আবু লুবাবা রা.
মদিনার বিখ্যাত আউস গোত্রের বনু আমর বিন আউফ শাখার সন্তান হজরত আবু লুবাবা রা.।তিনি আকাবার শেষ বাইয়াতে অংশগ্রহণ করেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের ওপর ইমানের ঘোষণা দিয়ে নিজ গোত্রের নাকীব (দায়িত্বশীল) মনোনিত হন। বদর যুদ্ধের যাত্রাকালে প্রতিটি উটের ওপর তিনজন করে আরোহী ছিল। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের উটের ওপর আরোহনের সৌভাগ্য লাভ করেছিলেন আবু লুবাবা ও আলি ইবনু আবি তালিব রা.। তবে পথিমধ্যে আবু লুবাবাকে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম নিজের অনুপস্থিতিতে মদিনার প্রশাসকের দায়িত্ব দিয়ে যুদ্ধ থেকে ফেরত পাঠান। বদর যুদ্ধের সম্মুখ সমরে অংশ নিতে না পারায় তাঁর আফসোস হয়। নবিজি তাকে বদরে অংশগ্রহণকারী সাহাবি হিসেবে মর্যাদা দেন এবং গণিমতের অংশ দেন।
খন্দক যুদ্ধে বনু কুরায়জা মুসলিমদের সাথে কৃত সন্ধিচুক্তি ভঙ্গ করে কুরাইশদের সহযোগিতা করার অপরাধে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম তাদেরকে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেন। ইয়াহুদিরা বিভিন্ন ছলচাতুরির পরও কোনো উপায়ান্তর না পেয়ে অবরুদ্ধ অবস্থায় রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের নিকট গোত্রের বনু আমর ইবনু আউফ শাখার আবু লুবাবা রা.-এর সাথে পরামর্শ করার অনুমতি চায়। উল্লেখ্য, বনু আমর ইবনু আউফের সাথে জাহেলি যুগ থেকেই বনু কুরাইজার মৈত্রী চুক্তি ছিল। আবু লুবাবা ছিলেন এ গোত্রেরই লোক। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম তাদের আবেদন মঞ্জুর করেন এবং আবু লুবাবা রা.-কে তাদের কাছে যাওয়ার অনুমতি দেন। আবু লুবাবা বনু কুরাইজায় পৌঁছলে ইয়াহুদি নারী-পুরুষ ও শিশুরা কাঁদতে কাঁদতে দিশেহারার মতো তাঁর সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল। দৃশ্যটি ছিল সত্যিই হৃদয়বিদারক। তারা আবু লুবাবাকে প্রশ্ন করে, “আমরা কি মুহাম্মাদ [সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের] নির্দেশ মেনে নেব?” তিনি তাদেরকে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের নির্দেশ মেনে নিতে বলেন। এবং তাদের বিশ্বাসঘাতকতার অপরাধে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম তাদেরকে হত্যা করবেন সেদিকেও ইঙ্গিত করেন। হজরত আবু লুবাবা রা. ঠিক পরক্ষণেই নবিজির গোপন সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে তিনি যে আমানতের খেয়ানত করেছেন সেটা বুঝতে পারেন। তাই সেখান থেকে সোজা মসজিদে নববিতে চলে যান এবং একটা মোটা ও ভারী বেড়ি দিয়ে নিজেকে মসজিদের খুঁটির সাথে বেঁধে ফেলেন। তিনি বলেন, “যতক্ষণ না আল্লাহ আমার তাওবা কবুল করবেন ততক্ষণ অবধি এখানে বাঁধা থাকব।” সাহাবিরা তাকে বেড়ি খুলে তাওবা করার পরামর্শ দিলেও তিনি নিজ সিদ্ধান্তে অবিচল থাকেন। এভাবে দশরাত মতান্তরে বিশ রাত অতিক্রান্ত হয়। এদিকে তিনি খাওয়া-দাওয়া, পানাহার একেবারেই ছেড়ে দেন। তার শ্রবণ শক্তি কমে যায়, দৃষ্টি শক্তি ক্ষীণ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়তেন। তবুও নিজেকে বাঁধন মুক্ত করলেন না, শুধু নামাজ ও অন্যান্য জরুরি প্রয়োজনের সময় তাঁর স্ত্রী বেড়ী খুলে দিতেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম আবু লুবাবার ব্যাপারে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের নির্দেশের অপেক্ষায় রইলেন। তখন শেষ রাত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম উম্মুল মুমিনিন হজরত উম্মু সালামা রা.-এর ঘরে। প্রভাতের আগেই আয়াত নাজিল হল,
وَ اٰخَرُوۡنَ اعۡتَرَفُوۡا بِذُنُوۡبِهِمۡ خَلَطُوۡا عَمَلًا صَالِحًا وَّ اٰخَرَ سَیِّئًا ؕ عَسَی اللّٰهُ اَنۡ یَّتُوۡبَ عَلَیۡهِمۡ ؕ اِنَّ اللّٰهَ غَفُوۡرٌ رَّحِیۡمٌ ﴿۱۰۲﴾
আর অন্য কতক লোক তাদের অপরাধ স্বীকার করেছে, তারা একটি সৎ কাজের সাথে আরেকটি মন্দ কাজকে মিশ্রিত করেছে, আশা করা যায় আল্লাহ তাদের তাওবা কবুল করবেন, অবশ্যই আল্লাহ অতি ক্ষমাশীল, অতীব দয়ালু। [সুরা তাওবাঃ ১০২]
আয়াত নাজিলের পরপরই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম একটু হেসে ওঠেন। তা দেখে উম্মু সালামা রা. বলেন, ইয়া রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম, আল্লাহ আপনাকে সবসময় খুশী রাখুন। বলুন তো কি ব্যাপার?
তিনি বললেন, আবু লুবাবার তাওবা কবুল হয়েছে। অতঃপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম নিজে ফজর সালাত শেষে আবু লুবাবার বাঁধন খুলে দিলেন। হজরত আবু লুবাবার চেহারা খুশিতে ভরে উঠলো। তিনি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম নিকট এসে বললেন, “ইয়া রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম, আমি ওই বাড়ি ত্যাগ করতে চাই যেখানে আমি এ পাপে লিপ্ত হয়েছি। আমি আমার সকল সম্পদ আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম – জন্য সাদাকা করে দিতে চাই।”
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বললেন, সব নয় বরং এক-তৃতীয়াংশ সাদাকাই যথেষ্ট।
তিনি এক-তৃতীয়াংশই দান করে দেন।
নবিজির প্রিয় সাহাবি আবু লুবাবা রা. শুধুমাত্র আল্লাহ ও তাঁর রাসুল রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম এর মহব্বতে তার জীবন ও সম্পদ উৎসর্গ করে দেন। এমন সৌভাগ্য কয়জনের হয়? যাদের এ সৌভাগ্য হয় তারাই তো দুনিয়া আখিরাতে জ্যেতির মতো সুরভী ছড়ায়।
জায়িদ ইবনু সাবিত রা.
জায়িদ ইবনু সাবিত রা.। মাত্র ১১ বছরের কিশোর। তিনি ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী। মাত্র ১১ বছর বয়সে ১৭টি সুরা হিফজ করেছিলেন। কুরআনের যেটুকু পড়তেন, তা সবই মুখস্থ রাখতে পারতেন।
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম হিজরত করে মদিনায় পা রাখার পরই মদিনার মানুষ জায়িদকে সাথে করে নিয়ে যায় নবিজির দরবারে। নবিজি তাকে দেখেই বুঝে গেলেন, এ এক অসাধারণ মেধাবী কিশোর। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম মদিনায় থাকাকালে প্রতিদিনই তার কাছে বিভিন্ন এলাকা থেকে চিঠিপত্র আসতে থাকে। এর মধ্যে ছিল পার্শ্ববর্তী দেশ ও এলাকার রাজা-বাদশা, গোত্রপতি, আমির-উমরাহদের চিঠি।
অধিকাংশ চিঠির ভাষাই ছিল সুরইয়ানি ও ইবরানি (হিব্রু)। মদিনায় তখন এই দুটি ভাষা জানত কেবল ইয়াহুদিরা। কিন্তু ইয়াহুদিরা কখনই মুসলিমদের ভালো চোখে দেখত না। বরং দুশমনি করাই ছিল তাদের প্রধানতম কাজ। মদিনার মুসলিমরাও এ দুটি ভাষা জানত না। ফলে বেশ সমস্যা দেখা দিল। কি করা যায়? ভাবছেন রাসুল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম।
হঠাৎ তিনি ডাকলেন জায়িদ ইবনু সাবিতকে। কাছে ডেকে নিয়ে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম জায়িদকে বললেন ভাষা দুটি শিখে নেওয়ার জন্য। জায়িদ রা. বলেন, “নির্দেশ পেয়ে আমি হিব্রু ভাষা শিখলাম। মাত্র দুই সপ্তাহের মধ্যে এতে দক্ষতা অর্জন করে ফেললাম। তারপর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের ইয়াহুদিদেরকে কিছু লেখার দরকার হলে আমিই লিখতাম এবং তারা কিছু লিখলে আমিই পাঠ করে শুনাতাম।”
এই দক্ষতা অর্জনের জন্য রাসুল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম যাবতীয় লেখালেখির দায়িত্ব অর্পণ করেন জায়িদের ওপর। জায়িদ আরবি ও ইবরানি দুই ভাষাতেই লিখতেন। রাসুলের সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম এর সেক্রেটারির দায়িত্ব পালন করতেন জায়িদ ইবনু সাবিত রা.। যখনই চিঠিপত্র কিংবা ওহি লেখার প্রয়োজন হতো, তখন জায়িদ হাড়, চামড়া, খেজুরের পাতা প্রভৃতি ব্যবহার করে তা লিখতেন। এই কুরআন সংগ্রহ ও সংকলনের গৌরবের অধিকারী হজরত জায়িদ ইবনু সাবিত রা.। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের ইনতিকালের পর মুরতাদ মুসাইলাবা আল কাজ্জাবের বাহিনীর বিরুদ্ধে মুসলিম বাহিনীর যুদ্ধ হয়। তবে এ যুদ্ধে ৭০ জন হাফিজে কুরআন শাহাদাত বরণ করেন। এ ঘটনার পর হজরত উমর রা. খলিফা আবু বকর রা.-কে পুরো কুরআন এক সাথে সংগ্রহ করার ব্যবস্থা নেওয়ার পরামর্শ দেন। খলিফা জায়িদ ইবনু সাবিতকে ডেকে বলেন, “তোমার প্রতি সবার আস্থা আছে। তুমি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের জীবদ্দশায় ওহি লিখেছিলে, সুতরাং তুমিই কাজটি সম্পাদন কর।”
তিনি প্রথমে ইতস্তত করলেও পরে রাজি হয়ে যান। এ কাজে জায়িদকে সহযোগিতার জন্য খলিফা আবু বকর রা. আরও একদল সাহাবাকে দিলেন। দলটির সদস্য সংখ্যা ৭৫ বলে বর্ণীত আছে। কঠোর পরিশ্রম করে হজরত জায়িদ ইবনু সাবিত রা. এ গুরত্বপূর্ণ কাজ সমাপ্ত করেন। তার দ্বারাই সম্পূর্ণ আল কুরআন সংগ্রহ ও লিপিবদ্ধ করা হয়। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের প্রতি ছিল জায়িদের সীমাহীন ভালোবাসা। ছিল তার প্রতি শর্তহীন আনুগত্য। জায়িদের এই ভালবাসার কারণে তিনি সব সময় চেষ্টা করতেন প্রাণপ্রিয় রাসুল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের কাছাকাছি থাকার জন্য। যখন বদর যুদ্ধ সংঘটিত হয়, তখন জায়িদের বয়স মাত্র ১৩ বছর। তার প্রবল ইচ্ছা ও বাসনা ছিল যুদ্ধে যাবার। কিন্তু বয়স কম হওয়ার কারণে তাকে অনুমতি দেননি মহান সেনাপতি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম। কিন্তু যখন উহুদ যুদ্ধ সংঘটিত হলো, তখন জায়িদের বয়স ১৬ বছর। জায়িদ প্রবল প্লানের মতো তরঙ্গ-উচ্ছাসে যোগ দিলেন উহুদ যুদ্ধে। যুদ্ধ করলেন প্রাণপণে। সাহসের সাথে। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের একান্ত সাহচর্য ও ভালোবাসা লাভ করে ধন্য হয়েছেন হজরত জায়িদ ইবনু সাবিত রা.। তার মত এমন সৌভাগ্যের অধিকারী কজন হতে পারে? হজরত জায়িদ ইবনু সাবিতের মতো তারাই হতে পারে সফল, যাদের হৃদয়ে আছে ইমান, সাহস, ত্যাগ আর ইসলামের প্রতি সীমাহীন ভালোবাসা।