ঘটন-অঘটনের মধ্য দিয়ে শেষ হচ্ছে ২০২১ সাল। রাজনীতি, গণতন্ত্র, মানবাধিকার, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ মোকাবিলা, জলবায়ু পরিবর্তনসহ নানা ইস্যুতে বছরজুড়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছিল অস্থিরতা, বিক্ষোভ, দাঙ্গা ও সহিংসতা।বছরটি শুরু হয়েছিল মার্কিন কংগ্রেস ভবনে (ক্যাপিটল হিল) সহিংস হামলা দিয়ে। আর সুদানে সেনাশাসনের বিরুদ্ধে হাজারো মানুষের বিক্ষোভের মধ্য দিয়ে শেষ হচ্ছে এ বছর।বিদায়ী বছরে বিশ্বে ঘটে যাওয়া নানা ঘটনার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয়ের দিকে দৃষ্টি ফেলেছে যুক্তরাষ্ট্রের দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকা।
১. মার্কিন কংগ্রেসে হামলা
৬ জানুয়ারি তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের উসকানিতে তাঁর উগ্র সমর্থকেরা যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস ভবনে সহিংস হামলা চালান। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জো বাইডেনের জয়ের সত্যায়ন ঠেকানোর উদ্দেশ্যে চালানো এ হামলায় রক্তাক্ত হয় মার্কিন কংগ্রেস। নিহত হয় পাঁচজন। আহত শতাধিক। এ ঘটনাকে মার্কিন গণতন্ত্রের ওপর নগ্ন হামলা হিসেবে বর্ণনা করা হয়।
২. তিউনিসিয়ায় বিক্ষোভ
এক দশক আগে তিউনিসিয়ায় আরব বসন্তের সূচনা হয়েছিল। দেশটির রাজনৈতিক নেতাদের প্রতি ক্ষোভ ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে সরকারের ব্যর্থতার জেরে ক্ষুব্ধ-হতাশ নতুন প্রজন্ম জানুয়ারিতে আবার রাজপথে নেমে আসে। রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যকার ক্ষমতার দ্বন্দ্ব-টানাপোড়েন ঘিরে দেশটিতে প্রায় বছরজুড়ে বিক্ষোভ-প্রতিবাদ চলে।
৩. মিয়ানমারে সেনা অভ্যুত্থান
১ ফেব্রুয়ারি মিয়ানমারের সেনাবাহিনী দেশটির ক্ষমতা দখল করে। তারা দেশটির গণতন্ত্রপন্থী নেত্রী অং সান সু চিসহ রাজনৈতিক নেতাদের গ্রেপ্তার করে। জারি করে জরুরি অবস্থা। সেনাশাসনের বিরুদ্ধে হাজারো মানুষ রাজপথে নেমে আসে। বিক্ষোভ দমনে সেনাবাহিনী সহিংস পন্থা বেছে নেয়। মিয়ানমারে সেনাশাসনবিরোধী বিক্ষোভে ১ হাজার ৩০০ জনের বেশি বিক্ষোভকারী নিহত হয়েছেন। গ্রেপ্তার হয়েছেন হাজারো মানুষ।
৪. নাভালনির জন্য রাশিয়ায় বিক্ষোভ
রাশিয়ার বিরোধী নেতা অ্যালেক্সি নাভালনি জানুয়ারিতে দেশে ফেরামাত্র গ্রেপ্তার হন। তাঁকে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। তাঁর মুক্তির দাবিতে জানুয়ারির শেষ দিকে রাশিয়ার শহরে শহরে গণবিক্ষোভ হয়। রুশ পুলিশ হাজারো বিক্ষোভকারীকে গ্রেপ্তার করে। এরপরও দেশটিতে আরও বিক্ষোভ হয়।
৫. করোনা মহামারি
করোনার মহামারি ঠেকাতে ব্যর্থতা, লকডাউন, অর্থনৈতিক প্রভাবকে ঘিরে বিভিন্ন দেশে বিক্ষোভ হয়। করোনার সংক্রমণ মোকাবিলায় দেওয়া বিধিনিষেধের বিরুদ্ধে ২০২১ সালে ইউরোপসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিক্ষোভ হয়। অন্যদিকে করোনার বিস্তার ঠেকাতে সরকারের ব্যর্থতার অভিযোগে ব্রাজিলসহ কিছু দেশে বিক্ষোভ হয়।
৬. থাইল্যান্ডে বিক্ষোভ
সরকারবিরোধী বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে থাইল্যান্ডের রাজপথ। বিক্ষোভকারীরা থাই প্রধানমন্ত্রী প্রাইয়ুথ চান–ওচার পদত্যাগ দাবি করেন। একই সঙ্গে তাঁরা থাই রাজতন্ত্রের সংস্কার দাবি করেন। বিক্ষোভ দমনে থাই পুলিশ ছিল সোচ্চার।
৭. কিউবায় বিরল বিক্ষোভ
করোনা সংক্রমণের লাগাম টানতে সরকারের ব্যর্থতা, অর্থনৈতিক সংকট, নিত্যপণ্যের ঘাটতি, নাগরিক অধিকার খর্ব হওয়ার মতো ঘটনায় জুলাইয়ে কিউবায় বিরল বিক্ষোভ হয়। রাজধানী হাভানাসহ দেশটির বড় শহরগুলোর রাজপথে হাজারো মানুষ নেমে বিক্ষোভ দেখান। প্রায় তিন দশকের মধ্যে দেশটিতে এটাই ছিল সবচেয়ে বড় বিক্ষোভের ঘটনা। বিক্ষোভ দমনে দেশটির সরকার মারধর ও ধরপাকড় চালায়।
৮. দক্ষিণ আফ্রিকায় দাঙ্গা
দক্ষিণ আফ্রিকায় জুলাইয়ে ব্যাপক দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে। দুর্নীতির মামলায় দেশটির সাবেক প্রেসিডেন্ট জ্যাকব জুমাকে গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে শুরু হওয়া বিক্ষোভ একপর্যায়ে দাঙ্গায় রূপ নেয়। দাঙ্গাকালে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, লুটপাটের ঘটনা ঘটে। ঘটে বর্ণবাদী সহিংসতাও। দাঙ্গায় অনেক মানুষ নিহত হয়। গ্রেপ্তার হাজারো। পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকার সেনা মোতায়েন করতে বাধ্য হয়। অনেকে এ দাঙ্গাকে বেকারত্ব ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের ফল হিসেবে বর্ণনা করচ্ছে।
৯. ভারতে কৃষক বিক্ষোভ
তিনটি বিতর্কিত কৃষি আইন পাসের বিরুদ্ধে ২০২১ সালে ভারতে কৃষক আন্দোলন জোরদার হয়। প্রায় বছরজুড়েই রাজ্যে রাজ্যে এ আন্দোলন চলে। আন্দোলনে সহিংসতায় কৃষকদের প্রাণহানি ঘটে। টানা আন্দোলনের মুখে বছরের শেষ দিকে তিনটি কৃষি আইন বাতিল করে নরেন্দ্র মোদির সরকার।
১০. ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত
মে মাসে ইসরায়েল-ফিলিস্তিনের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘাত হয়। ১১ দিনের এ সংঘাতে গাজায় ইসরায়েলি হামলায় ২৫০ জনের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়। অন্যদিকে হামাসের হামলায় ইসরায়েলে নিহত হয় ১২ জন। পরে যুদ্ধবিরতির মাধ্যমে দুই পক্ষের মধ্যকার এ সংঘাত বন্ধ হয়।
১১. সুদানে সেনাশাসন ও বিক্ষোভ
অক্টোবরে সুদানের সেনাবাহিনী আবার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে দেশটির ক্ষমতা দখল করে। তারা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ভেঙে দিয়ে জরুরি অবস্থা জারি করে। গ্রেপ্তার করা হয় প্রধানমন্ত্রী আবদাল্লাহ হামদকসহ মন্ত্রিসভার প্রায় সব সদস্যকে। সুদানে অভ্যুত্থানের পর থেকে দেশটিতে সেনাশাসনবিরোধী বিক্ষোভ হয়ে আসছে। এ বিক্ষোভে এখন পর্যন্ত প্রায় ৪৫ জন নিহত হয়েছেন। নভেম্বরে দেশটির সেনাবাহিনীর সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী হামদকের সমঝোতা হয়। তবে এ সমঝোতার বিরোধিতা করে দেশটির বিভিন্ন শহরে হাজারো মানুষের বিক্ষোভ হয়।
১২. জলবায়ু পরিবর্তন
নভেম্বরে স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোতে জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলন (কপ-২৬) অনুষ্ঠিত হয়। ধরিত্রীকে রক্ষার জন্য এই সম্মেলনকে সবশেষ সেরা সুযোগ হিসেবে অনেকে অভিহিত করেন। জলবায়ু বিপর্যয় এড়ানোর লক্ষ্যে আমূল ও দ্রুত পদক্ষেপ নিতে বিশ্বনেতাদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে হাজারো মানুষ স্কটল্যান্ডে বিক্ষোভ করেন। তবে শেষ পর্যন্ত সম্মেলনের অর্জন নিয়ে অনেকে হতাশা প্রকাশ করেন।