অশ্লীলতার ক্ষতি

অশ্লীলতা সর্ব পর্যায়েই ঘৃণ্য ও পরিহার্য। অশ্লীলতার অতি নিকট সম্পর্ক রয়েছে যৌন লালসা এবং পংকিলতার সাথে । মুখে অশ্লীল কথাবার্তা তখনই উচ্চারিত হয় বা হতে পারে যখন ব্যক্তির মন-মানসিকতা যৌন ভাবধারা কানায় কানায় ভর্তি হয়ে চারপাশ থেকে উপচে পড়তে শুরু করে।

যাদের মনে আল্লাহ্র প্রতি ঈমান নেই, নৈতিক পবিত্রতার কোন চেতনা নেই, পরকালের কোন ভয় নেই, সামাজিক অতি সাধারণ লাজ-লজ্জাটুকুও নিঃশেষ হয়ে গেছে, তাদের মুখে লাগামহীনভাবে অশ্লীল কথাবার্তার খৈ ফোটে ।

এসব অশ্লীল কথাবার্তায় প্রত্যক্ষ ইঙ্গিত থাকে কোন-না-কোন নারীর যৌনতা সম্পর্কে। নারীর রূপ-সৌন্দর্যও অনেক সময় অশ্লীল কথাবার্তার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে পড়ে। নারীর নানা গোপন বিষয়াদি নিয়ে নির্লজ্জ আলাপ চলে পুরুষ সমাজের মধ্যে, যা অত্যন্ত লজ্জাকর ব্যাপার। কুরআন মজীদে হজ প্রসঙ্গে বলা হয়েছেঃ

 

اَلۡحَجُّ اَشۡهُرٌ مَّعۡلُوۡمٰتٌ ۚ فَمَنۡ فَرَضَ فِیۡهِنَّ الۡحَجَّ فَلَا رَفَثَ وَ لَا فُسُوۡقَ ۙ وَ لَا جِدَالَ فِی الۡحَجِّ ؕ وَ مَا تَفۡعَلُوۡا مِنۡ خَیۡرٍ یَّعۡلَمۡهُ اللّٰهُ ؕؔ وَ تَزَوَّدُوۡا فَاِنَّ خَیۡرَ الزَّادِ التَّقۡوٰی ۫ وَ اتَّقُوۡنِ یٰۤاُولِی الۡاَلۡبَابِ ﴿۱۹۷﴾

হজের সময় নির্দিষ্ট মাসসমূহ। অতএব এই মাসসমূহে যে নিজের উপর হজ আরোপ করে নিল, তার জন্য হজে অশ্লীল ও পাপ কাজ এবং ঝগড়া-বিবাদ বৈধ নয়। আর তোমরা ভাল কাজের যা কর, আল্লাহ তা জানেন এবং পাথেয় গ্রহণ কর। নিশ্চয় উত্তম পাথেয় তাকওয়া। আর হে বিবেক সম্পন্নগণ, তোমরা আমাকে ভয় কর। [সুরা বাকারাঃ ১৯৭]

অতএব হজ-এর দিনসমূহে না অশ্লীল যৌন পংকিলতাপূর্ণ কোন কথা বলা যাবে, না শরীয়ত লঙ্ঘনের কোন-না-কোন ঝগড়া ফাসাদের কাজ। এই অশ্লীল ও নারীর যৌনতার দিকে ইঙ্গিতবহ কথাবর্তা কেবল হজ-এর দিনসমূহে করা যাবে না তাই নয়, সাধারণভাবে সকল সময়ের জন্যই তা নিষিদ্ধ । উক্ত আয়াতে হজ-এর কথা বিশেষভাবে বলা হয়েছে শুধু এ জন্যই যে, এ সময় পুরুষ ও নারীর ব্যাপক সমাবেশ ও খোলামেলা মিলিত একত্রিত হওয়ার সুযোগ হয়ে থাকে, দীর্ঘ পথ বিদেশ সফর করতে হয় উভয়কেই, তাতে পর্দার রীতিনীতি পালন করা খুবই কষ্টকর — অনেক সময় দুঃসাধ্য হয়ে থাকে। এই কারণে পুরুষ ও নারী উভয়ের মধ্যেই অশ্লীলতার বিকার দেখা দিতে পারে। অন্যথায় তা সাধারণভাবেই নিষিদ্ধ। ইসলামী সমাজে অশ্লীল কথাবার্তার কোন অবকাশ নেই। তা ব্যক্তির মনে
কলুষতারই প্রকাশ করে না, গোটা পরিবেশ পরিমণ্ডলকেও পংকিল করে তোলে। তাতে আল্লাহ-নির্ধারিত সীমা লঙ্ঘিত হয়। তবে একান্তই প্রয়োজনীয় অবস্থায় নিছক ইশারা ইঙ্গিতে কিছু বললে তা অবশ্য নিষিদ্ধ নয়, কুরআন মাজীদে এই পর্যায়ের জরুরী কথা বলতে গিয়ে ইঙ্গিত ব্যবহার করা হয়েছে, লজ্জার সীমা লংঘন করা হয়নি। নির্লজ্জ অশ্লীল কথাবার্তার আর একটি দিক হচ্ছে প্রচণ্ড ক্রোধ ও আক্রোশ প্রকাশ করার জন্য গালাগাল উচ্চারণ করা। গালাগাল বিশেষ করে অশ্লীল গালাগাল সামাজিক পংকিলতা নিয়ে আসে। ক্রোধ আক্রোশে অন্ধ হয়ে মানুষ মুখে অশ্লীল গালাগাল উচ্চারণ করে। তখন সে মনে করে, একটা কাজের মত কাজ করেছি। মনের ঝাল সবই যেন মেটাতে চায় এই গালাগাল দিয়ে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির উপস্থিতিত সামনা-সামনিও গালাগালি দেয়, দেয় তার অনুপস্থিতিতেও।

সামনা-সামনি এই গালাগাল দিলে গোটা পরিবেশ বিষাক্ত হয়ে উঠে। সামাজিক কলুষতা ব্যাপক হয়ে উঠে। গালাগালের নানা ধরন ও রূপ রয়েছে। ব্যক্তিকে ছাড়িয়ে তার বাপ মাকে গাল দিয়েও অনেকে ঝাল মিটায়। তার গোটা বংশকেই হীন প্রমাণ করতে চেষ্টা চালায়। কুরআন মাজিদ মোটামুটিভাবে এই সব ধরনের গালাগালকে “আল্‌ জিহরু বিস্‌ সুয়ে’ বলে স্পষ্ট নিষেধ বাণী উচ্চারণ করেছে। কুরআনে বলা হয়েছেঃ

لَا یُحِبُّ اللّٰهُ الۡجَهۡرَ بِالسُّوۡٓءِ مِنَ الۡقَوۡلِ اِلَّا مَنۡ ظُلِمَ ؕ وَ کَانَ اللّٰهُ سَمِیۡعًا عَلِیۡمًا ﴿۱۴۸﴾
খারাপ কথার প্রচার প্রপাগান্ডা আল্লাহ পছন্দ করেন না, তবে যার প্রতি অন্যায় করা হয়েছে (তার কথা আলাদা), আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ। [সুরা নিসাঃ ১৪৮]

আল্লাহ্‌ তা’আলা নির্লজ্জতা প্রকাশকারী কথাবার্তা মোটেই পছন্দ করেন না। ‘জিহ্রু বিস্‌ সূয়ে’ অর্থ কারোর খারাপ ও মন্দ দিক প্রকাশ করা, উচ্চৈস্বরে বলা। অশ্লীল গালাগাল এই পর্যায়ের একটি ব্যাপার । তা আল্লাহ্‌ পছন্দ করেন না অর্থাৎ আল্লাহ্‌ তা করতে নিষেধ করেছেন। তা করা হলে আল্লাহ্‌র ভালবাসা থেকে বঞ্চিত হতে হবে । আর আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত হওয়ার মত দুর্ভাগ্য
আর কিছুই হতে পারে না। এই কারণে কুরআন হাদীসে খারাপ কথাবার্তা না বলার জন্য স্পষ্ট নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

তার একটা বড় কারণ এই যে, সাধারণত একজন একটি গালি দিলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি তার চাইতে অধিক তীব্র ও অধিক অশ্লীল গালি উচ্চারণ করে থাকে। তাতে অশ্লিলতার ব্যাপকতা বাড়ে, চতুর্দিক তা বিস্তীর্ণ হয়ে পড়ে। এই কারণে কোনো ধরণের গালাগাল না করাই বাঞ্ছনীয়। এমন কি আল্লাহ্‌ তো মুশরিকদেরও গালাগাল করতে নিষেধ করেছেন। বলেছেনঃ

 

وَ لَا تَسُبُّوا الَّذِیۡنَ یَدۡعُوۡنَ مِنۡ دُوۡنِ اللّٰهِ فَیَسُبُّوا اللّٰهَ عَدۡوًۢا بِغَیۡرِ عِلۡمٍ ؕ کَذٰلِکَ زَیَّنَّا لِکُلِّ اُمَّۃٍ عَمَلَهُمۡ ۪ ثُمَّ اِلٰی رَبِّهِمۡ مَّرۡجِعُهُمۡ فَیُنَبِّئُهُمۡ بِمَا کَانُوۡا یَعۡمَلُوۡنَ ﴿۱۰۸﴾

তোমরা সেই লোকদের গাল-মন্দ দিও না, যারা আল্লাহকে বাদ দিয়ে অন্যদের ডাকে, ইবাদত করে, কেননা তোমরা তাদের গাল দিলে তারাও শক্রতাবশত
কোন জ্ঞান-বুদ্ধি ছাড়াই তোমাদের গালমন্দ করবে। [সুরা আনআমঃ ১০৮]

 

এই আয়াতের তাফসিরে এসেছে, কারো মধ্যে যদি কোন ত্রুটি পরিলক্ষিত হয়, তাহলে তার প্রকাশ্যে সমালোচনা না করার প্রতি শরীয়তে খুবই গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে, বরং তাকে নির্জনে বুঝাতে বলা হয়েছে। কিন্তু যদি ধর্মীয় কোন কল্যাণ থাকে, তাহলে প্রকাশ্যে সমালোচনা করায় কোন অসুবিধা নেই। এমনিভাবেই জনসমক্ষে প্রকাশ্যে কোন কুকর্ম করা নিতান্ত অপছন্দনীয়। একে তো কুকর্মে লিপ্ত হওয়াটাই নিষিদ্ধ, যদিও তা পর্দার অন্তরালে হয়, তার উপর সেটা জনসমক্ষে প্রকাশ্যে করা অতিরিক্ত আর একটি অপরাধ। আর তার জন্য ঐ কুকর্মের অপরাধ দ্বিগুণ হতে পারে। উক্ত দুই ধরনের অপরাধের কথা এই আয়াতে উল্লিখিত হয়েছে। আর তাতে এটাও বলা হয়েছে যে, কারো কৃত বা অকৃত অপরাধের কারণে তাকে প্রকাশ্যে ভৎর্সনা করো না। অবশ্য যালেমের যুলুমের কথা জনসমক্ষে বর্ণনা করার ব্যাপারটা ব্যতিক্রম। যালেমের যুলুমের কথা প্রকাশ্যে ব্যক্ত করার মাঝে কয়েকটি মঙ্গল নিহিত আছে। যেমন, সম্ভবতঃ সে যুলুম করা থেকে বিরত হতে পারে অথবা সে আত্মশুদ্ধির চেষ্টা করবে। দ্বিতীয়তঃ লোকে তার ব্যাপারে সাবধান ও সতর্ক থাকবে। হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, একজন লোক রসূল (সাঃ)-এর দরবারে উপস্থিত হয়ে বলল, ‘আমার প্রতিবেশী আমাকে কষ্ট দেয়।’ রসূল (সাঃ) তাকে বললেন, ‘‘তুমি তোমার ঘরের জিনিসপত্র বের করে রাস্তার উপর রেখে দাও।’’ লোকটি তাই করল। তারপর যেই রাস্তা দিয়ে পার হয়ে যায়, সেই তার কারণ জিজ্ঞাসা করে। আর সে প্রতিবেশীর অত্যাচারের কথা বলতেই প্রত্যেকেই তাকে অভিশাপ করে। প্রতিবেশী এই পরিস্থিতি দেখে নিজের ভুল স্বীকার করল এবং ‘ভবিষ্যতে আর কোনদিন কষ্ট দেবে না’ বলে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হল। আর প্রতিবেশীকে নিজ জিনিসপত্রগুলিকে ঘরে নিয়ে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করল।

১. এই কথাটি রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম এভাবে বলেছেন, সবচেয়ে বড় গুনাহ্‌ হচ্ছে ব্যক্তির তার বাপ-মার উপর কি করে অভিশাপ বর্ষণ করতে পারে? বললেন, তা করে এ ভাবে যে, যখন একজন অপরজনের বাপ-মাকে গাল দেয়, তখন সেও

তার বাপ-মাকে গাল দেয়, মন্দ বলে । আর এভাবে একজন লোক তার নিজের বাপ-মাকে অভিশাপ দিয়ে থাকে । (বুখারী, কিতাবুল আদব)

২. যে ব্যক্তি মুখ খারাপ করে গালাগাল উচ্চারণ করে সে সামাজিক সামষ্টিক জীবনের কল্যাণ থেকে নিজেকে বঞ্চিত করে। সে লোকদের দৃষ্টিতে হয় অপমানিত । লোকেরা তাকে ভালোবাসে না, পছন্দ করে না, তার প্রতি সম্মান বোধ করে না। হাদীসে উদ্ভৃত হয়েছে, এক ব্যক্তি রাসূলে করীম (স)-এর নিকট উপস্থিত হল । তিনি লোকটিকে দেখলেন । বললেনঃ লোকটি তার গোত্রের মধ্যে
খুবই খারাপ ব্যক্তি। সে যখন তার নিকট এলো, তখন তিনি তার সাথে খুব ভদ্র ব্যবহার করলেন, হাসিমুখে কথাবার্তা বললেন । সে যখন চলে গেল তখন হযরত আয়েশা (রা) বললেন, আপনি যখন লোকটিকে দেখলেন, তখন বললেন লোকটি ভাল নয়। কিন্তু পরে আপনি তার সাথে খুবই ভাল ও সম্মানজনক ব্যবহার করলেন, তার কারণ কি? নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বললেনঃ আয়েশা, তুমি আমাকে খারাপ কথা বলার ও খারাপ ব্যবহার করার লোক রূপে কবে দেখেছ? আল্লাহর নিকট কিয়ামতের দিন সবচেয়ে খারাপ ব্যক্তি হবে সে, যার কুৎসিত কথাবার্তার জন্য লোকেরা তার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করবে, তাকে পরিত্যাগ করবে। (বুখারী, কিতাবুল আদব)

এ থেকে বোঝা গেল যে, খারাপ লোকের সাথেও খারাপ ব্যবহার বা কথাবার্তা বলা উচিত নয়।

৩. অশ্লীল কথাবার্তা মূর্খতার লক্ষণ, বর্বর যুগের স্মারক এবং সভ্যতা ভব্যতা ও শালীনতার পরিপন্থী। একজন সাহাবী তাঁর ক্রীতদাসকে তার মা’র কথা বলে গাল দিলেন। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম তা শুনে বললেনঃ তোমার মধ্যে জাহিলিয়াতির যুগের অভ্যাস এখনও রয়ে গেছো

৪. লাজ-লজ্জা ও শালীনতা, ভদ্র কথাবার্তা উত্তম চরিত্রের অংশ। ইসলাম বিশেষভাবে তার শিক্ষা দিয়েছে। মুখে খারাপ কথাবার্তা বলা তার স্পষ্ট বিপরীত। কিছু সংখ্যক ইয়াহুদী রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম-এর দরবারে এসে ‘আস্সালাম’-এর পরিবর্তে ‘আস্সাম আলাইকুম” (তোমাদের মৃত্যু আসুক) বললে হযরত আয়েশা (রা) তা শুনে তার চাইতেও কিছুটা খারাপ কথায় উত্তর দিলেন। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম শুনে বললেন, হে আয়েশা, নম্রতা অবলম্বন কর, কঠোরতা, নির্মমতা ও খারাপ কথা পরিহার কর।

৫. গালাগাল নিষিদ্ধ হওয়ার মূলে এই সূক্ষ্ম কারণও নিহিত রয়েছে যে, তাতে সাধারণত নির্লজ্জ ও বেহায়া কথাবার্তা ও উক্তি শব্দের আকারে মুখে উচ্চারিত হয়। তাতে সমাজের লোকদের মধ্যে অশ্লীল কথাবার্তা শুনবার অভ্যাস হয়ে যায়। এভাবে অশ্লীল কথা ধীরে ধীরে কাজে পরিণত হয়ে যায়। এই জন্য নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ

অশ্লীল ও নির্লজ্জ কথাবার্তা যে জিনিসে শামিল হবে, সে জিনিসকেই কুৎসিৎ করে দেবে। (তিরমিযী, আবওয়াবুল বিররে আস্সিল্লাহ)।

বোঝা গেল, কুৎসিৎ ও নির্লজ্জ কথাবার্তাও লজ্জাশীলতা ও শালীনতার পরিপন্থী ।

 

Leave a Comment