের নারীদের মধ্যে থেকে শ্রেষ্ঠ হচ্ছেন খাদিজা বিনতে খুয়াইলিদ, ফাতিমা বিনতে মুহাম্মদ, মারইয়াম বিনতে ‘ইমরান এবং ‘আসিয়াহ বিনতে মুজাহিম, ফেরাউনের স্ত্রী।’ [মুসনাদে আহমাদ ২৮৯৬, আল-আলবানি সহীহ বলেছেন]
আসিয়া (আ.) মুসা (আ.) এর সময়ে বাস করতেন। সেসময়ে ফেরাউনদের রাজত্ব মিশরজুড়ে প্রতিষ্ঠিত ছিল। তার পরিপার্শ্বের অবস্থা ছিল ভয়ানকভাবে পাপ, কুফর ও শিরকে পূর্ণ। আর তার স্বামী? তার স্বামী ছিল এমন একজন যে বলতঃ ‘আমিই তোমাদের রব, আমিই সর্বশ্রেষ্ঠ।’ সে বনী ইসরাঈলদের সন্তানদের জড় করে বলত, ‘মিশরের রাজত্ব কি আমার অধীনে নয়? আমার কাছ দিয়ে যে নহর বয়ে যাচ্ছে তা কি তোমরা দেখতে পাও না?’ পৃথিবীর চারজন শ্রেষ্ঠ নারীর স্বামী হচ্ছেন এমন নিকৃষ্ট এক লোক।
মুসা (আ.) কে বহনকারী ঝুড়িটি যখন নদীর পাড়ে পৌঁছে গেল তখন আসিয়া (আ.) সেটা দেখে ফিরআউনের নিকট নিয়ে গেলেন। তিনি ফিরআউনকে বললেন, ‘এই বাচ্চাটি আমার ও আপনার চক্ষু শীতলকারী হবে।’ ফিরআউন জবাব দিলঃ ‘না, সে শুধু তোমারই আরাম ও চক্ষু শীতলের কারণ হবে।’ আসিয়া (আ.) ফিরআউনের কাছে আত্মসমর্থন করে বললেন, ‘সে হয়ত আমাদের উপকারে আসবে অথবা আমরা তাকে সন্তান হিসেবে গ্রহণ করতে পারি।’ এরপরেই আল্লাহ বলেন, তারা কিছুই উপলব্ধি করতে পারেনি, অর্থাৎ তাদের ধারণাও ছিল না মুসা (আ.) বড় হয়ে কি ঘটাতে যাচ্ছেন।
আসিয়া (আ.) মুসা (আ.) কে প্রথমবার দেখার সাথে সাথেই শিশুটিকে ভালোবেসে ফেলেন। তার কাছে এই শিশুটা আরো বিশেষত্ব অর্জন করেছিল কারণ তার কোন সন্তান ছিল না।
মুসা (আ.) ফিরআউনের প্রাসাদে বড় হতে লাগলেন, আসিয়া (আ.) ও তার সাহচর্যে নিজেকে বিলীন করে দিলেন যেন সন্তানটা তারই গর্ভজাত। এরপরে তিনি মুসা (আ.) এর মাকে নিজের অজান্তেই মুসা (আ.) এর সেবাকারিণী হিসেবে নিয়োগ দিলেন।
মুসা (আ.) ও আসিয়া (আ.) এর মধ্যে প্রাসাদে কি হয়েছে তা আমরা জানি না। এর পরবর্তীতে মুসা (আ.) কর্তৃক ভুলবশত একটি মানুষকে হত্যার ঘটনা সামনে আসে। তিনি এরপরে পালিয়ে যান মাদইয়ান নামক একটি অঞ্চলে। আসিয়া (আ.) তার পালক পুত্রকে তখনই হারিয়ে ফেলেন। দশ বছর পর মুসা (আ.) আবার ফিরে আসেন। ফিরে এসেই তিনি মানুষকে আল্লাহর দ্বীনের পথে ডাকছিলেন, সত্যের পথে ডাকছিলেন।
মুসা (আ.) ফিরআউনের সম্প্রদায়কে আল্লাহর পথে আসার আমন্ত্রন জানালেন, তাদেরকে আল্লাহর নিদর্শন দেখালেন। কিন্তু ফিরআউন তার ঐদ্ধত্য ও অহংকারের কারণে সে তার মানুষের জন্য বিশাল জমায়েতের আয়োজন করল এবং সবার উপস্থিতিতে বলল, ‘আমি জানি না যে আমি ছাড়া তোমাদের আর কোন উপাস্য আছে।’ (সূরা আল কাসাস ২৮:৩৮)
এবার কল্পনা করুন আসিয়া (আ.) কি বিপদসংকুল পরিস্থিতিতে পতিত হয়েছেন। তিনি এমন এক লোকের সাথে বাস করছেন যে নিজেকে খোদা দাবি করে, আবার তার সাথে থাকার জন্য তিনি তার স্বামীর ত্রুটি বিচ্যুতি সম্পর্কেও অবগত।
মুসা (আ.) ফিরআউনের বিরুদ্ধে গিয়ে মানুষকে তাওহীদের ডাক দেন। কিন্তু ফিরআউনও একা নয়, তার সাপোর্ট হিসেবে রয়েছে কিছু জাদুকর। সে মানুষের কাছে নিজের স্রষ্টা হবার দাবিকে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে পেরেছিল এই জাদুকরদের বদৌলতে। ফিরআউন মুসা (আ.) এর সাথে কথোপকথনে বলেন, ‘হে মুসা! তুমি কি আমাদের জাদুর জোরে আমাদের দেশ থেকে বহিষ্কার করতে এসেছ?’ (সূরা ত্বহা ২০:৫৭)
ফিরআউন ভয় পাচ্ছিলেন তার কর্তৃত্ব চলে যাবে, তিনি তার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলবেন। যাইহোক, তিনি মুসা (আ.) এর সাথে একটা দিনক্ষণ ঠিক করলেন যেখানে মুসা (আ.) ও তার সাপোর্ট হিসেবে কাজ করা জাদুকররা মুখোমুখি হবে।
‘তাহলে আমরা অবশ্যই তোমার নিকট অনুরূপ যাদু নিয়ে আসব। সুতরাং একটা মধ্যবর্তী স্থানে আমাদের ও তোমার মিলিত হওয়ার জন্য একটি সময় নির্ধারণ কর, যা আমরাও লঙ্ঘন করব না, তুমিও করবে না’। (সূরা ত্বহা ২০:৫৮)
সেদিন সকল মানুষ প্রাতেই জড় হয়ে গেল।
তারা বলল, হে মূসা, হয় তুমি নিক্ষেপ কর, না হয় আমরাই প্রথমে নিক্ষেপ করি। মূসা বলল, ‘বরং তোমরাই নিক্ষেপ কর। অতঃপর তাদের যাদুর প্রভাবে মূসার কাছে মনে হল যেন তাদের রশি ও লাঠিগুলো ছুটোছুটি করছে। তখন মূসা তার অন্তরে কিছুটা ভীতি অনুভব করল। আমি বললাম, ‘ভয় করো না; নিশ্চয় তুমিই প্রবল। ‘আর তোমার ডান হাতে যা আছে, তা ফেলে দাও। তারা যা করেছে, এটা সেগুলো গ্রাস করে ফেলবে। তারা যা করেছে, তাতো কেবল যাদুকরের কৌশল। আর যাদুকর যেখানেই আসুক না কেন, সে সফল হবে না’। (সূরা ত্বহা ২০: ৬৬-৬৯)
তারা সকলেই দেখল মুসার লাঠি সাপে পরিণত হয়ে অন্যদের লাঠিকে গিলে খাচ্ছে। তারা সকলেই এই ঘটনাটি দেখল, আসিয়া (আ.) সহ।
আল্লাহ বলেন, অতঃপর যাদুকরেরা সিজদায় লুটিয়ে পড়ল। তারা বলল, ‘আমরা হারূন ও মূসার রবের প্রতি ঈমান আনলাম’। ফির‘আউন বলল, ‘কী, আমি তোমাদেরকে অনুমতি দেয়ার আগেই তোমরা তার প্রতি ঈমান আনলে? (সূরা ত্বহা ২০:৭০-৭১)
যাদুকরেরা বলল, ‘আমাদের নিকট যে সকল স্পষ্ট নিদর্শন এসেছে এবং যিনি আমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন, তার উপর আমরা তোমাকে কিছুতেই প্রাধান্য দেব না। সুতরাং তুমি যা ফয়সালা করতে চাও, তাই করো। তুমিতো কেবল এ দুনিয়ার জীবনের উপর কর্তৃত্ব করতে পার’। (সূরা ত্বহা ২০ঃ৭২)
আসিয়া (আ.) সাথে সাথেই মুসা (আ.) এর রবের প্রতি ঈমান এনেছিলেন। তিনি তাওহিদে বিশ্বাস স্থাপন করেন এবং ব্যক্তিগত পর্যায়ে আল্লাহর দ্বীন চর্চা করতে থাকেন যেন ফিরআউন বুঝতে না পারে তিনি একত্ববাদে বিশ্বাস করছেন। কেন? কারণ, যদি ফিরআউন দেখে তার নিজের স্ত্রীই মুসা (আ) এর দ্বীনের প্রতি ঈমান এনেছে তাহলে সে কতটা প্রতারিত অনুভব করবে?
সময় এগোতে থাকে এবং একপর্যায়ে একটি ঘটনাই আসিয়া (আ.) এর ইসলাম গ্রহণের ব্যাপারটি প্রকাশ করে দেয়। এর পিছনে কারণ ছিল ফিরআউনের মেয়ের চুলের আঁচড়ে দিত যে মেয়েটা সেই। সেও মুসলিম হয়ে গিয়েছিল যদিও প্রকাশ্যে নয়, অন্যান্যদের ক্ষেত্রেই একই ব্যাপার। একদিন সেই মেয়েটিই ফিরআউনের মেয়ের চুল আঁচড়ে দিচ্ছিল। তার হাত থেকে চিরুনি পড়ে যায়। সে চিরুনি তুলতে নিচু হয়। তুলার সময় সে মনের অজান্তেই বলে ফেলে, ‘বিসমিল্লাহ অর্থাৎ মহান আল্লাহর নামে।’ সে চিরুনি তুলে নিল এবং এই ব্যাপারটিও ভুলে গেল।
কিন্তু কেউ একজন শুনে ফেলেছে। ফিরআউনের মেয়ে। সে বলল, ‘তুমি কি বললে?’ মেয়েটি জবাব দিল, ‘আমি বিসমিল্লাহ বলেছি।’ ফিরআউনের মেয়ে বলল, ‘এর দ্বারা কি আমার বাবার কথা বোঝাচ্ছ?’ তখন মেয়েটি বলল, ‘না, আমি বরং আল্লাহকে বুঝিয়েছি। যিনি আমার, আপনার এবং বিশ্বজগতের সবার রব্ব।’ ফিরআউনের মেয়ে তার বাবাকে ঘটনাটি বলবে বলে হুমকি দিল। কিন্তু এতে মেয়েটি দমে গেল না। সাহসী মেয়েটি বলল, ‘যান, গিয়ে আপনার বাবাকে বলুন।’
তাকে ফিরআউনের সামনে হাজির করা হল। তার চারপাশের জায়গা সৈন্য-সামন্ত বেষ্টিত। তার নাম মা’শিতাহ ছিল। ফেরআউন তাকে বলল, ‘আমি ছাড়া কি তোমার আর কোনো রব আছে?’ তখন মেয়েটি বলল, ‘অবশ্যই যিনি আমার, আপনার এবং বিশ্বজগতের সবার রব্ব।’
ফিরআউন জানত একজন মায়ের জন্য সবচেয়ে কষ্টকর অভিজ্ঞতা হচ্ছে যখন তার সন্তানেরা বিপদন্মুখ হয়। তাই তিনি তার সৈন্যদের বললেন, ‘যাও তার সন্তানদের নিয়ে এসো।’ তারা তার ঘরে প্রবেশ করে ক্রন্দনরত শিশুদের হাজির করল ফিরআউনের সামনে। শিশুরা তাদের মায়ের জন্য কাঁদছিল। আর তাদের মাকে আটকে রেখেছে ফিরআউন। তারা তাদের মায়ের দিকে করূণভাবে তাকাল। তারা কি করতে পারবে এই অসহায় পরিস্থিতিতে? কিভাবে তারা তাদের মাকে এই করুণ অবস্থা থেকে উদ্ধার করতে পারে? তাদের কান্নায় নিশ্চয়ই তাদের মায়ের অন্তর কষ্টে উদ্বেলিত হয়েছিল। পরিস্থিতি ভারি হয়ে উঠেছে, প্রত্যেকে একে অপরের দিকে তাকাচ্ছে। তিনি যা বলেছেন তা যদি ফিরিয়ে নেন তাহলেই তিনি এই বিপদ থেকে মুক্তি পেয়ে যান। কিন্তু তিনি যে আল্লাহকে ভালবাসেন।
রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যখন মিরাজের ভ্রমণে যান তখন সপ্তম আসমানে থাকা অবস্থায় তিনি এক অভূতপূর্ব সুঘ্রাণ অনুভব করেন। তিনি জিবরাইল (আ.) কে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এই সুগন্ধ আসছে কোথা থেকে?’ জিবরাইল (আ.) জবাব দিলেন, ‘ওটা মাশিতাহ এর ঘ্রাণ যে ফিরআউনের অধীনে থেকে তার মেয়ের চুল আঁচড়ে দিত।’
সে সময়ে আসিয়া (আ.) তার স্বামীর নিকৃষ্টটা এবং সেই মেয়ের সাহসিকতা অবলোকন করেন। তার অন্তরে অনুভূত হয়, ‘যদি সেই মেয়েটি সাহসিকতার সাথে ফিরআউনের বিরুদ্ধে দাড়িয়ে যেতে পারে তাহলে আমিও দাঁড়াব তার পাশে।’ তিনি ফিরআউন এর কাছে যেয়ে বললেন, ‘হে ফিরআউন! আমিও আপনার উপর অবিশ্বাস স্থাপন করেছি। আমার কোন যায় আসে না আপনি কি করেন এতে। আমি মুসা, হারুণ এবং বিশ্বের সকল কিছুর রবের প্রতি ইমান এনেছি।’
ফিরআউন ক্রোধান্বিত হলেন কিন্তু সাথে সাথেই তার স্ত্রীকে মেরে ফেললেন না কারণ সেটা ভুল সিদ্ধান্ত হত আর আসিয়া (আ.) রাজপরিবারের সদস্য ছিলেন। তিনি প্রথমে তার সাথে কথা বলবেন তারপরে তার উপর চড়াও হবেন।
আসিয়া (আ.) এর প্রাসাদ ছিল, অফুরান খাবার ছিল, ছিল না কাপড়-চোপড়ের অভাব কিন্তু এই সবকিছুকে ত্যাগ করলেন কেবলই আল্লাহর জন্য। তিনি সকল বিশ্বাসী নারী-পুরুষের জন্য উদাহরণ হয়ে যান কিয়ামত অবধি। ফিরআউন আসিয়া (আ.) কে নির্যাতন করেন, তার ক্ষতি করেন কিন্তু তিনি সহ্য করে যান, ধৈর্য্যধারণ করেন। ফিরআউন হুমকি দিতেনঃ ‘আমি তোমাকে প্রাসাদ থেকে বিতাড়িত করব। তোমাকে কঠোর শাস্তি দিব।’ কিন্তু তিনি দৃঢ় ভাবে জবাব দিতেন, ‘আপনার যা ইচ্ছা করুন।’
ফিরআউন তাকে মরূভূমিতে টেনে নিয়ে যান, সেখানে তাকে বেঁধে রাখেন খাদ্য বঞ্চিত করে, তৃষ্ণার্ত করে। তার মর্যাদাকে মানুষের সামনে ভূলুন্ঠিত করেন। ফিরআউনের মেয়েরা ও স্ত্রীরা তার দিকে তাকিয়ে হাসত। তার সাপোর্ট হিসেবে কিছু ছিল না, ছিল না এমন কোন মানুষ যে তাকে রক্ষা করতে আসবে কারণ মুসা (আ.) ও সেখানে ছিলেন না। এরূপ পরিস্থিতিতে তিনি আকাশের দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘হে আমার রব, আপনার কাছে আমার জন্য জান্নাতে একটি বাড়ি নির্মাণ করুন এবং আমাকে ফির‘আউন ও তার কর্ম হতে নাজাত দিন, আর আমাকে নাজাত দিন যালিম সম্প্রদায় হতে।’ (সূরা আত তাহরিম ৬৬:১১)
আল্লাহ তার জন্য আকাশকে খুলে দেন, তিনি পৃথিবীতে থেকেই জান্নাতে তার প্রাসাদকে দেখতে পান যা তার মুখে প্রশান্তির হাসি ফুটিয়ে তুলে। ফিরআউন তার সৈন্যদেরকে বলে, ‘দেখেছ মহিলাটা কেমন পাগল!’ কিন্তু এরপরেও তিনি হাসতেই থাকলেন, হাসতেই থাকলেন যতক্ষণ না ফিরআউন বিরক্ত হয়ে যায় এবং আদেশ দেয়, ‘একদম সর্বোচ্চ চূড়া থেকে পাথর ঠেলে দিবে যেন তা তার দেহকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে।’ কিন্তু আল্লাহ ফেরাউনকে তার স্ত্রীর মৃত্যূ দেখে আনন্দ নেয়ার সুযোগ দিলেন না। পাথর তাকে আঘাত করার পূর্বেই তার আত্মাকে তার কাছে নিয়ে নিলেন।
একজন নারী দুনিয়ায় যা যা চাইতে পারে তার সবকিছু আসিয়া (আ.) এর নিকটে ছিল। কাপড়, জুতো, স্বর্ণ যাই হোক না কেন। কিন্তু দ্বীনের কারণে তিনি সব ত্যাগ করেন। আমরা তো দ্বীনের খাতিতে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জিনিসও ত্যাগ করতে রাজি হই না কিন্তু এরপরেও আমরা নিজেদের জন্য জান্নাত আশা করি, আমরা মনে করি মারা গেলেই তো চলে যাব জান্নাতে। কিন্তু বাস্তবতা তো তা নয়।
শেষ করার আগে তার সম্পর্কে কিছু পয়েন্ট উল্লেখ করা যাক।
প্রথমত, তার অন্তর ছিল নূরের আলোয় পরিপূর্ণ। সেই অন্তর লুকোনো বিষয়ের ভেতর থেকেও সত্যকে আলোয় টেনে আনতে পারত। তিনি ফিরআউনের ষড়যন্ত্রকে খুব ভালোভাবেই ধরতে পেরেছিলেন যা অনেকের কাছেই ছিল দূর্বোধ্য।
দ্বিতীয়ত, আসিয়া (আ.) এর পারিপার্শ্বিক অবস্থা তার উপর প্রভাব ফেলেনি। তিনি এমন একজনের বাড়িতে ছিলেন যে নিজেকে স্রষ্টা দাবি করত। কিন্তু তিনি আল্লাহর উপরেই ভরসা স্থাপন করেছিলেন, নিজেকে রেখেছিলেন সচ্চরিত্রা ও পবিত্রা। তিনি যদি তার অবস্থায় থেকে আল্লাহর আনুগত্য করতে পারেন তাহলে আমরা কিসের অজুহাত দাঁড়া করাই? কেন আমরা আল্লাহর আনুগত্য ও ভালোবাসা থেকে নিজেদের দূরে রাখি?
তৃতীয়ত, তিনি সাহসী ও দৃঢ় সংকল্পের অধিকারী ছিলেন। এই গুণ তাকে আল্লাহর নৈকট্য এনে দিয়েছিল, আল্লাহকে জানতে সাহায্য করেছিল।
চতুর্থত, তিনি আখিরাতকে দুনিয়ার উপরে প্রাধান্য দিয়েছিলেন। যদিও
তার সামনে দুনিয়াবি অগনিত ফিতনা ছিল, ফাঁদ ছিল, দুনিয়ার সকল শ্রেষ্ঠ জিনিস ছিল কিন্তু এরপরেও তিনি এসবের ফাঁদ থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে সমর্থ হন।
আমাদের নিজেদের প্রশ্ন করা উচিত, আমরা কি দুনিয়ার এই চাকচিক্য ও মোহ থেকে নিজেদের দূরে রাখতে পেরেছি? আমরা কি কসমেটিক, টেক ও অন্যান্য বিলাসবহুল সামগ্রীর ফাঁদে নিজেদের জড়িয়ে ফেলিনি আষ্টেপৃষ্ঠে?