‘হৃদয়ের টানে ফিরে আসি বার বার’- স্লোগানে কারমাইকেল কলেজ ১০৫ বছর

উত্তর জনপদের প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কারমাইকেল কলেজ প্রতিষ্ঠার আজ ১০৫ বছর। শিক্ষার আলো বিতরণের মাধ্যমে যোগ্য নেতৃত্বের গুণাবলিসম্পন্ন মানুষ তৈরির কারখানা হিসেবেই পরিচিত শতবর্ষী এই বিদ্যাপীঠ।

১৯১৬ সালের ১০ নভেম্বর যাত্রা করা এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ভারতীয় উপমহাদেশের বিট্রিশ-বাঙালির শিক্ষা-দীক্ষা, আন্দোলন-সংগ্রাম, ইতিহাস আর ঐতিহ্যের জীবন্ত প্রতীক। যাত্রাকাল থেকেই অবহেলিত উত্তরাঞ্চলের বিদ্যারণ্যে প্রবীণ এক বৃক্ষের নাম ‘কারমাইকেল কলেজ’। এ প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষা নিয়ে শিক্ষার্থীরা দেশের শীর্ষ পর্যায়ে নেতৃত্ব দেওয়াসহ দেশ-বিদেশে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন। বটবৃক্ষের মতো আপন মহিমায় হাজারও আনন্দ-বেদনা স্মৃতি নিয়ে ১০৫ বছর ধরে দণ্ডায়মান শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি।

উত্তর জনপদে শিক্ষা বিস্তারের মূল কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠা শতবর্ষী এই বিদ্যাঙ্গনের ১০৫ বছর পূর্তি উদযাপনে নবীন-প্রবীণ শিক্ষক-শিক্ষার্থী প্রহর গুনছেন। উৎসব উদযাপনকে ঘিরে সাজ সাজ রব ক্যাম্পাসজুড়ে। আলোকসজ্জাসহ ঐতিহ্যবাহী ভবনগুলো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা হয়েছে।

‘হৃদয়ের টানে ফিরে আসি বার বার’- স্লোগানে গৌরবময় পথচলার ১০৫ বছর পূর্তি উৎসবের আয়োজন রয়েছে শুক্রবার (১২ নভেম্বর)। এ দিন বর্ষপূর্তি উপলক্ষে অ্যাম্বুলেন্স উদ্বোধন, বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা, আলোচনা সভা, স্মৃতিচারণ ও মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করেছে কারমাইকেল কলেজ প্রাক্তন ছাত্র সমিতি। 

এদিকে আজ বুধবার কলেজ প্রশাসনসহ কারমাইকেল কলেজ শিক্ষার্থী পরিষদের আয়োজনে রয়েছে নানান কর্মসূচি। দুই দিনের এ উৎসবে অংশ নিতে ইতোমধ্যে কলেজটির বর্তমান ও সাবেক শিক্ষার্থী এবং শিক্ষকরা নিবন্ধন সম্পন্ন করেছেন।

কারমাইকেল কলেজ প্রতিষ্ঠার ইতিহাস

১৯১৬ সালের ১০ নভেম্বর তৎকালীন অবিভক্ত বাংলার গভর্নর লর্ড থমাস ডেভিড ব্যারন কারমাইকেল কলেজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। তার নামানুসারেই কলেজের নামকরণ করা হয় কারমাইকেল কলেজ। ১৯১৭ সালের জুলাই মাসে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এই কলেজে আইএ ও বিএ ক্লাস খোলার অনুমতি দেয়। সেই সময় থেকে প্রায় দুই বছরের জন্য কলেজটির পঠনপাঠনের কাজ চলে রংপুরের বর্তমান জেলা পরিষদ ভবনে। এরপর ১৯১৮ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি কারমাইকেল কলেজের মূল ভবনের উদ্বোধন করা হয়। জার্মান নাগরিক ড. ওয়াটকিন ছিলেন কলেজের প্রতিষ্ঠাকালীন অধ্যক্ষ।

এই কলেজ প্রতিষ্ঠার নেপথ্যে রয়েছে অনেক কারণ আর স্বপ্ন। ১৮৩২ সালে মাধ্যমিক শিক্ষার জন্য রংপুর জিলা স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়। এতে করে রংপুর অঞ্চলের মানুষ লেখাপড়ায় আগ্রহী হয়ে ওঠে। ওই সময়ে কোনো কলেজ না থাকায় উচ্চ শিক্ষার জন্য এ অঞ্চলের শিক্ষার্থীদের ভারতের কুচবিহারে যেতে হতো। একটি মানসম্মত কলেজ প্রতিষ্ঠা ছিল রংপুরবাসীর আজন্ম লালিত স্বপ্ন।

১৯১৩ সালে অবিভক্ত বাংলার গভর্নর লর্ড ব্যারন কারমাইকেল রংপুর পরিদর্শনে এলে তার সংবর্ধনা সভায় কলেজ স্থাপনের দাবি উত্থাপিত হয়। রংপুর, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, নীলফামারী ও গাইবান্ধার জমিদার এবং শিক্ষানুরাগীদের দানে সংগৃহীত অর্থ এবং জমিদারদের দান করা ৯০০ একর জমির ওপর গড়ে ওঠে কারমাইকেল কলেজ। রংপুর নগরী থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে এই কলেজের অবস্থান। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটিতে বর্তমানে উচ্চ মাধ্যমিক, ডিগ্রিসহ ২১টি বিষয়ে সম্মান ও স্নাতকোত্তরে প্রায় ২৫ হাজার শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করছেন।

অবিভক্ত বাংলার যে কটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিপুল খ্যাতি অর্জন করেছিল এর মধ্যে কারমাইকেল কলেজ রয়েছে প্রথম সারিতে। ইংরেজ আমলের অবিভক্ত বাংলাদেশে উচ্চ শিক্ষার প্রসার ও প্রচারের জন্য অসামান্য খ্যাতির অধিকারী এই কারমাইকেল কলেজ। তৎকালীন রংপুর, দিনাজপুর অঞ্চলসহ অবিভক্ত ভারতের জলপাইগুড়ি, আসাম ও সংলগ্ন এলাকার শিক্ষার্থীদের উচ্চ শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টির ক্ষেত্রে এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের রয়েছে গৌরবময় ইতিহাস।

কারমাইকেল কলেজ ক্যাম্পাস

গাছপালা, পাখপাখালিতে ভরা প্রাকৃতিক পরিবেশ ও সৌন্দর্যে ঘেরা নয়নাভিরাম এর ক্যাম্পাস। জমিদারি স্থাপত্যের যেন এক অনন্য নিদর্শন। চারদিকে সবুজের সমারোহের মধ্যে যেন গর্বিত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে অনিন্দ্য সুন্দর স্থাপত্য কীর্তি কারমাইকেল কলেজের শ্বেতশুভ্র মূল ভবন।

কলেজে ঢুকতেই হাতের বাঁয়ে চোখে পড়বে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ম্যুরাল। কয়েক পা বাড়ালেই বাম দিকে শিক্ষকদের আবাসিক ভবন। আর একটু এগিয়ে গেলে শিক্ষকদের ডরমেটরি, যা ‘হোয়াইট হাউস’ নামে পরিচিত। পাশেই স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও কিউএ মেমোরিয়াল প্রাথমিক বিদ্যালয় (কলেজ প্রাইমারি স্কুল)। এর বিপরীতে মাথা উচু করে দাঁড়িয়ে আছে আরেক বিস্ময় বৃক্ষ ‘কাইজেলিয়া’। এই কাইজেলিয়া বৃক্ষটি বিলুপ্ত প্রজাতির বৃক্ষ। এর বয়সও শত বছর পেরিয়েছে। এটি মূলত আফ্রিকা মহাদেশ থেকে আনা কোনো এক বৃক্ষপ্রেমীর স্মৃতির সাক্ষী। বিলুপ্ত সেই কাইজেলিয়াকে যুগের পর যুগ ধরে রাখতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘কারমাইকেল কাইজেলিয়া শিক্ষা-সংস্কৃতি সংসদ (কাকাশিস)। কাইজেলিয়া বৃক্ষ থেকে আরও সামনের দিকে এগিয়ে গেলে চৌরাস্তা বা জিরো পয়েন্ট।

এছাড়া রয়েছে একটি সুদৃশ্য বিশাল মসজিদ, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র, ছাত্রী বিশ্রামাগার, বিভিন্ন বিভাগীয় ভবন, ক্যান্টিন রয়েছে। ক্যাম্পাসের ভেতরে তাপসী রাবেয়া হল, বেগম রোকেয়া হল, জাহানারা ইমাম হল, জি এল ছাত্রাবাস, ওসমানী ছাত্রাবাস, সি এম ছাত্রাবাস, কে বি ছাত্রাবাস (হিন্দুদের জন্য) নামে আবাসিক হল রয়েছে। এর মধ্যে সিএম হলটি পরিত্যক্ত ঘোষণা করেছে কলেজ কর্তৃপক্ষ। এছাড়া কলেজে সাব পোস্ট অফিস, অত্যাধুনিক অডিটোরিয়াম, একটি টালি ভবন (বিএনসিসি ও স্কাউট), ছাত্র বিশ্রামাগার, পুলিশ ফাঁড়ি, প্রশাসন ভবন ও দুটি বিশাল খেলার মাঠ রয়েছে।

মূল ভবনের পূর্বে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের একটি স্মারক ভাস্কর্য ‘প্রজন্ম’ যা নতুনমাত্রা যোগ করেছে মূল ভবনের নান্দনিকতায়। দক্ষিণে শহীদ মিনার, তিন তলা বিজ্ঞান ভবন (সেকেন্ড বিল্ডিং), তিন তলা কলা ও বাণিজ্য ভবন (থার্ড বিল্ডিং), দ্বিতল রসায়ন ভবন, নানা ফুলে সজ্জিত একটি বাগান। রয়েছে প্রায় ৭০ হাজার বইয়ের এক বিশাল ভারসমৃদ্ধ লাইব্রেরি, যা কলেজ প্রতিষ্ঠাকালীন রংপুর জেলা গ্রন্থাগার থেকে ২৫০টি বই নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল। কলেজের মূল ভবনের ঠিক মাঝে রয়েছে ‘আনন্দমোহন হল’।

উত্তর-পশ্চিম কোণে রয়েছে একটি উন্মুক্ত মঞ্চ, যা ‘বাংলা মঞ্চ’ নামে পরিচিত। কলেজের সব সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের প্রাণকেন্দ্র এটি। পড়ার ফাঁকে বাংলা বিভাগের পাশে লিচুতলার সংস্কৃতি মঞ্চে নানামুখী সৃজনশীল কর্মকাণ্ডে মেতে ওঠে কলেজর শিক্ষার্থীরা। রয়েছে  স্পন্দন, কানাসাস, বিতর্ক পরিষদ, কাকাশিস, বাঁধন, বিএনসিসি, রোভার স্কাউটসহ একাধিক সাহিত্য, সাংস্কৃতিক, বিতর্ক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। সব মিলিয়ে সারা বছরই প্রাণোচ্ছল থাকে কারমাইকেল কলেজ। ঐতিহ্যবাহী এই কলেজ ক্যাম্পাসের দক্ষিণে রংপুর ক্যাডেট কলেজ, উত্তরে রংপুর রেল স্টেশন ও লালবাগ হাট-বাজার এবং চারপাশ ঘিরে গড়ে উঠেছে অসংখ্য ছাত্রাবাস।

যাদের নিয়ে গর্ব করে কারমাইকেল কলেজ

কারমাইকেল কলেজ মানেই লাখ লাখ শিক্ষার্থীর ভালোবাসা ও জীবনের সোনালি দিনের স্মৃতিতে ফিরে যাওয়ার নাম। এই খ্যাতিজোড়া প্রতিষ্ঠানে বহু খ্যাতিমান পন্ডিত, গবেষক ও জ্ঞানতাপসের ছোঁয়া রয়েছে। এই কলেজ জন্ম দিয়েছে অনেক জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিকে। যারা বিভিন্ন ক্ষেত্রে রেখেছেন উজ্জ্বল ভূমিকা।

এখানে পড়েছেন একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল আন্দোলনের নেত্রী জাহানারা ইমাম, সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, সাবেক সেনাবাহিনী প্রধান মেজর জেনারেল মুস্তাফিজার রহমান, দেশবরেণ্য কথাসাহিত্যিক ও নাট্যকার আনিসুল হক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও সাবেক মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূরসহ এ দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতিতে নামকরা জানা-অজানা আরও অনেকে।

এখানে আরও পড়ালেখা করেছেন স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে শহীদ হওয়া ছাত্রনেতা রাউফুন বসুনীয়া, নজরুল গবেষক, কবি ও সাংবাদিক আবদুল হাই শিকদার, সাবেক উপমন্ত্রী আসাদুল হাবিব দুলু, বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের প্রথম স্পিকার শাহ আব্দুল হামিদ, প্রখ্যাত ছড়াকার রফিকুল হক, ইংল্যান্ডের ল্যাঙ্কাশায়ারের হিন্ডবার্ন সিটির সাবেক মেয়র আলতাফুর রহমান।

প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছিলেন বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন কমিটির অন্যতম সদস্য এম আব্দুর রহিম, প্রথিতযশা চারণ সাংবাদিক মোনাজাতউদ্দিন, বাংলাদেশের প্রথম প্রধান বিচারপতি ও ষষ্ঠ রাষ্ট্রপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম, ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামী ও তেভাগা আন্দোলনের নেতা মণিকৃষ্ণ সেন। ব্রিটিশ শাসন, পাকিস্তানি শোষণ আর বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাসের সঙ্গে কারমাইকেল কলেজের অসংখ্য শিক্ষক-শিক্ষার্থীর নাম ও রক্ত মিশে আছে। এ দেশের স্বাধীনতা আন্দোলন সংগ্রামে প্রাণ দিয়েছেন অনেক শিক্ষক ও শিক্ষার্থী। যারা এই বিদ্যাঙ্গনের নামকে গর্বিত ও সম্মানিত করেছেন।

শুক্রবার বর্ষপূর্তি অনুষ্ঠানে যারা থাকবেন

১০৫ বছর উদযাপনে শুক্রবার (১২ নভেম্বর) দিনব্যাপী বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে কারমাইকেল কলেজ প্রাক্তন ছাত্র সমিতি। ওই দিন সকাল ৯টা থেকে কারমাইকেল কলেজ ক্যাম্পাসে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা, আলোচনা সভা, স্মৃতিচারণ ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়েছে। এছাড়াও প্রাক্তন ছাত্র সমিতির পক্ষ থেকে ক্যাম্পাসে একটি অ্যাম্বুলেন্স উদ্বোধন করা হবে।

দিনব্যাপী এ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি থাকবেন সমাজকল্যাণ মন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদ। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের (হাইকোর্ট বিভাগ) বিচারপতি এম এনায়েতুর রহিম, বিরোধী দলীয় চিফ হুইপ মসিউর রহমান রাঙ্গা, সংসদ সদস্য আবুল কালাম মো. আহসানুল হক চৌধুরী ডিউক, রংপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা, কারমাইকেল কলেজ অধ্যক্ষ প্রফেসর ড. মো. আমজাদ হোসেন। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন সরকারের অতিরিক্ত সচিব ও প্রাক্তন ছাত্র সমিতির সভাপতি জাহাঙ্গীর আলম।

Leave a Comment