দুই চোখের পাতা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল হবিগঞ্জবাসী কানিজ ফাতেমার। কিছুই দেখতে পাচ্ছিলেন না। তড়িঘড়ি করে স্ত্রীকে ঢাকায় নিয়ে আসেন মইদুল ইসলাম।চিকিৎসকেরা মইদুল ইসলামকে জানান, অস্ত্রোপচারের জন্য টিস্যু গ্রাফট প্রয়োজন, তা সংগ্রহ করতে হবে। কিন্তু ওই হাসপাতালে টিস্যু গ্রাফট ছিল না।ঘটনাটি গত বছরের মে মাসের। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে সে সময় দেশে চলছিল কঠোর বিধিনিষেধ। মইদুল ইসলাম বলেন, ‘লকডাউনের ওই পরিস্থিতিতে খুবই বিপদে ছিলাম। মাথা কাজ করছিল না।’এ অবস্থায় উপায় বলে দেন ওই হাসপাতালের চিকিৎসকেরা। ইনস্টিটিউট অব টিস্যু ব্যাংকিং অ্যান্ড বায়োম্যাটেরিয়াল রিসার্চে খোঁজ নিতে বলেন। সেখানে গিয়ে হাঁপ ছেড়ে বাঁচেন মইদুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘২০০ টাকার মধ্যেই দুটো পাতলা পর্দার মতো গ্রাফট কিনেছিলাম। খুবই পাতলা। ২০ মিনিটের মধ্যে ফ্রিজ থেকে জিনিসটা বের করে দিয়েছিল।’অস্ত্রোপচারের পর এখন অনেকটাই সুস্থ কানিজ ফাতেমা। চোখের পাতা মেলেছেন, দেখতেও পারছেন।
মইনুল ও কানিজের মতো যাঁরা বিপদে পড়েছেন, তাঁদের অনেকেই হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছেন সাভারের ইনস্টিটিউট অব টিস্যু ব্যাংকিং অ্যান্ড বায়োম্যাটেরিয়াল রিসার্চের সহায়তায়। হাড়, খুলি ও পোড়া ত্বকের টিস্যু প্রতিস্থাপনে প্রক্রিয়াজাতকৃত টিস্যু স্বল্প মূল্যে সরবরাহ করে প্রতিষ্ঠানটি। অনেকের মাথার খুলি জমাও রাখা হয়।নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার পঞ্চাশোর্ধ্ব এক নারীর কথাই ধরুন। মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণে আক্রান্ত হয়েছিলেন তিনি। বেসরকারি একটি হাসপাতালে অস্ত্রোপচার করা হয়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই নারীর সন্তান বলেন, অস্ত্রোপচার করার সময় চিকিৎসকেরা খুলির কিছু অংশ ইনস্টিটিউট অব টিস্যু ব্যাংকিং অ্যান্ড বায়োম্যাটেরিয়াল রিসার্চে সংরক্ষণ করতে বলেন। তখন ৫০০ টাকায় এক বছরের জন্য সংরক্ষণ করা হয়েছিল। তিনি আরও বলেন, ‘প্রথম অপারেশনের এক মাসের মধ্যে মা সুস্থ হয়ে গেছে। দ্বিতীয় ধাপে খুলির সেই অংশ প্রতিস্থাপন করা হয়। ডাক্তার বলেছিল, কোনো সংক্রমণ হলে খুলি যাতে সংক্রমিত না হয়, তাই সংরক্ষণ করা হয়েছিল।’
বাংলাদেশ পরমাণুশক্তি কমিশনের অধীন ইনস্টিটিউট অব টিস্যু ব্যাংকিং অ্যান্ড বায়োম্যাটেরিয়াল রিসার্চ (আইটিবিবিআর) ঢাকার সাভার উপজেলায় অবস্থিত। হাড়, খুলি ও পোড়া ত্বকের টিস্যু প্রতিস্থাপনে কীভাবে এখানে কাজ করা হয়, সে সম্পর্কে বিস্তারিত বলেন প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক ও প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এস এম আছাদুজ্জামান। বলেছেন প্রতিষ্ঠানটির শুরুর কথা। আন্তর্জাতিক পরমাণুশক্তি সংস্থা (আইএইএ) ও আঞ্চলিক সহযোগিতা চুক্তির (আরসিএ) আওতায় বাংলাদেশে টিস্যু ব্যাংকিং কর্মসূচিতে বিভিন্ন কারিগরি সহযোগিতা দেওয়া হয়। যন্ত্রপাতি সরবরাহ, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রশিক্ষণের কাজ করা হয়েছিল সে চুক্তির আওতায়। ২০০৩ সালে টিস্যু ব্যাংকিং অ্যান্ড বায়ম্যাটেরিয়াল রিসার্চ ইউনিট (টিবিবিআরইউ) প্রতিষ্ঠিত হয়। ২০১৭ সালে এটি বাংলাদেশ পরমাণুশক্তি কমিশনের অধীনে ইনস্টিটিউট অব টিস্যু ব্যাংকিং অ্যান্ড বায়োম্যাটেরিয়াল রিসার্চ নামে আলাদা প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত হয়।
টিস্যু ব্যাংক কী
পরিচালক এস এম আছাদুজ্জামান বলেন, দেহের কিছু কোষ একত্রে একটা সাধারণ কাজে নিয়োজিত থাকে, সেগুলোকে টিস্যু বলে। চিকিৎসার কাজে ব্যবহারের জন্য পরিত্যক্ত ও অব্যবহৃত মানবটিস্যু সংগ্রহ, প্রক্রিয়াজাতকরণ, জীবাণুমুক্ত করা ও গুণগত মান ধরে রেখে সংরক্ষণ করা হয়। এই পুরো প্রক্রিয়াকে বলে টিস্যু ব্যাংকিং। এ কাজই করে ইনস্টিটিউট অব টিস্যু ব্যাংকিং অ্যান্ড বায়োম্যাটেরিয়াল রিসার্চ।পরবর্তী সময়ে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে টিস্যু দেহে প্রতিস্থাপনের জন্য সরবরাহ করা হয়। প্রক্রিয়াজাত করার পর টিস্যুটিকে বলা হয় টিস্যু গ্রাফট।টিস্যু গ্রাফট দুই ধরনের। একজন ব্যক্তির টিস্যু প্রক্রিয়াজাত করে শরীরের এক স্থান থেকে অন্য স্থানে প্রতিস্থাপনকে বলা হয় অটোগ্রাফট। যদি সেই টিস্যু অন্য কোনো ব্যক্তির শরীরে প্রতিস্থাপন করা হয়, তখন তাকে বলে অ্যালোগ্রাফট।
যেভাবে প্রক্রিয়াজাত করা হয়
আইটিবিবিআরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এস এম আছাদুজ্জামান বলেন, টিস্যু গ্রাফট দেশের বিভিন্ন হাসপাতাল ও ক্লিনিকে চিকিৎসার উদ্দেশ্যে সরবরাহ করা হয়। রোগীদের স্বজন বা হাসপাতাল-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা সাভারে এসে টিস্যু গ্রাফট নিয়ে যান। প্রক্রিয়াজাত করা থাকে বলে কোনো টিস্যু গ্রাফট যে কেউ ব্যবহার করতে পারেন।এস এম আছাদুজ্জামান আরও বলেন, একটি টিস্যু গ্রাফটকে অস্ত্রোপচারে ব্যবহারের জন্য প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে প্রস্তুত করতে তিন থেকে চার সপ্তাহ সময় লাগে। জরুরি সেবার খাত হিসেবে এখানে সরকার ভর্তুকি দিচ্ছে। এ জন্যই অল্প দামে টিস্যু গ্রাফট সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে। অস্ত্রোপচারে ব্যবহারের আগে টিস্যু প্রক্রিয়াজাতকরণে পরমাণু প্রযুক্তির ব্যবহারের ধাপটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে জানান তিনি।
আইটিবিবিআর বলছে, তারা অ্যামনিওটিক মেমব্রেন, হাড় ও খুলি সংগ্রহ করে প্রক্রিয়াজাত করে। অস্থিচিকিত্সা, মেরুদণ্ডের অস্ত্রোপচার, মুখ ও চোয়ালের অস্ত্রোপচারের জন্য ‘হার্ড টিস্যু গ্রাফট’ (হাড়) ব্যবহৃত হয়। আর পোড়া ত্বক ও প্লাস্টিক সার্জারি, ত্বক ও চোখের চিকিৎসায় মূলত সফট টিস্যু গ্রাফট (অ্যামনিওটিক মেমব্রেন) ব্যবহৃত হচ্ছে।এর মধ্যে হাড়গুলো বিভিন্ন আকারে কেটে প্রক্রিয়াজাত করা হয়। ছোট ছোট টুকরার হাড়কে বলে টিপিক্যাল বোন চিপস। আর হাড় থেকে একধরনের মিনারেল, সল্ট সরিয়ে ফেলার পর তাকে বলে ‘ডিমিনারেলাইজড বোন গ্রানিউল’। এ ছাড়া ম্যাসিভ বোন (বড় হাড়) ব্যবহৃত হয়।
নিউরোসার্জারি বা স্নায়বিক রোগের অস্ত্রোপচারে ব্যবহৃত হয় প্রক্রিয়াজাত খুলি।অ্যামনিওটিক মেমব্রেন অ্যালোগ্রাফট মূলত ব্যবহৃত হয় চোখের অস্ত্রোপচার, পোড়া রোগীর ড্রেসিং ও ত্বকের ক্ষত নিরাময়ে। প্লাস্টিক সার্জারিতেও এটি ব্যবহৃত হয়। গর্ভাবস্থায় বাচ্চা যে থলের ভেতর থাকে, তাকে অ্যামনিওটিক মেমব্রেন বলে। শিশুর জন্মের পর তা ফেলে না দিয়ে সংগ্রহ করা হয়। পরে প্রক্রিয়াজাত করে ব্যবহারের উপযোগী করে আইটিবিবিআর।আইটিবিবিআর জানায়, ২০০৯ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ৮ হাজারের ওপর হাড়, সাড়ে ১৫ হাজারের মতো অ্যামনিওটিক মেমব্রেন বা অ্যামনিওন বিভিন্ন দাতার কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়। এ সময়সীমার মধ্যে ১ লাখ ৪০ হাজারে মতো হাড় এবং ৫৪ হাজারের বেশি টুকরা অ্যামনিওন গ্রাফট প্রক্রিয়াজাত করে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে রোগীর অস্ত্রোপচারের জন্য সরবরাহ করা হয়েছে।এস এম আছাদুজ্জামান বলেন, ‘এটা টারশিয়ারি ট্রিটমেন্ট। অর্থাৎ কোনো চিকিৎসার শেষ পর্যায়ে উপায় না পেয়ে মানুষ আমাদের সহায়তা নেন। যেমন হাড় কেটে ফেলে প্রতিস্থাপন করতে আমাদের টিস্যু গ্রাফট দরকার হয়। চিকিৎসকদের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা প্রান্তিক পর্যায়ের রোগীদের সরবরাহ করছি।’
আগামী চার বছরের মধ্যে চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী ও সিলেটে এ কর্মকাণ্ড চালানো সম্ভব হবে বলে জানিয়েছেন এস এম আছাদুজ্জামান।আইটিবিবিআরের পরিচালক বলেন, ‘দেশের বড় বড় শহরের হাসপাতালগুলোয় অস্ত্রোপচার করা হয় আমাদের কাছ থেকে টিস্যু গ্রাফট নিয়ে। অনেক এলাকা থেকে দূরে অবস্থিত হওয়ায় অনেক সময় তাৎক্ষণিকভাবে টিস্যু সেসব অঞ্চলে সরবরাহ করা সম্ভব হয় না। আরও চারটি অঞ্চলে টিস্যু ব্যাংকিং কার্যক্রম চালানো গেলে টিস্যু গ্রাফট দ্রুত সংগ্রহ ও প্রক্রিয়াজাত করে সহজে সরবরাহ করা সম্ভব হবে। পাশাপাশি আরও বেশিসংখ্যক রোগীর শরীরে টিস্যু গ্রাফট প্রতিস্থাপন করা সম্ভব হবে।’