হাসান বসরি রাহ. এর অনুপ্রেরণামূলক ও আত্মশুদ্ধিমূলক উক্তিসমূহ

হাসান বসরি রাহ. এর অনুপ্রেরণামূলক ও আত্মশুদ্ধিমূলক উক্তিসমূহ, ইলমের দুনিয়ায় এক উজ্জ্বল নাম হাসান বসরি রাহ.। তিনি পূর্বেকার যুগের প্রখ্যাত আলিম এবং দুনিয়াবিমুখ ব্যক্তি। তার শিক্ষা ও উক্তিগুলো সময়ের পরিক্রমা ভেদ করে বর্তমানের মুসলিমদেরও সমানভাবে উপকৃত করে যাচ্ছে। 

এই রচনায় আমরা হাসান বসরি রা.-এর বিভিন্ন অনুপ্রেরণামূলক ও আত্মশুদ্ধিমূলক উক্তিগুলো পড়ব। যে উক্তিগুলোর প্রতিটিই আমাদের জীবনকে বদলে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। উক্তিগুলোতে খুঁজে পাব তার গভীর অন্তর্দৃষ্টি এবং নিরবধি শিক্ষার প্রতিফল। তার মূল্যবান কথামালাগুলো আমাদের জীবনে তাঁর প্রজ্ঞার প্রয়োগ করতে উৎসাহিত করে।

হাসান বসরি রাহ. এর অনুপ্রেরণামূলক ও আত্মশুদ্ধিমূলক উক্তিসমূহ

প্রতিটি উক্তি চয়ন করা হয়েছে হাসান বসরি রাহ.-এর শিক্ষার ভাণ্ডার থেকে। সেখান থেকে আময়রা ইমান, ধার্মিকতা, আত্ম-প্রতিফলন এবং একটি অর্থপূর্ণ জীবনযাপন পরিচালনার বিভিন্ন দিক অনুসন্ধান করব। এই অনুসন্ধানের জন্য নির্বাচিত প্রতিটি উক্তি তার সুগভীর জ্ঞানের সারমর্মকে ধারণ করে, যা তার আধ্যাত্মিকতার গভীরতার একটি আভাস দেয় এবং আধুনিক বিশ্বের চ্যালেঞ্জগুলি অতিক্রম করার ক্ষেত্রে তার নির্দেশনার তাৎপর্য তুলে ধরে।

  • হাসান বসরি রাহ. বলতেন, ‘কিছু বিষয়ে খুব সতর্ক থাকবে। কারণ, অনেক সময় মানুষ অজ্ঞাতসারে এমন খাবার গ্রহণ করে, এমন গৃহে প্রবেশ করে কিংবা এমন মজলিসে যোগদান করে; যার কারণে নিজের অজান্তেই তাঁর দ্বীন চলে যায়।
  • তিনি বলতেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ তাআলার জন্য ইলম অর্জন করে, খুব দ্রুত তার আল্লাহভীতি, দুনিয়াবিমুখতা ও বিনম্রতার মাধ্যমে ওই ইলমের প্রকাশ ঘটে।’
  • তাঁকে বলা হল, ‘মনুষ্যত্ব কি?’ তিনি বললেন, ‘লোভ না করা – কারণ, লোভ লাঞ্ছনা ডেকে আনে। আর অন্যের কাছ হাত না পাতা – কারণ, হাত পাতলে ইজ্জত কমে যায়।’
  • তিনি বলতেন, ‘চারটি বিষয় যার মাঝে থাকবে সে পরিপূর্ণ, আর যার মাঝে একটি থাকবে সে তার সম্প্রদায়ের ভালো লোকদের মধ্যে গণ্য হবে। সেগুলো হল, এক. দ্বীন – যা তাকে পথ প্রদর্শন করবে। দুই. বিবেক – যা তাকে সঠিক পথের ওপর রাখবে। তিন. বংশমর্যাদা – যা তাকে অনেক অনৈতিক কাজ থেকে বিরত রাখবে। চার. লজ্জা – যা তাকে সম্মানিত করবে।’
  • তিনি বলতেন, ‘হে মানুষ, তুমি হলে কিছু দিনের সমষ্টি। তোমার একটি দিন চলে গেল মানে তোমার একটি অংশ চলে গেল।’
  • তিনি বলতেন, ‘আল্লাহ তাআলা ইবনু মাসউদ রা.-এর ওপর রহমত বর্ষণ করুন। কেমন যেন তিনি তোমাদের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করেই বলেছিলেন, “তোমাদের দুনিয়াবিমুখরা হবে দুনিয়ামুখী, মুজতাহিদরা হবে ভুলকারী এবং আলিমরা হবে জাহিল।” 
  • তিনি বলতেন, ‘যে আল্লাহ তাআলাকে ভয় করে, আল্লাহ তাআলা অন্য সকল কিছুর মধ্যে তার ভয় সৃষ্টি করে দেন। আর যে মানুষকে ভয় করে, আল্লাহ তাআলা তার অন্তরে প্রতিটি জিনিসের প্রতি ভয় সৃষ্টি করে দেন।’
  • তিনি বলতেন, ‘রাসুল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
  • “আমার উম্মতের আবদালগণ অধিক নামাজ বা রোজার মাধ্যমে জান্নাতে প্রবেশ করবে না; বরং তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে আল্লাহ তাআলার রহমত, মনের উদারতা, হৃদয়ের স্বচ্ছতা ও সকল মুসলিমের প্রতি দয়ার কারণে।”
  • তিনি বলতেন, ‘বিচক্ষণ ব্যক্তি হাজার ব্যক্তির ভালোবাসার বিনিময়েও একজনের শত্রুতা ক্রয় করে না। কারণ, যে এমনটি করে, সে ক্ষতিগ্রস্ত ও ব্যর্থ।’
  • তিনি বলতেন, ‘ভদ্র ব্যক্তির সম্মান হলো তার শিষ্টাচার এবং তার গৌরব হলো তার তাকওয়া।
  • তিনি বলতেন, ‘যে তার ভাইকে এমন কোনো গুনাহের ব্যাপারে অপবাদ দেয়, যা থেকে সে আল্লাহ তাআলার কাছে তাওবা করেছে, তার থেকে ওই গুনাহ প্রকাশ হওয়া ব্যতীত তার মৃত্যু হবে না।’
  • তিনি বলতেন, ‘যদি ইলম না থাকত, তবে মানুষ চতুষ্পদ জন্তুর ন্যায় হয়ে যেত।’
  • তিনি বলতেন, ‘যার চরিত্র নষ্ট, সে নিজেকে নিজে শাস্তি দেয়। যার সম্পদ বেশী, তার গুনাহ বেশী। আর যে বেশী কথা বলে, তার পদস্খলন বেশী হয়।’
  • তিনি বলতেন, ‘সালাফে সালিহিন তোমাদেরকে শিষ্টাচার ও উত্তম চরিত্র শিখিয়েছেন। সুতরাং তোমরা তা শিখে নাও। আল্লাহ তোমাদের প্রতি দয়া করুন।’
  • তিনি বলতেন, ‘এমন ব্যক্তির মতো হয়ো না, যে আলিমদের ইলম জমা করে এবং জ্ঞানীদের প্রজ্ঞাপূর্ণ বাণী সংগ্রহ করে, কিন্তু নির্বোধদের মতো এগুলোর চাহিদা অনুযায়ী আমল করে না।’
  • তিনি বলতেন, ‘ইলম সর্বোত্তম সম্পদ, শিষ্টাচার সর্বোত্তম বন্ধু, তাকওয়া শ্রেষ্ঠ পাথেয়, ইবাদত অধিক লাভজনক পণ্য, বুদ্ধিমত্তা উত্তম প্রতিনিধি, উত্তম চরিত্র শ্রেষ্ঠ সঙ্গী, সহনশীলতা সর্বশ্রেষ্ঠ সহকারী, অল্পেতুষ্টি উত্তম ধনাঢ্যতা, তাওফিক সবচেয়ে বড় সহকারী এবং মৃত্যুর স্মরণ সর্বোৎকৃষ্ট উপদেশদাতা।’
  • তিনি বলতেন, ‘ক্যান্সার একজন ব্যক্তির শরীরকে যত দ্রুত খেয়ে ফেলে, হিংসা একজন মুসলিমের দ্বীনদারিতাকে তার চেয়ে অধিক দ্রুত খেয়ে ফেলে।’
  • তিনি বলতেন, ‘বুদ্ধিমান ও বিচক্ষণ মুমিন সে, যার প্রতি আল্লাহ তাআলার অনুগ্রহ বৃদ্ধি পেলে আল্লাহর প্রতি তার ভয়ও বৃদ্ধি পায়।’
  • তিনি বলতেন, ‘উত্তম প্রতিবেশী হওয়া মানে প্রতিবেশীকে কষ্ট দেওয়া থেকে বিরত থাকা নয়; বরং উত্তম প্রতিবেশী হওয়ার অর্থ হলো প্রতিবেশীর দেওয়া কষ্ট সহ্য করা।’
  • তিনি বলতেন, ‘যার মাঝে মনুষ্যত্ব নেই, তার মাঝে দ্বীনদারি নেই।’
  • তাঁকে জিজ্ঞেস করা হলো, ‘শ্রেষ্ঠ চরিত্র কোনটি?’ তিনি বললেন, ‘দানশীলতা ও সত্যবাদিতা।’
  • তিনি বলতেন, ‘হে আদমসন্তান, কোন জিনিস তোমাকে দুর্বল করে দিয়েছে এবং তোমার গাফিলতি বাড়িয়ে দিয়েছে? তা হলো, তুমি মানুষের গুনাহ ও দোষ-ত্রুটি নিয়ে ব্যস্ত, অথচ নিজের কথা বেমালুম ভুলে আছ। তুমি তোমার ভাইয়ের চোখের সামান্য ধুলোবালিও দেখতে পাও, কিন্তু নিজের চোখের খড়-কুটাও দেখতে পাও না! কী সেই বস্তু, যা তোমার ইনসাফকে এত কমিয়ে দিল এবং অন্যায়কে এত বাড়িয়ে দিল?’
  • তিনি বলতেন, ‘হে আদমসন্তান, তোমার জন্য সবর করা একান্ত আবশ্যক। অন্যথায় তুমি ধ্বংস হয়ে যাবে।’
  • তিনি বলতেন, ‘যাকে সন্তুষ্টির নিয়ামত দেওয়া হয়েছে স্বল্প খাবার তার জন্য যথেষ্ট। আর যার জন্য স্বল্প খাবার যথেষ্ট, সে কষ্টের ওপর সবর করতে পারে।’
  • তিনি বলতেন, ‘হে আদমসন্তান, আল্লাহ তাআলা কর্তৃক নিষিদ্ধ বিষয়গুলো থেকে বেঁচে থাকলে আবিদ (ইবাদতগুজার) হবে। আল্লাহ তাআলা কর্তৃক বণ্টিত বিষয়ে সন্তুষ্ট থাকলে ধনী হবে। প্রতিবেশীর প্রতি সদাচরণ করলে মুমিন হবে। নিজের জন্য যা পছন্দ করো, মানুষের জন্যও তা পছন্দ করলে ন্যায়পরায়ণ হবে। আর অল্প হাসবে; বেশী হাসলে হৃদয় মরে যায়।’
  • তিনি বলতেন, ‘ভাই থেকে লাভের চিন্তা করা মনুষ্যত্ব পরিপন্থী কাজ।’
  • তিনি বলতেন, ‘সৎ লোক যথাসময়তে ওয়াদা পালন করে, আর মন্দ লোক ওয়াদা পালনে বিলম্ব করে।’
  • তিনি বলতেন, ‘আল্লাহ তাআলা চাইলে তোমাদের সবাইকে ধনী বানাতে পারতেন। আবার চাইলে সবাইকে দরিদ্র বানাতে পারতেন। কিন্তু তিনি তোমাদের কতকের মাধ্যমে কতককে পরীক্ষা করেন; যেন তোমাদের কর্মগুলো তিনি প্রত্যক্ষ করতে পারেন।’
  • তিনি বলতেন, ‘একজন মুসলিমের প্রয়োজন পূরণ করা আমার কাছে এক মাসের ইতিকাফ থেকে উত্তম।’
  • তিনি বলতেন, ‘ভয়ের পর নিরাপত্তা পাওয়া নিরাপত্তার পর ভয় পাওয়ার চেয়ে উত্তম।’
  • তাঁকে বলা হলো, ‘মানুষের মাঝে ব্যবসায় সবচেয়ে বড় ক্ষতিগ্রস্ত করে?’ তিনি বললেন, ‘যে স্থায়ী জিনিসকে (আখিরাতকে) অস্থায়ী জিনিসের (দুনিয়ার বিনিময়ে বিক্রি করেছে)।’
  • তিনি বলতেম, ‘হাসান বিন আলি রা.-কে বলা হলো, “মানুষের মাঝে সর্বোচ্চ সম্মানের অধিকারী কে?” তিনি বললেন, “দুনিয়াপ্রেমিকদের হাতের মুঠোয় দুনিয়া দেখেও যে তার প্রতি ভ্রুক্ষেপ করে না।”
  • তাঁকে বলা হলো, ‘মানুষের মাঝে মর্যাদায় শ্রেষ্ঠ কে?’ তিনি বললেন, ‘যার অন্তরে দুনিয়ার প্রতি কোনো মূল্য নেই।’

জীবনঘনিষ্ঠ এই উক্তিসমূহ শুধু আপন মনে পড়ে গেলেই হবে না, নিজেদের জীবনে বাস্তবায়নও করতে হবে। আল্লাহ আমাদের সকলকে সেই তাওফিক দান করুন, আমিন।

 

রেফারেন্সঃ

উক্তিগুলো নেওয়া হয়েছে ইবনুল জাওজি রাহ. কর্তৃক লিখিত এবং রুহামা পাবলিকেশন থেকে প্রকাশিত ‘নববি শিষ্টাচার ও দুনিয়া-বিমুখতার মূর্তপ্রতীক হাসান বসরি রাহ.’ গ্রন্থ থেকে। 

 

By মেহেজাবীন শারমিন প্রিয়া

My name is Mahazabin Sharmin Priya, and I am an author who studied Mathematics at the National University. I have a deep passion for writing in various genres, including Islam, technology, and mathematics. With my knowledge and expertise, I strive to provide insightful and engaging content to readers in these areas.

Related Post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *