ক্যাম্পের ভেতরেই রোহিঙ্গাদের শীর্ষ নেতা মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে আতঙ্ক বিরাজ করছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্প ছাড়াও টেকনাফ ও উখিয়ার স্থানীয় বাসিন্দারাও উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে রয়েছে। ক্যাম্পগুলোতে কাজ করা বেসরকারি সংস্থাগুলোর (এনজিও) কর্মীরা গতকাল বৃহস্পতিবার ক্যাম্পে যাওয়া থেকে বিরত থেকেছেন। মুহিবুল্লাহ হত্যায় রোহিঙ্গা নেতারা মিয়ানমার সরকারের দিকেই অভিযোগের তীর ছুড়েছে। তারা বলছেন, মিয়ানমার সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় কয়েকটি সন্ত্রাসী সংগঠন দুই বছর ধরেই টেকনাফ ও উখিয়ায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়ে আসছে। প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া ব্যাহত এবং বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ করতেই এ হত্যাকাণ্ড।
মুহিবুল্লাহ হত্যার ঘটনায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে মনে করছেন কূটনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, প্রত্যাবাসনবিরোধীরাই এ ঘটনা ঘটিয়ে থাকতে পারে। এ নিয়ে রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা ইস্যুতে বাংলাদেশ কিছুটা চাপে পড়তে পারে বলেও তারা মন্তব্য করেন। তারা বলেন, দুই বছর ধরেই রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে অভ্যন্তরীণ কোন্দল, দ্বন্দ্ব-সংঘাতে খুনখারাবি হয়ে আসছিল।
গত বুধবার রাত পৌনে ৯টার দিকে উখিয়ার কুতুপালং লম্বাশিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্প এলাকায় ইস্ট-ওয়েস্ট ১ নম্বর ব্লকের বাড়ির সামনে মুহিবুল্লাহকে হত্যা করা হয়। মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ডের জেরে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। রোহিঙ্গাদের শীর্ষ নেতা ও আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউমেন রাইটসের (এআরএসপিএইচ) চেয়ারম্যান মাস্টার মুহিবুল্লাহকে হত্যা করেছে ওই সংগঠনটিরই ভাইস চেয়ারম্যান মাস্টার আবদুর রহিম ও সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা এমনটি দাবি করেছে নিহতের পরিবার।
মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ডের পর প্রশাসনের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে নিরাপত্তা আরও জোরদার করা হয়েছে। এ ঘটনার পর রোহিঙ্গারা তাদের বাসা থেকে তেমন একটা বাইরে বের হয়নি। গতকাল ক্যাম্পে এনজিওগুলোর কার্যক্রমও বন্ধ ছিল।
এদিকে রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ হত্যার তদন্তের দাবি করেছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ও এইচআরডব্লিউ। অ্যামনেস্টি এক বিবৃতিতে বলেছে, রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ হত্যার ঘটনা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে দিয়েছে। ঘটনাটি তদন্ত করে দোষীদের ন্যায়বিচারের মুখোমুখি করা এখন বাংলাদেশ সরকারের দায়িত্ব। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের দক্ষিণ এশিয়ার পরিচালক মিনাক্ষী গাঙ্গুলী এক টুইট বার্তায় বলেছেন, রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের জন্য মুহিবুল্লাহ একটি গুরুত্বপূর্ণ কণ্ঠস্বর ছিলেন।
মুহিবুল্লাহ হত্যায় জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক রোহিঙ্গা জানিয়েছে, তাদের নেতাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। যে মানুষটি রোহিঙ্গাদের অধিকার আদায়ে বিশ্বনেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ ও সমন্বয়ের চেষ্টা করেছিল, সেই মানুষটিকে হত্যা করা হয়েছে। এতে সাধারণ রোহিঙ্গাদের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে।
নিহত মুহিবুল্লাহর ছোট ভাই হাবিবুল্লাহ বলেন, ‘ঘটনার দিন রাতে আমরা দুই ভাই এশার নামাজ পড়ে মসজিদ থেকে একসঙ্গে বের হই। তখন আমার ভাই তাদের সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউমেন রাইটস (এআরএসপিএইচ) অফিসে গিয়ে সাধারণ রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলার সময় আরসা মাস্টার আবদুর রহমানের নেতৃত্বে ২০-২৫ জনের সশস্ত্র আরসা সন্ত্রাসী তাকে গুলি করে হত্যা করে। এখন পরিবারের অন্য সদস্যদের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমার ভাই রোহিঙ্গাদের অধিকার আদায়ে কাজ করত, তাই সাধারণ রোহিঙ্গারা তাকে নেতা মানত। তার জনপ্রিয়তায় ঈর্ষান্বিত হয়ে ক্যাম্পকেন্দ্রিক আধিপত্য বিস্তার করার জন্য আরসার নেতা মাস্টার আবদুর রহিম, লালু, মুর্শিদসহ সংঘবদ্ধ চক্র তাকে গুলি করে পালিয়ে যায়। অন্যদের নাম জানি না, তবে মুখ দেখলে চিনতে পারব।’
রোহিঙ্গা নেতা দিল মোহাম্মদ বলেন, ‘আমরা আমাদের সম্পদকে হারিয়ে ফেলেছি। রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের জন্য অনেক বড় ক্ষতি হয়েছে।’
রোহিঙ্গা নেতা মোহাম্মদ নুর বলেন, এ ঘটনার পর থেকে ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের অবাধ বিচরণ কমে গেছে। সবার মধ্যে অজানা শঙ্কা কাজ করছে। কক্সবাজারের উখিয়ায় ক্যাম্পের ভেতরে ঢুকেই রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। এ ঘটনার পর রোহিঙ্গা নেতাদের মাঝে এক প্রকার আতঙ্ক বিরাজ করছে। হামলার আশঙ্কায় নিজেদের নিরাপত্তার কথা উল্লেখ করে মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে মিডিয়ায় কথা বলতে রাজি হচ্ছে না তারা।
তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন রোহিঙ্গা নেতা দাবি করেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক ও রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের পক্ষে সক্রিয় অবস্থান নেওয়ার কারণে মিয়ানমার সরকারের পূর্বপরিকল্পনায় রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহকে হত্যা করা হয়েছে। আরও কয়েকজন রোহিঙ্গা নেতা তাদের টার্গেট রয়েছে বলে দাবি করেন তারা।
রোহিঙ্গাদের অভিযোগ, প্রত্যাবাসনের বদলে বাংলাদেশে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের সন্ত্রাসী প্রমাণে মরিয়া হয়ে উঠেছে মিয়ানমার সরকার। এজন্য তারা বিপথগামী রোহিঙ্গাদের দিয়ে ক্যাম্পে দীর্ঘদিন ধরে সন্ত্রাসী কার্যকলাপ করানোর চেষ্টা চালাচ্ছে। বিশ্ব দরবারে রোহিঙ্গাদের সন্ত্রাসী হিসেবে তুলে ধরে ২০১৯ সালের নভেম্বরে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে রোহিঙ্গা গণহত্যায় মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গাম্বিয়ার করা মামলাটি প্রশ্নবিদ্ধ করাই তাদের লক্ষ্য।
রোহিঙ্গা নেতা আবদুল হামিদ বলেন, ‘আমরা দেশে ফিরে যেতে চাই। তবে মিয়ানমার সরকার একদিকে আমাদের ফিরিয়ে নেওয়ার কথা বলছে, অন্যদিকে যাতে আর মিয়ানমারে ফিরিয়ে নিতে না হয় সেজন্য প্রাণপণ চেষ্টা চালাচ্ছে।’ তার দাবি, ক্যাম্পে এখন যেসব সন্ত্রাসী কার্যক্রম চলছে সবই হচ্ছে মিয়ানমারের ইশারায়। তারা বিপথগামী কিছু রোহিঙ্গাকে ব্যবহার করে আল-ইয়াকিন ও আরসার নাম ভাঙিয়ে ক্যাম্পে নানা ধরনের সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালাচ্ছে। রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ড এর অংশ বলে দাবি করেন তিনি।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর (অব.) এমদাদুল ইসলাম বলেন, রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ডের পেছনে তিনটি কারণ থাকতে পারে। এ তিনটি কারণ সামনে রেখে তদন্ত করা হলে মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদ্ঘাটন করা সম্ভব হবে। মুহিবুল্লাহ ক্রমাগতভাবে রোহিঙ্গাদের একক নেতৃত্বে ছিলেন, জাতিসংঘ গিয়ে বৈঠক করেছেন। জেনেভায় গিয়েছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গেও দেখা করেছিলেন। তার জনপ্রিয়তার কারণে অন্য যেসব রোহিঙ্গা নেতৃত্ব দিয়ে সামনে আসতে পারছে না তাদের একটি গ্রুপ এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটাতে পারে। রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ সব সময় রোহিঙ্গাদের মাঝে রোহিঙ্গা জাতীয়তাবোধ জাগ্রত করার চেষ্টা করতেন। কিন্তু এর বিপরীতে যাদের অবস্থান তারাও এ হত্যাকাণ্ড ঘটাতে পারে।
তিনি আরও বলেন, এ ছাড়া মুহিবুল্লাহ রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের পক্ষে সোচ্চার ছিলেন। কিন্তু কিছু দেশ দেশ ভূ-রাজনীতি বা ভূ-কৌশলের কারণে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের বিপক্ষে রয়েছে। সেসব দেশও মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ডের পেছনে কলকাঠি নাড়তে পারে। জড়িত থাকতে পারে মিয়ানমার সরকারও। তিনটি বিষয় মাথায় রেখে হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি তদন্ত করা হলে দ্রুত হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদ্ঘাটন করা সম্ভব উল্লেখ করে এই নিরাপত্তা বিশ্লেষক প্রত্যাবাসনের পক্ষে সক্রিয় থাকা রোহিঙ্গা নেতাদের নিরাপত্তা জোরদার করার পরামর্শ দিয়েছেন।
কক্সবাজারের শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার শাহ রেজওয়ান হায়াত বলেন, ‘মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ড ঘিরে যেসব অভিযোগ বা কথাবার্তা আমরা শুনতে পাচ্ছি, সব বিষয় মাথায় রেখে তদন্তের জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সহযোগিতা করা হবে। মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ড-পরবর্তী যাতে বিশৃঙ্খলা না হয় এজন্য সর্বস্তরে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে।’
চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের ধরতে অভিযান অব্যাহত রয়েছে। একই সঙ্গে কী কারণে তাকে হত্যা করা হয়েছে সেটি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। পাশাপাশি বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন এ বিষয়ে কাজ করছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। কেউ যদি বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহর উত্থান : মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা ইস্যুতে একটি আলোচিত নাম মুহিবুল্লাহ। তিনি মিয়ানমারের নাগরিক হলেও বিচরণ করেছেন অনেক দেশে। সাক্ষাৎ করেছেন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে। মুহিবুল্লাহ মিয়ানমারের মংডু এলাকার লংডাছড়া গ্রামের মৌলবি ফজল আহমদের ছেলে। তিনি কক্সবাজারের উখিয়া কুতুপালং ক্যাম্প-১ লম্বাশিয়া ইস্ট-ওয়েস্ট ব্লকের বাসিন্দা ছিলেন। জানা গেছে, রোহিঙ্গাদের সশস্ত্র বাহিনী রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশনে (আরএসও) প্রধান ভূমিকায় কাজ করার অভিযোগ ওঠার পর ১৯৯২ সালে মুহিবুল্লাহ মিয়ানমার ছেড়ে বাংলাদেশে আসেন। এরপর থেকেই তিনি কক্সবাজারের বিভিন্ন স্থানে বসবাস করেন। তবে উখিয়ার কুতুপালং ক্যাম্প ও ক্যাম্পটির আশপাশে বেশি সময় ধরে বসবাস করছেন। ২০০০ সালের শুরুতে ১৫ জন সদস্য নিয়ে মুহিবুল্লাহ গড়ে তোলেন ‘আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস’ নামের সংগঠনটি। শুধু তিনিই নন, কক্সবাজারের স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গেও গড়ে তোলেন সুসম্পর্ক। এর ফাঁকে কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ান তিনি। তাদের জমায়েত করার আপ্রাণ চেষ্টা করে ধীরে ধীরে রোহিঙ্গাদের নেতা হয়ে ওঠেন। তখন বাংলাদেশ থেকে সহজে মিয়ানমারে যেতে পারায় সেখানে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের সঙ্গে তার যোগাযোগ হতো। পরে সেখানেও বসবাস করেন তিনি। সর্বশেষ ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমার সেনাদের হাত থেকে প্রাণে বাঁচতে মংডু টাউনশিপের সিকদারপাড়া গ্রাম থেকে দ্বিতীয়বারের মতো বাংলাদেশে পালিয়ে আসেন। এরপর আবারও আশ্রয় নেন উখিয়া ক্যাম্পে। সবকিছু আগে থেকে জানাশোনা থাকায় ওখানকার মানুষের সঙ্গে মিশতে তার বেশি সময় লাগেনি। আবারও তিনি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সাংগঠনিক কাজ শুরু করেন। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বেশ কিছু সংগঠন কাজ করলেও মুহিবুল্লাহর নেতৃত্বে পরিচালিত এআরএসপিএইচ সংগঠনটি বেশ শক্তিশালী। মুহিবুল্লাহর সংগঠনে ৩০০ জন সক্রিয় সদস্য রয়েছেন বলে জেলা প্রশাসক স্বাক্ষরিত একটি তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছিল।
রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ দেশের বাইরে সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে সফর করেন একাধিকবার। ২০১৯ সালের জুলাইয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে ১৭ দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের যে ২৭ প্রতিনিধি সাক্ষাৎ করেন সেখানেও যোগ দেন মুহিবুল্লাহ। যুক্তরাষ্ট্রের এ সফর দেশ-বিদেশে আলোচনায় এলে মুহিবুল্লাহ বেশ পরিচিতি লাভ করেন এবং রোহিঙ্গাদের প্রতিনিধি হিসেবে আখ্যায়িত হন। মুহিবুল্লার মূল উত্থান ২০১৯ সালের ২৫ আগস্ট বাংলাদেশে রোহিঙ্গা আগমনের বর্ষপূর্তিতে। ওইদিন তিনি লাখো রোহিঙ্গার সমাবেশ ঘটিয়ে আলোচনার তুঙ্গে এনেছিলেন নিজেকে। সেদিন তার নেতৃত্বে হয়েছিল তিন থেকে পাঁচ লাখ রোহিঙ্গার মহাসমাবেশ। এরপর তিনি উখিয়া-টেকনাফের ৩২ রোহিঙ্গা আশ্রয় শিবিরে একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। রোহিঙ্গাদের অভ্যন্তরীণ যোগাযোগে দক্ষ মুহিবুল্লাহ ধীরে ধীরে প্রিয়পাত্র হয়ে ওঠেন।
জাতিসংঘ মহাসচিবসহ যত বিদেশি প্রতিনিধি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে গেছেন তাদের প্রত্যেকের সঙ্গেই রোহিঙ্গা প্রতিনিধি হিসেবে মুহিবুল্লাহ ও তার সঙ্গীদের সাক্ষাৎ হয়েছে। মুহিবুল্লাহ মিয়ানমারের পররাষ্ট্র সচিবকে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সংলাপের প্রস্তাব দিয়েছিলেন।
এ ছাড়া সম্প্রতি বিশ্বব্যাংক রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে নাগরিকত্ব দেওয়ার অনুরোধ জানালে বাংলাদেশের পাশাপাশি এ দাবি প্রত্যাখ্যান করে রোহিঙ্গারা নিজ ভূমি মিয়ানমারে ফিরে যেতে চান জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছিল মুহিবুল্লাহর নেতৃত্বাধীন রোহিঙ্গাদের সংগঠন এআরএসপিএইচ।
মুহিববুল্লাহর দাফন ও মামলা : গতকাল বিকেল পৌনে ৫টার দিকে উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্প-১-এর লম্বা শিয়া ওঠনির পশ্চিমে নিহত মুহিববুল্লাহর জানাজা হয়। এতে হাজার হাজার মানুষ অংশ নেয়।
এর আগে গতকাল বিকেল ৪টার দিকে রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহর মৃতদেহ কক্সবাজার জেলা হাসপাতালে ময়নাতদন্ত শেষে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করে পুলিশ। কক্সবাজার সদর থানার ওসি মুনীর উল গীয়াস জানান, ভাই হাবিবুল্লাহর কাছে মুহিবুল্লাহর মরদেহ হস্তান্তর করা হয়। এরপর পুলিশি পাহারায় লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্সটি উখিয়ার লম্বাশিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে জানাজা শেষে মুহিবুল্লাহকে দাফন করা হয়। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে থাকা ১৪ এপিবিএনের অধিনায়ক মো. নাঈমুল হক বলেন, ‘মুহিববুল্লাহর জানাজা ও দাফন শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন হয়েছে। তাকে হত্যায় জড়িত কাউকে এখনো আটক করা সম্ভব হয়নি। ক্যাম্পের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি তাদের সংগঠনের কোন্দল থেকে হতে পারে।’
এদিকে মুহিববুল্লাহ হত্যায় গতকাল রাত ৯টার দিকে তার ভাই বাদী হয়ে উখিয়া থানায় একটি মামলা করেছেন বলে জানা গেছে। তবে এ ব্যাপারে জানতে উখিয়া থানার ওসি আহাম্মদ মঞ্জুর মোর্শেদ ও সংশ্লিষ্টদের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করা হলে তারা কেউ রিসিভ না করায় বিস্তারিত জানা যায়নি।
কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. রফিকুল ইসলাম বলেছেন, রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ নিহত হওয়ার পর প্রতিটি ক্যাম্পে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অতিরিক্ত সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে।
প্রতিবেদনটি তৈরিতে সহায়তা করেছেন কক্সবাজার ও উখিয়া প্রতিনিধি