আগামী ৭ আগস্ট থেকে দেশের ইউনিয়ন পর্যায়ে করোনার টিকাদান কর্মসূচি শুরু হচ্ছে। এ সময় প্রতিটি ইউনিয়নে প্রতিদিন একটি কেন্দ্রে তিনটি বুথে ৬০০ জনকে টিকা দেওয়া হবে। সে হিসাবে দেশের ৪ হাজার ৫৭১ ইউনিয়নে প্রতিদিন ২৭ লাখ ৪২ হাজার ৬০০ মানুষ করোনার টিকা পাবে। অর্থাৎ প্রত্যেকটি ইউনিয়নে সাপ্তাহিক ছুটির দিন বাদে ছয় দিনে ১ কোটি ৬৪ লাখ ৫৫ হাজার ৬০০ মানুষ করোনার টিকা পাবেন।
এর বাইরে পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনের ১৫ হাজার ২৮৭টি ওয়ার্ডেও টিকা দেওয়া হবে। সিটি করপোরেশন এলাকায় ১৫ লাখের বেশি ও পৌরসভা এলাকায় ৮ লাখের মতো কর্মী টিকাদান কর্মসূচি পরিচালনা করবেন। এ জন্য প্রত্যেক ইউনিয়নে একটি করে টিম এবং পৌরসভার প্রত্যেক ওয়ার্ডে দুটি ও সিটি করপোরেশনের প্রত্যেক ওয়ার্ডে তিনটি করে টিম টিকাদান কর্মসূচি পরিচালনা করবে। এ সময় শহরাঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের মডার্না টিকা ও ইউনিয়নে চীনের সিনোফার্মের টিকা দেওয়া হবে।
ইউনিয়ন পর্যায়ে টিকা নিতে মানুষকে আগেভাগেই নিবন্ধন করতে হবে না। টিকা নিতে ইচ্ছুক মানুষ টিকাকেন্দ্রে গেলে তার জাতীয় পরিচয়পত্র দেখেই টিকা দেওয়া হবে। পরে কেন্দ্রেই টিকাগ্রহীতার নিবন্ধন করবেন টিকাকেন্দ্রের লোকজন।
এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম গতকাল বৃহস্পতিবার দেশ রূপান্তরকে বলেন, ৭ আগস্ট থেকে ইউনিয়ন পর্যায়ে টিকাদান শুরু। জাতীয় পরিচয়পত্র নিয়ে গেলেই হবে। আমরা সাধারণ টিকাদান কর্মসূচি যেভাবে করি, সেভাবে ব্লক হবে ও সে অনুযায়ী টিকা দেওয়া হবে। টিকার জন্য বয়সসীমা এখন ২৫ বছর করা হয়েছে। আস্তে আস্তে ১৮ বছর করা হবে।
এর আগে গত ২৭ জুলাই ইউনিয়ন পর্যায়ে করোনার টিকাদান শুরুর সিদ্ধান্তের কথা জানায় সরকার। সেদিন করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ ও লকডাউন নিয়ে সচিবালয়ে সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে এক বৈঠকের পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, সরকার ইউনিয়ন পর্যায়ে আগামী ৭ আগস্ট থেকে টিকাদান কার্যক্রম শুরু করবে।
সেদিন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আরও বলেন, টিকা কার্যক্রম জোরদার করতে প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা দিয়েছেন। এনআইডি কার্ড নিয়ে যে যাবেন, তাকেই টিকা দেওয়া হবে। যাদের জাতীয় পরিচয়পত্র নেই, তাদের ‘বিশেষ ব্যবস্থায়’ কভিড টিকা দেওয়া হবে বলে মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম জানান। এ সময় স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক, মন্ত্রিপরিষদ সচিবসহ সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
ইউনিয়ন পর্যায়ে টিকাদান কর্মসূচি শুরুর প্রস্তুতির ব্যাপারে করোনার টিকা বিতরণ ও ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য সচিব ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মাতৃ, নবজাতক ও শিশু স্বাস্থ্য কর্মসূচির পরিচালক ডা. শামসুল হক গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে দেশ রূপান্তরকে বলেন, পুরো কর্মসূচি এখনো সাজানো শেষ হয়নি। আশা করছি আগামী রবিবারের মধ্যে শেষ হবে।
এই কর্মকর্তা বলেন, ইউনিয়ন পর্যায়ে লোকজন টিকা নিতে পারবেন। যারা টিকা নিতে আসবে, তাদের জাতীয় পরিচয়পত্র দিয়ে টিকা নিতে হবে এবং সেই পরিচয়পত্র দিয়েই নিবন্ধন করা হবে। নিবন্ধন করলে আমরা বুঝতে পারব কতজন টিকা নিল।
এই কর্মকর্তা বলেন, প্রতিদিন এক কেন্দ্রের তিনটি বুথে ৬০০ জনকে টিকা দেওয়া হবে। তার মানে ৬০০ মানুষের নিবন্ধন হয়ে গেল। আবার পরের দিন। এক দিনে একেকটা ইউনিয়নে ৬০০ মানুষকে টিকা দেওয়া হবে। এর বেশি সম্ভব নয়। তারপর ওয়ার্ড, পৌরসভা, সিটি করপোরেশনেও টিকা দেওয়া চলবে।
ইউনিয়ন পর্যায়ে প্রয়োজনীয় মানুষের টিকা নিশ্চিত করতে বয়স ২৫ বছর নির্ধারণ করা হয়েছে বলে জানান এই কর্মকর্তা। তিনি বলেন, এতে টিকার ওপর চাপ পড়বে। তবে টিকা আসবে, সেভাবে আস্তে আস্তে টিকা দেওয়া হবে। টিকার মজুদের ওপর নির্ভর করবে কী পরিমাণ টিকা দেওয়া হবে। নিবন্ধন করা থাকলে সুবিধা আছে। এতে যেমন টিকার চাহিদার বিষয়টা বোঝা যায়, তেমনি অনেকে টিকা নিতে না এলে তখন নিবন্ধন করা আছে এমন মানুষকে টিকা দিতে পারব।
ইউনিয়ন পর্যায়ে চীনের সিনোফার্মের টিকা দেওয়া হবে বলেও জানান এই কর্মকর্তা।
এখন ২৫ বছর, ৮ আগস্ট থেকে ১৮ বছর বয়সীদের নিবন্ধন শুরু : টিকার নিবন্ধনের জন্য সরকার বয়স কমিয়ে ২৫ বছর করেছে। আগামী ৮ আগস্ট থেকে ১৮ বছরের বেশি নাগরিকরাও নিবন্ধন করতে পারবেন। গতকাল করোনাভাইরাসের টিকার জন্য সরকারের সুরক্ষা অ্যাপে গিয়ে দেখা গেছে, কভিড নিবন্ধন ফরমে নাগরিক নিবন্ধনের ঘরটিতে ২৫ বছর বা তার বেশি বয়সীদের নিবন্ধনের সুযোগ রয়েছে। এর আগে শুরুতে শুধু ৪০ বছরের বেশি বয়সীদের কভিড-১৯ টিকা দেওয়া হচ্ছিল। পরে এই বয়সসীমা কমিয়ে ৩০ বছরে আনা হয়। গতকাল তা আরও কমিয়ে ২৫ বছর করা হয়।
এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম দেশ রূপান্তরকে বলেন, সবাইকে টিকার আওতায় আনতে ধারাবাহিকভাবে বয়সসীমা কমিয়ে আনা হচ্ছে। আমরা আইসিটি বিভাগকে বলেছি টিকার নিবন্ধনের জন্য বয়সসীমা ১৮ বছর পর্যন্ত করার জন্য। এটা তারা ধাপে ধাপে করছে। প্রথমে ৪০ থেকে ৩৫ করা হয়েছে, পরে ৩৫ থেকে ৩০ বছর। এখন আবার ২৫ বছর পর্যন্ত করেছে। তারা বলছে, একবারে ১৮ বছর পর্যন্ত করে দিলে তাদের ওপর চাপ পড়বে। এজন্য ধীরে ধীরে বয়সসীমা কমাচ্ছে।
এ ব্যাপারে মহাপরিচালক জানান, ১৮ বছর ও তদূর্ধ্বরা আগামী ৮ আগস্ট থেকে টিকার জন্য নিবন্ধন করতে পারবেন। যাদের জাতীয় পরিচয়পত্র নেই, তারা স্থানীয় জনপ্রতিনিধির কাছ থেকে প্রত্যয়নপত্র নিয়ে স্থানীয় টিকাদান কেন্দ্রে গেলেই টিকা নিতে পারবেন।
গত ২৭ জানুয়ারি টিকার জন্য নিবন্ধন শুরু হয়। তখন শুধু ৪০ বছর বা এর বেশি বয়সীরা নিবন্ধনের সুযোগ পাচ্ছিলেন। মাঝে টিকার সংকট চললে বয়সসীমা আর বাড়ানো হয়নি। নতুন টিকা আসার পর গত ৫ জুলাই আগের চেয়ে আরও পাঁচ বছর কমিয়ে টিকার নিবন্ধনের জন্য যোগ্যদের বয়স ৩৫ বছর করেছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এরপর ১৯ জুলাই আরও ৫ বছর কমিয়ে ৩০ বছর করা হয়েছিল। গ্রাম পর্যায়ে টিকাদান শুরুর আগে এখন সেই বয়সসীমা আরও ৫ বছর কমিয়ে আনা হলো।
টিকার সমস্যা হবে না : ইউনিয়ন পর্যায়ে টিকাদান কর্মসূচি শুরু হলে টিকার সমস্যা হবে না বলে জানান স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, এ মাসেই ১ কোটির বেশি টিকা চলে এসেছে। আজ (গতকাল) রাতে সিনোফার্মের ৩০ লাখ টিকা আসছে। আগামী মাস থেকে ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট বাংলাদেশের কেনা অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা নিয়মিতভাবে দেওয়ার আভাস দিয়েছে।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী আরও বলেন, বর্তমানে সরকারের হাতে এক কোটির ওপরে করোনার টিকা রয়েছে। আগামী মাসের মধ্যেই আরও দুই কোটি টিকা আসবে। এভাবে চীন থেকে তিন কোটি, রাশিয়া থেকে সাত কোটি, জনসন অ্যান্ড জনসনের সাত কোটি, অ্যাস্ট্রাজেনেকার তিন কোটিসহ আগামী বছরের শুরুর মধ্যেই সরকারের হাতে প্রায় ২১ কোটি টিকা চলে আসবে। এর মাধ্যমে দেশের অন্তত ৮০ ভাগ মানুষকে টিকা দিতে সক্ষম হবে সরকার।
টিকা এসেছে ২ কোটি ৬২০ ডোজ, মজুদ আছে ৮১ লাখ ৬১ হাজার ৬০৬ ডোজ : এ পর্যন্ত দেশে চার ধরনের মোট ২ কোটি ৬২০ লাখ ডোজ টিকা এসেছে। এর মধ্যে ভারত থেকে অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা এসেছে ১ কোটি ২ লাখ, ফাইজারের টিকা ১ লাখ ৬২০ ডোজ, মডার্নার ৫৫ লাখ ও চীনের সিনোফার্মের ৫১ লাখ। এর মধ্যে গতকাল পর্যন্ত প্রথম ও দ্বিতীয় ডোজ মিলিয়ে দেওয়া হয়েছে ১ কোটি ১৮ লাখ ৩৯ হাজার ১৪ ডোজ। সে হিসাবে গতকাল পর্যন্ত সরকারের কাছে মজুদ ছিল ৮১ লাখ ৬১ হাজার ৬০৬ ডোজ টিকা। অবশ্য গতকাল রাতে চীন থেকে ৩০ লাখ সিনোফার্ম টিকা দেশে এসে পৌঁছানোর কথা।
এসব টিকার মধ্যে অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার প্রথম ডোজ পেয়েছেন ৫৮ লাখ ২০ হাজার ৩৩ জন ও দ্বিতীয় ডোজ পেয়েছেন ৪২ লাখ ৯৮ হাজার ৮৬ জন। প্রথম ডোজ পেয়েছেন এমন ১৫ লাখ ২১ হাজার ৯৪৭ জন অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার দ্বিতীয় ডোজের জন্য অপেক্ষা করছেন। টিকা নিতে গতকাল বিকেল সাড়ে ৫টা পর্যন্ত নিবন্ধন করেছেন ১ কোটি ৪০ লাখ ৯০ হাজার ৩৭৩ জন।