বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা, প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের কবর ও মুক্তিযুদ্ধে তাঁর ভূমিকা নিয়ে বিতর্ক তুলে সরকার আসলে কী চায় সেটি এখনো স্পষ্ট নয় বিএনপির কাছে। তাই ওই সব ইস্যুতে দলটি এখনই কঠোর কোনো অবস্থান নেবে না। বরং সতর্ক থেকে বিএনপি এর জবাব দেবে।
দলটির বেশির ভাগ নেতারই সন্দেহ, আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে দুই বছর আগেই বিএনপিকে মাঠে নামানোর জন্য জিয়ার কবর নিয়ে রাজনীতি সামনে আনা হতে পারে। কেউ কেউ একে বিএনপির জন্য ফাঁদ বলেও মনে করেন। তাঁদের মতে, বিএনপি এখনই আন্দোলন শুরু করলে আবারও মামলা-হামলা করে দুই বছর আগেই ঘরে ঢোকানোর কৌশল নেবে সরকার। কারণ, এমনটি করা গেলে সরকার নির্বিঘ্নে নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে পারবে বলে মনে করেন তাঁরা।
জানা গেছে, এমন সন্দেহের কারণেই বিএনপি এখনই আন্দোলনে যাবে না। বরং পরিস্থিতির দিকে নজর রেখে সরকারি দলের নেতাদের বক্তব্যের পাল্টা জবাব দেবে। আজ শনিবার বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে আলোচনার পর দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের এ বিষয়ে দলের সর্বশেষ অবস্থান ব্যাখ্যা করার কথা রয়েছে।
একটি সূত্র থেকে জানা গেছে, জিয়াউর রহমানের কবর নিয়ে রাজনীতিসহ নানা ইস্যুতে দলটি বিক্ষোভ-সমাবেশ কর্মসূচি ঘোষণা করতে পারে।
২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোর মধ্যস্থতায় আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নির্বাচন প্রশ্নে সমঝোতায় আসতে ব্যর্থ হয়। ওই সময় বিএনপি নির্বাচন ঠেকানোর চেষ্টা করেও সফল হতে পারেনি। পরে সরকারের এক বছর পূর্তিতে বিএনপিসহ এর নেতৃত্বাধীন জোট আবারও লাগাতার অবরোধের কর্মসূচি পালন করে। এসব ঘটনার সূত্র ধরে ২০২০ সাল পর্যন্ত দলটির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে সরকার মোট এক লাখ ৫৯৩টি মামলা দায়ের করে। এসব মামলায় মোট আসামি করা হয়েছে ৩৫ লাখ ৭৪ হাজার ৯৮৯ জনকে। গত এক যুগে বিএনপির মোট এক হাজার ৫২৬ জন খুন ও ৪২৩ জন গুমের শিকার হয়েছেন বলে দলটি কেন্দ্রীয় তথ্য সংরক্ষণ সেল দাবি করেছে। তাদের হিসাবে গত এক যুগে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর হাতে দলটির মোট ১১ হাজার ১২৬ জন নেতাকর্মী ও সমর্থক গুরুতর আহত হয়েছেন।
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সরকারের উদ্দেশ্য নিয়ে আমাদের সন্দেহ আছে। আসলে তারা কী চায় সেটি স্পষ্ট নয়। কারণ জিয়াউর রহমানের কবর সরানোর কথা তারা আগেও বলেছে।’ তিনি বলেন, ‘জিয়াউর রহমানের অবদানকে ছোট করতে চাইলেও সেটি জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। আর তাঁর কবর সরানো হলে বিএনপি বসে থাকবে এটি ভাবারও কোনো কারণ নেই।’
দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সরকার অনেকভাবে বিএনপিকে উসকানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু বিএনপি সতর্ক আছে।’ তিনি বলেন, ‘জিয়াউর রহমানের কবর এবং মুক্তিযুদ্ধে তাঁর ভূমিকা নিয়ে সরকার নোংরা রাজনীতির খেলায় মেতেছে। কিন্তু তাদের সে রাজনীতি জনগণের কাছে কখনোই গ্রহণযোগ্য হবে না।’
দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু মনে করেন, ‘সরকারবিরোধী আন্দোলন দমিয়ে রাখতে বিএনপিকে চাপে রাখার কৌশল হিসেবে সরকার জিয়াউর রহমানের কবরের ইস্যু সামনে আনতে পারে। আবার এটি তাদের সকল অপকর্ম ও ব্যর্থতা আড়াল করার চেষ্টাও হতে পারে।’
জিয়াউর রহমানের কবরে লাশ নেই, মুক্তিযুদ্ধে জিয়া একটিও গুলি ছোড়েননি, বঙ্গবন্ধু হত্যায় তিনি জড়িত ছিলেন—সরকারি দল আওয়ামী লীগের তৈরি করা এমন নানা ইস্যুতে গত কয়েক সপ্তাহ ধরেই আওয়ামী লীগ-বিএনপির পাল্টাপাল্টি বক্তব্য চলছে। এমন আলোচনায় সুধীসমাজের অনেকেও জড়িয়েছেন।
গণস্বাস্থ্যের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর মতে, ‘জিয়ার কবরসহ নানা ইস্যু তুলে বিএনপিকে সরকার আগাম মাঠে নামাতে চাইছে। উদ্দেশ্য হলো—মাঠে নামলে যেন তারা মামলা দিতে পারে। সবাইকে জেলে পুরে আবারও একতরফা নির্বাচন করতে চায় তারা। তবে আমি মনে করি, বিএনপির এই ফাঁদে পা দেওয়াটা ঠিক হবে না।’
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি গত ২ আগস্ট এক বত্তব্যে সরকারের ‘ষড়যন্ত্রে’ পা না দেওয়ার জন্য বিএনপির প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। জিয়াউর রহমানকে কেন্দ্র করে সরকারের সমালোচনাকে ‘ষড়যন্ত্র’ বলে আখ্যায়িত করে তিনি বলেন, ‘জিয়াউর রহমানের কবর বা উনি গুলি ছুড়েছেন কি না এ তর্কের মধ্যে আপনারা যাবেন না। আপনারা সামনের দিকে তাকান। সামনের নির্বাচনে যাতে কেউ ভোট চুরি করতে না পারে তার প্রস্তুতি নিন।’
জিয়াউর রহমানের কবর নিয়ে আলোচনার মধ্যেই গত বুধবার হঠাৎ করে বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠক ডেকে পরিস্থিতি পর্যালোচনা করা হয়। বৈঠকে বেশির ভাগ নেতাই মত দেন যে জিয়াউর রহমানের কবর ও তাঁকে নিয়ে আওয়ামী লীগের এই রাজনীতি নতুন কিছু নয়। এ প্রসঙ্গে তাঁরা এর আগে ২০১৪ সালের এক বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য এবং একই বছর গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাব নিয়েও কথা বলেন।
ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘পাকিস্তান সরকারের পরিকল্পনায় লুই কান দুটি নকশা করেছিলেন। একটি হলো পাকিস্তানের সেকেন্ড ক্যাপিটাল, যেটি আইয়ুবনগর নামে পরিচিত (আজকের শেরেবাংলানগর); আরেকটি হলো সংসদ ভবন, যেটির নকশা পাকিস্তানের জাতীয় পতাকার আদলে করা হয়েছিল। কিন্তু স্বাধীনতার পরে লুই কানের দুটি নকশাই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেছে। তাই নকশার কথা বলে জনগণকে বিভ্রান্ত করা যাবে না।’