সয়াবিন তেল পুরোনো দাম মুছে নতুন দামে বিক্রি
সয়াবিন তেল পুরোনো দাম মুছে নতুন দামে বিক্রি

কেন জনপ্রিয় হলো সয়াবিন

সয়াবিন তেল ছাড়া এখন রান্নার কথা ভাবা যায় না। রান্নাঘরে সয়াবিন পৌঁছেনি এমন বাসা-বাড়ির সংখ্যা খুব বেশি হবে না। স্বাধীনতার আগে থেকে সয়াবিন তেল আমদানি হলেও এ তেল জনপ্রিয় হতে অনেক সময় লেগেছে এ দেশে। ধীরে ধীরে বাঙালির খাদ্যাভ্যাসের অপরিহার্য উপাদান হয়ে ওঠায় এই তেলের বিকল্প হয়ে উঠতে পারেনি অন্য কোনো রান্নার তেল।

স্বাধীনতার আগে থেকে এ অঞ্চলে রান্নার প্রধান তেল ছিল শর্ষের তেল। দেশে নানা জায়গায় শর্ষেবীজের উৎপাদন হতো। ছোট ছোট ঘানিতে বীজ ভাঙিয়ে তেল উৎপাদন করা হতো। সয়াবিন তেল আমদানি হলেও তা ছিল খুব কম। শহর এলাকায়ই সীমিত ছিল সয়াবিন তেলের বেচাকেনা।

শর্ষের তেলের চেয়ে দামে তুলনামূলক সস্তা সয়াবিন তেল। আর সয়াবিন তেলে রান্না করা খাবারে স্বাদ অটুট থাকে। তেলটির নিজস্ব কোনো গন্ধ না থাকায় খাবারেও গন্ধ হয় না। এই তেল দেখতেও স্বচ্ছ। এমন বৈশিষ্ট্যের কারণেই সময়ের পরিক্রমায় রসুইঘরে দাপুটে অবস্থান তৈরি করে এ তেল। আজকের এই পর্যায়ে আসতে সয়াবিন অন্য তেলের সঙ্গে কীভাবে প্রতিযোগিতা করেছে, তা জেনে নেওয়া যাক।

এ দেশে কখন থেকে সয়াবিন তেলের আমদানি শুরু হয়, তার সঠিক তথ্য জানা যায়নি। তবে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, স্বাধীনতার আগে থেকেই সয়াবিন তেল আমদানি করা হতো। ওই প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৬১ সালে সয়াবিন তেলের আমদানির পরিমাণ ছিল ১৪ হাজার ২৩০ টন। সে সময় ভোজ্যতেলের মধ্যে শর্ষের ব্যবহার ছিল ৮০ শতাংশ। দেশ স্বাধীন হওয়ার এক বছরের মাথায় সয়াবিন আমদানিতে ভাটা পড়ে। এরপর কখনো সয়াবিন, কখনো শর্ষের তেল ছিল ভোজ্যতেলের বাজারে অংশীদারত্বের লড়াইয়ে।

সয়াবিন আর শর্ষে যখন পিঠাপিঠি লড়াইয়ে ব্যস্ত, তখন আমদানি শুরু হয় পামতেলের। শর্ষেতে মগ্ন থাকা এ দেশের মানুষ তখন খুব একটা শোনেনি পামতেলের কথা। সময়টা ছিল ১৯৭৯ সাল। বাজারের মাত্র এক শতাংশ অংশীদারত্ব দিয়ে এ দেশে শুরু হয় পামতেলের যাত্রা। খুব দ্রুত এই তেলের আমদানি বেড়ে যায়।

পামতেল ও সয়াবিনের বাজার অংশীদারত্বের লড়াই শুরুর পর শর্ষে জনপ্রিয়তা হারাতে থাকে। প্রায় তিন দশক আগে ধীরে ধীরে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে যেতে থাকে শর্ষের তেল। আমদানি শুরুর দুই দশকের মাথায় ২০০১ সাল থেকে সয়াবিনকে হটিয়ে পরিমাণে বেশি আমদানি হতে থাকে পামতেল। পামতেলের আমদানি বাড়লেও বাসা-বাড়ির রান্নাঘরে এ তেলের খুব একটা জায়গা হয়নি। অপরিশোধিত আকারে সয়াবিনের আমদানি ও উৎপাদন মিলে দেশে বছরে ১১ থেকে ১২ লাখ টন সয়াবিন সরবরাহ হয়। পামতেলের পরিমাণ ১৩ থেকে সাড়ে ১৩ লাখ টন। সয়াবিনের চেয়ে পরিমাণে বেশি হলেও এই পামতেলের কদর হোটেল-রেস্তোরাঁ, খাদ্যপণ্য ও প্রসাধনশিল্পে। লিপস্টিক থেকে শুরু করে পাস্তা-নুডলস তৈরি করতে পামতেলের ব্যবহার হয়। তবে রান্নাঘরে জায়গা নিতে এখনো খোলা পামতেল মাঝেমধ্যে সয়াবিন নামে বেচা-বিক্রি হচ্ছে। শীত মৌসুমে পামতেল জমাট বেঁধে যায় বলে রান্নাঘরে এ তেলের জনপ্রিয়তা খুব বেশি বাড়েনি। এ কারণে প্রতিবছর শীত মৌসুমে পামতেলের দরও পড়ে যায়।

কোন পণ্য আমদানি করলে তা বাজার দখল করবে, ব্যবসায়ীরা সেটি আগেই ধারণা করতে পারেন। যেমনটি হয়েছে সয়াবিন তেলের ক্ষেত্রে। এই তেল যে জনপ্রিয় হবে, তা সবার আগে বুঝতে পারেন ব্যবসায়ীরা। স্বাধীনতার পর প্রথম দুই দশক পরিশোধিত আকারে সয়াবিনের আমদানি হতো। দুই দশক পর এ দেশের উদ্যোক্তাদের হাত ধরে সয়াবিন পরিশোধনের কারখানা চালু হয়। আবুল খায়ের গ্রুপের হাতে আসে নাছিরাবাদের বালাগামওয়ালা ভেজিটেবল অয়েল প্রোডাক্টস, যেটিতে অবশ্য সয়াবিনের পাশাপাশি শর্ষে ও ঘি তৈরি হতো। টিকে গ্রুপ কারখানা গড়ে তোলে। শুরুর দিকে দেশীয় কারখানাগুলোয় পরিশোধিত সয়াবিনের মূল্য সংযোজন এত বেশি হয়েছিল যে, এক-দুই বছরে বিনিয়োগ উঠে আসে।

সয়াবিন তেলের উৎপাদন হয় সয়াবিন বীজ থেকে। বিশ্বে খুব বেশিসংখ্যক দেশ সয়াবিন বীজ উৎপাদন করে না। বিশ্বের মোট ৯৮ শতাংশ সয়াবিন বীজ উৎপাদিত হয় ১৫টি দেশে। তার মধ্যে শীর্ষ চারটি দেশ হলো ব্রাজিল, যুক্তরাষ্ট্র, আর্জেন্টিনা ও চীন। বীজ মাড়াই করে তেল উৎপাদনেও শীর্ষে রয়েছে এই চার দেশ। বাংলাদেশেও সয়াবিন বীজের উৎপাদন হয়, তবে তা পরিমাণে খুব কম।

রান্নাঘরে সয়াবিন তেল পাকাপোক্ত জায়গা দখল করার পর বীজ থেকে সয়াবিন উৎপাদনে বিনিয়োগ নিয়ে দুইবার ভাবতে হয়নি ব্যবসায়ীদের। এ জন্য দেড় দশক আগে সয়াবিন বীজ মাড়াইয়ের কারখানায় বিনিয়োগ করেন এ দেশের উদ্যোক্তারা। প্রথমে বিনিয়োগ করে সিটি গ্রুপ। এরপর মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রি বা এমজিআই বিনিয়োগ করে এই খাতে। এই খাতে আসছে নতুন আরও দুটি গ্রুপ। এসব কারখানায় পরিশোধনের পাশাপাশি বীজ মাড়াই করে সয়াবিন উৎপাদন করা হয়। এ ধরনের কারখানায় একেকটি গ্রুপের বিনিয়োগ হাজার কোটি টাকার বেশি। বীজ আমদানি করেই সয়াবিন তেল উৎপাদন করছে তারা।

জনপ্রিয়তার কারণে সয়াবিন তেল ব্যবহারের বৈশ্বিক ক্রমতালিকায় জায়গা করে নিয়েছে বাংলাদেশ। বিশ্বে সবচেয়ে বেশি সয়াবিন তেল ব্যবহার করে চীন। এরপরের অবস্থানে যুক্তরাষ্ট্র। ব্রাজিলের অবস্থান তৃতীয়। তিনটি দেশই সয়াবিন উৎপাদনেও শীর্ষে। ইউরোপীয় ইউনিয়নকে সরিয়ে দিলে এই তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম, এমন তথ্যই দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি সংস্থা।

জনপ্রিয়তায় শীর্ষে থাকা এই সয়াবিন তেল অপরিশোধিত আকারে আসছে মূলত তিনটি দেশ থেকে। আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল ও প্যারাগুয়ের ওপর নির্ভরশীল এ দেশের সয়াবিনের বাজার। ফুটবলে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার মতো লড়াই আছে সয়াবিন তেলের বাজার দখলে। তবে এই লড়াইয়ে ব্রাজিলকে পেছনে ফেলেছে আর্জেন্টিনা। গত ১০ মাসে দেশে যত সয়াবিন তেলের আমদানি হয়েছে তার প্রায় ৪৯ শতাংশই এসেছে আর্জেন্টিনা থেকে। ব্রাজিল ভাগ বসিয়েছে ৩১ শতাংশে। বাকিটা আমদানি হয়েছে দক্ষিণ আমেরিকার আরেক দেশ প্যারাগুয়ে থেকে। বাংলাদেশের বাজার দখলের লড়াইয়ে একসময় ছিল যুক্তরাষ্ট্রও। তা–ও আট বছর আগের কথা। এ দেশের সয়াবিনের ৯ শতাংশ আসত দেশটি থেকে। এখন আর আসে না।

সময়ের পরিক্রমায় এ দেশের রসুইঘরে সয়াবিনের জনপ্রিয়তার মাশুলও দিতে হচ্ছে অনেক। প্রতিবছর ৭২-৭৩ কোটি ডলারের (ছয় হাজার কোটি টাকার বেশি) বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় হচ্ছে সয়াবিন তেল আমদানিতে। এখন দাম বাড়ার পর এই অঙ্ক আরও বড় হবে। আর এখন যেভাবে দাম বেড়েছে, তাতে স্বাভাবিক চাহিদায় মাসেই দুই হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি ব্যয় করতে হবে সাধারণ মানুষকে।

শর্ষের পর বিদেশি তেল হিসেবে নানা ধরনের তেল এসেছে বাজারে। অলিভ অয়েল, সূর্যমুখী তেল, ক্যানোলা অয়েলের নাম আছে এই তালিকায়। দেশে ধানের কুঁড়া থেকেও তেল উৎপাদিত হচ্ছে। তবে রান্নাঘরে সয়াবিনের বিকল্প কোনো তেল দাঁড়াতে পারেনি। সয়াবিন এত জনপ্রিয় হয়েছে যে এখন সংকটের সময়ও অন্য তেল না নিয়ে মানুষ সয়াবিনের খোঁজে দোকান থেকে দোকানে ছুটছে।

রংপুর ডেইলী রংপুরের সবচেয়ে আপডেট সংবাদ দেশ ও আন্তজার্তিক নিউজ প্রকাশে বাধ্য থাকিবে। রংপুরের সব রকমের নিউজ পেতে রংপুর ডেইলী ভিজিট করুন