কোরআনে কারিমের সুরা নিসার ৩ নম্বর আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, ‘আর তোমরা যদি আশঙ্কা করো যে, এতিমদের প্রতি সুবিচার করতে পারবে না, তবে বিবাহ করো (স্বাধীন) নারীদের মধ্যে যাকে তোমাদের ভালো লাগে; দুই, তিন অথবা চার। আর যদি আশঙ্কা করো যে, সুবিচার করতে পারবে না, তবে একজনকে (বিবাহ করো) অথবা তোমাদের অধিকারভুক্ত (ক্রীত অথবা যুদ্ধবন্দিনী) দাসীকে (স্ত্রীরূপে ব্যবহার করো)। এটাই তোমাদের পক্ষপাতিত্ব না করার অধিকতর নিকটবর্তী।’
এই আয়াতের তাফসির প্রসঙ্গে হজরত আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেন, বিত্তশালী এবং রূপ-সৌন্দর্যের অধিকারী এতিম মেয়ে কারো তত্ত্বাবধানে থাকলে, সে তার সম্পদ ও সৌন্দর্য দেখে তাকে বিয়ে করে নিত, কিন্তু তাকে অন্য নারীদের ন্যায় সম্পূর্ণ মোহর দিত না। মহান আল্লাহ এমন অবিচার করতে নিষেধ করে বলেন, যদি তোমরা ঘরের এতিম মেয়েদের সঙ্গে সুবিচার করতে না পারো, তাহলে তাদের বিয়েই করবে না। অন্য মেয়েদের বিয়ের পথ তোমাদের জন্য খোলা আছে। এমনকি একের পরিবর্তে দু’জন, তিনজন এবং চারজন পর্যন্ত মেয়েকে তোমরা বিয়ে করতে পারো। তবে শর্ত হলো, তাদের মধ্যে সুবিচার করতে হবে। সুবিচার করতে না পারলে, একজনকেই বিয়ে করো অথবা অধিকারভুক্ত ক্রীতদাসী নিয়েই তুষ্ট থাকো।
আবার একই সুরার ১২৯ নম্বর আয়াতে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা কখনো স্ত্রীদের মধ্যে সুবিচার করতে পারবে না যদিও তোমরা তা কামনা করো।’ আল্লাহতায়ালা পরবর্তী আয়াত দ্বারা কী বোঝাতে চাইছেন?
ইসলামি স্কলারদের মতে, বিয়ে একটা চুক্তি। যার মাধ্যমে একজন নারী এবং একজন পুরুষের মধ্যে একটি বৈধ সম্পর্ক স্থাপিত হয়। আর প্রত্যেকটি সম্পর্কের মতো এই সম্পর্ক কিছু দায়িত্বের জন্ম দেয়। স্বামীর প্রতি স্ত্রীর যেমন দায়িত্ব ও কর্তব্য আছে, তেমনি স্ত্রীর প্রতিও স্বামীর দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে।
বিয়ের মাধ্যমে পরিবার গঠিত হয়। স্বামী-স্ত্রী যেমন পরিবারের অংশ, সন্তান ও তাদের লালন-পালনও পরিবারের আরেকটি অংশ। পরিবারের দায়িত্ব ও কর্তব্য স্বামী বা স্ত্রীর একার নয়; বরং এটা একটা যৌথ প্রচেষ্টায় নির্মিত সুনিয়ন্ত্রিত সামাজিক প্রতিষ্ঠান। বিয়ের মাধ্যমে স্ত্রী স্বামীর অভিভাবকত্ব মেনে নিয়ে তার প্রতি সৌহার্দ্য ও বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করে।
অতএব একাধিক বিয়ে কেবল আরেকজন স্ত্রী গ্রহণের আরেকটি অনুষ্ঠান নয় বরং অতিরিক্ত দায়িত্ব। এটি আল্লাহ শুধু দায়িত্ববান এবং শারীরিক, আর্থিক, মানসিক সক্ষমতা সম্পন্নদের জন্য জায়েজ করেছেন।
অতএব সুরা নিসার ১২৯ নম্বর আয়াতটি সৃষ্টিকর্তার থেকে সতর্কবাণীরূপে নাজিল হয়েছে। আল্লাহ আমাদের সৃষ্টিকর্তা। তিনি জানেন তার সৃষ্টি কেমন; তাই হুকুমের সঙ্গে সঙ্গে সতর্ক করেছেন। আর ন্যায়বিচারের কথা ৩ নম্বর আয়াতে বলেছেন। এখন প্রশ্ন হলো, ন্যায়বিচার অর্থ কী? ন্যায়বিচার অর্থ কী শুধু ভরণপোষণ আর জৈবিক চাহিদা পূরণ, নাকি আরও কিছু? ন্যায়বিচার হলো, আর্থিকভাবে যেমন স্ত্রীকে সহযোগিতা করা, তেমনি তার জৈবিক, মানসিক, সামাজিক ও পারিবারিক চাহিদাগুলো পূরণ করা। স্ত্রী যদি একাধিক হয়; তাহলে প্রত্যেকের এই অধিকারগুলো নিশ্চিত করা স্বামীর কর্তব্য।
অন্তরের দিক থেকে কারও দিকে বেশি ঝুঁকে পড়লে আল্লাহ পাকড়াও করবেন না; কারণ এটা মানুষ চাইলেও নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম নয়। তবে নিজ ইচ্ছায় কিংবা বাহ্যিক আচার-আচরণে এটা প্রকাশ করা যাবে না। সুবিচারপূর্ণ আচরণ করতে হবে সবার সঙ্গে। একজনের প্রতি বেশি ঝুঁকে পড়ে, অপরজনের প্রতি আসক্তিহীন হওয়ার দিকে আল্লাহ সতর্ক করছেন। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যার দুই স্ত্রী রয়েছে, কিন্তু একজনের দিকেই সম্পূর্ণরূপে ঝুঁকে পড়েছে, সে কিয়ামতের দিন এমন অবস্থায় উঠবে যে, তার শরীরের অর্ধেক অংশের গোশত খসে পড়বে।’ আবু দাউদ : ৩২২
বহু বিয়ে আল্লাহতায়ালা জায়েজ করেছেন, কিন্তু এর সঙ্গে জড়িত আছে অতিরিক্ত দায়িত্ব। আর সেই সঙ্গে দায়িত্ব গ্রহণ করার আগে সতর্কবাণী দেওয়া হয়েছে। সুতরাং যার পক্ষে সম্ভব, সে এই দায়িত্ব নেবে আর যার পক্ষে সম্ভব নয়, সে বিরত থাকবে।
ইসলাম বহু বিয়েকে শুধু নিরুৎসাহিত করেনি, নিয়ন্ত্রণেও এনেছে। ঐতিহাসিক তথ্য হচ্ছে, একজন পুরুষের একাধিক স্ত্রী রাখার প্রচলন ইসলামপূর্ব বহুযুগ থেকে চলে এসেছে। দুনিয়ার প্রায় সব ধর্মেই বহু বিয়ে বৈধ মনে করা হতো। এমনকি বিয়ে না করেই নারীদের অমর্যাদাকরভাবে দাসী, উপপতœী বানিয়ে রাখার প্রচলন ছিল। ইতিহাস গবেষণায় দেখা যায়, রোম, পারস্য, আরব, পাক-ভারত, ইরান, মিসর, ইউনান ও অস্ট্রিয়াসহ বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন জাতির মধ্যে বহু বিয়ের প্রচলন ছিল। এ ‘বহু’র কোনো সীমারেখা ছিল না।ইসলামপূর্ব যুগে বহু বিয়ের কোনো সীমারেখা না থাকায় এক একজন পুরুষের শতাধিক নারী থাকার তথ্যও পাওয়া যায়। পাদ্রি ফিকস জন মিলটন ও আইজ্যাক টেইলরসহ অনেকেই বলিষ্ঠ ভাষায় এ তথ্য সমর্থন করেছেন। ষোড়শ শতাব্দী পর্যন্ত জার্মানিতে বহুবিবাহের ব্যাপক প্রচলন ছিল। কনস্টান্টিনোপলের সম্রাটের স্ত্রী সংখ্যা ছিল অগণিত। এ প্রবণতা ছিল তার উত্তরাধিকারীও। বৈদিক শাস্ত্রেও বহু বিয়ের বৈধতা ছিল। এতে একই সময় দশ, পনেরো, এমনকি সাতাশ জন পর্যন্ত নারীকে বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ রাখার তথ্য পাওয়া গেছে।
ইসলামের প্রাথমিক যুগেও বহু বিয়ের প্রথা প্রচলিত ছিল। সাহাবিদের কারও কারও চারের বেশি স্ত্রী ছিল। একপর্যায়ে বহু বিয়ের কারণে নারীদের অধিকার খর্ব হচ্ছে কি-না এটা নিয়ে আলোচনা পর্যালোচনা জোরদার হয়। সেই সময়ে ইসলাম ধর্মীয় মনীষীদের অধিকাংশই বহু বিয়ের কারণে নারীরা অপমানিত ও অধিকারবঞ্চিত হয় মর্মে মত দেন। তাদের মতামত ও সিদ্ধান্তক্রমে বহু বিয়েকে নিয়ন্ত্রণে আনা শুরু হয়। পরবর্তী সময়ে পবিত্র কোরআনের চিরন্তন বিধানেও প্রসঙ্গটি এসেছে।
পবিত্র কোরআনে বহু বিয়েকে একেবারে অবৈধ না করে একটি সীমারেখা (চারজন) নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। তাও যথেচ্ছ নয়, এর সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছে কিছু শর্ত। সেখানে বলা হয়েছে, তোমরা সমভাবে ওই চারজনের (একাধিক) যথাযথ হক আদায় করবে। আর এ সমতা বজায় রাখার শক্তি সামর্থ্য না থাকলে একের অধিক স্ত্রী রাখা জুলুম বলে বিবেচিত হবে। এ নির্দেশিকার মধ্য দিয়ে ইসলামে একই সময়ে চারের অধিক স্ত্রী রাখা হারাম বলে ঘোষিত হয়। আর সমতার শর্তজুড়ে দেওয়ার মধ্য দিয়ে একই সঙ্গে বহু বিয়ের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়েছে এবং একে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে।
ইসলাম মতে, পুরুষের একাধিক স্ত্রী রাখার জন্য শর্ত হলো স্ত্রীদের সবার মধ্যে সমতা রক্ষা করতে হবে। সমতা বিধান করতে না পারলে একজন স্ত্রী নিয়ে থাকতে হবে। একের বেশি তার জন্য হালাল নয়। এক হাদিসে উল্লেখ রয়েছে, হজরত গায়লান (রা.) যখন মুসলমান হন তখন তার দশজন স্ত্রী ছিলেন। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) তাকে চারজন রেখে বাকিদের তালাক প্রদানের নির্দেশ দেন। এভাবে নাওফেল (রা.) যখন ইসলাম গ্রহণ করেন, তখন তার পাঁচ স্ত্রী ছিল। নবী কারিম (সা.) তাকে তাদের থেকে একজনকে তালাকের নির্দেশ দেন।
ইসলামে বহু বিয়েকে আবশ্যক করা হয়নি, শুধু শর্ত সাপেক্ষে অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এই অনুমতিকে কেন্দ্র করে ইসলাম বিরুদ্ধবাদীরা প্রায় তোপ দাগেন যে, ইসলামের অনুসারী মানেই অনেকগুলো স্ত্রী, আর বহু বিয়ে। অথচ বিষয়টি এমন নয়। অন্যদিকে অনেকে একাধিক বিয়ে করেন, কিন্তু শরিয়তের বিধান মানেন না। অর্থাৎ স্ত্রীদের প্রতি ন্যায়বিচার করেন না, সব স্ত্রীর প্রতি ন্যায্যতা দেখান না। তারা ইসলামের ভুল অনুশীলন করছেন। অথচ কোরআনে একাধিক বিয়ের ক্ষেত্রে ন্যায় রক্ষার কথা বলা হয়েছে বেশ শক্তভাবে।
এখানে একটি বিষয় পরিষ্কার হওয়া দরকার সেটা হলো শর্ত সাপেক্ষে হলেও ইসলাম পুরুষের জন্য একসঙ্গে একাধিক স্ত্রী রাখার বৈধতা দিয়েছে। এই বৈধতার পেছনে যুক্তিগুলো হলো স্ত্রী সন্তান দানে অক্ষম কিংবা অসুস্থ হওয়া, বিধবা নারীদের আশ্রয় ও নিরাপত্তা দেওয়া। এছাড়া পুরুষদের মধ্যে এমন কিছু ব্যক্তি রয়েছে, যাদের প্রবল শারীরিক চাহিদা বিদ্যমান, যাদের জন্য একজন স্ত্রী যথেষ্ট নয়। যদি এমন একজন ব্যক্তির জন্য একাধিক স্ত্রী গ্রহণের দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং তাকে বলা হয় যে তোমার জন্য একাধিক স্ত্রী রাখা অনুমোদিত নয়, তাহলে এটি তার জন্য কঠিন কষ্টের কারণ হবে এবং তার জৈবিক চাহিদা তাকে হারাম পথে পরিচালিত করবে।
বহু বিয়ের জন্য সামর্থ্য থাকা প্রয়োজন। আর্থিকভাবে একাধিক পরিবারকে চালানোর সামর্থ্য থাকতে হবে। এই সামর্থ্যরে ব্যাপারে যদিও অনেকে অনেক কথা বলে। তাই কোরআন-সুন্নাহর আলোকে জেনে কথা বলা প্রয়োজন। সামর্থ্যরে বাইরে কোনো কিছু ইসলামে কখনোই কাম্য নয়।
ইসলাম এই অনুমতিও দিয়েছে যে, স্বামী যদি চিররুগ্ন হয়ে পড়ে কিংবা পাগল হয়ে যায় কিংবা বয়সের কারণে যৌনকর্মে আসক্তিহীন হয়ে যায় সেক্ষেত্রে তার ঘর-সংসার করা কিংবা না করার ব্যাপারে স্ত্রীর স্বাধীনতা রয়েছে। সে ইচ্ছে করলে খুলা তালাক করিয়ে নিতে পারবে। আগের স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদের পর ইদ্দত শেষে অন্য স্বামী গ্রহণ করতে পারবে।