বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) একটি সফটওয়্যার কিনেছিল সাড়ে ১৯ কোটি টাকায়। তিন বছরের ওয়ারেন্টির মেয়াদ শেষ হয় সাত মাস আগে। আগামী তিন বছরের জন্য সফটওয়্যারটি রক্ষণাবেক্ষণের কাজে খরচ ধরা হয়েছে প্রায় ২৪ কোটি টাকা।বেবিচকের কর্মকর্তাদের দাবি, কাজের পরিধি বেড়েছে বলে ব্যয়ও বেড়েছে।প্রতি তিন বছর পরপর এমন খরচ হবে কি না, এ প্রশ্নের জবাবে বেবিচকের সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট, ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড স্টোর ইউনিটের (সেমসু) নির্বাহী পরিচালক মো. মহসিন বলেন, সফটওয়্যারটি প্রায় চার বছর আগের। এটি আরও তিন বছর চলবে। এ সাত বছরে নেটওয়ার্কিং লাইসেন্সের নবায়নের বিষয়গুলো যুক্ত আছে। বেবিচকের নতুন নিয়োগটা হয়ে গেলে অনেক প্রকৌশলী যোগ দেবেন। তখন নিজের লোকবল দিয়েই সফটওয়্যারটি রক্ষণাবেক্ষণ করা যাবে।
‘ম্যানেজড আইসিটি সাপোর্ট সার্ভিসের’ আওতায় বেবিচকের সব বিভাগ, শাখা ও ইউনিটের আইসিটি ও ই-গভর্ন্যান্স কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ২০১৭-১৮ সালে এই সফটওয়্যার প্রস্তুত করা হয়। এর মাধ্যমে বেবিচকের নেটওয়ার্কিং ও অটোমেশন অ্যান্ড কম্পিউটারাইজেশনের কাজ করা হয়। ওই কাজে খরচ হয় ১৯ কোটি ৫৬ লাখ ৫৭ হাজার ৬৭০ টাকা।বেবিচক সূত্রে জানা গেছে, সফটওয়্যারটি কেনা হয়েছে মেসার্স সাউথটেক লিমিটেড থেকে। প্রথম তিন বছরে সফটওয়্যারটির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বও ছিল প্রতিষ্ঠানটির। ২০২১ সালের ২৪ জুন সফটওয়্যারটির ওয়ারেন্টির মেয়াদ শেষ হয়। মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই সাউথটেকের কাছে পরবর্তী তিন বছর রক্ষণাবেক্ষণের জন্য নির্দেশনা দেয় বেবিচক। সাউথটেক এই কাজের জন্য ৩০ কোটি ৭৮ লাখ টাকা প্রস্তাব করে, যা বেবিচকের কাছে ‘অধিক অনুমিত’ বলে মনে হয়। বিষয়টি যাচাই ও নির্ধারণ করতে বেবিচক ছয় সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে।
ওই কমিটি ১১টি সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠানের কাছে তিন বছরের জন্য ম্যানেজড আইসিটি সাপোর্ট সার্ভিসের দর চেয়ে (প্রাইস কোটেশন) চিঠি দেয়। এর মধ্যে ছয়টি প্রতিষ্ঠান দর জানায়। সর্বোচ্চ দর ওঠে ৩৬ কোটি এবং সর্বনিম্ন ২৫ কোটি ২৭ লাখ টাকা। এরপর কমিটি ২৩ কোটি ৭৩ লাখ টাকার প্রাক্কলন প্রস্তুত করে। এর সঙ্গে যন্ত্রাংশ (স্পেয়ার পার্টস) বাবদ আরও এক কোটি টাকা যুক্ত করে পৌনে ২৫ কোটি টাকার প্রশাসনিক মঞ্জুরির জন্য সেমসু নির্বাহী পরিচালক মো. মহসিন বেবিচকের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠান। তিনি বলেন, ‘কেউ কেউ বলছে, এ কাজে বাজেট অনেক। বেবিচকের তো আইটি বিশেষজ্ঞ নেই। প্রয়োজনে আমরা আরও যাচাই করে নেব।’ মো. মহসিনের ভাষ্য, সফটওয়্যার রক্ষণাবেক্ষণের কাজটি বড়। দেশের আটটি বিমানবন্দর এর সঙ্গে যুক্ত থাকবে। এখানে ব্রডব্যান্ড, ল্যান ও ওয়ানের কাজ আছে।
বেবিচকের সূত্রে জানা গেছে, সফটওয়্যারটির ৩৫টি মডিউলে রক্ষণাবেক্ষণ, ডেটা সেন্টার এবং লাইসেন্সসহ ও লাইসেন্সহীন হার্ডওয়্যার রক্ষণাবেক্ষণ, এয়ারকন্ডিশনার ও অগ্নিনির্বাপণব্যবস্থা রক্ষণাবেক্ষণ, লোকাল এরিয়া নেটওয়ার্ক (ল্যান) এবং ওয়াইড এরিয়া নেটওয়ার্কের (ওয়ান) রক্ষণাবেক্ষণ করা হবে।বেবিচকের চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মো. মফিদুর রহমান বলেন, সফটওয়্যারটি কিনতে সাড়ে ১৯ কোটি টাকা খরচ হয়েছিল, এ কথা সত্য। রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ২৫ কোটি টাকা আপাতদৃষ্টে মনে হয় একটু বেশি। কিন্তু এ কাজে শুধু সফটওয়্যার রক্ষণাবেক্ষণের জন্য নয়, সঙ্গে হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যারের কাজও রয়েছে।বেবিচক সূত্রে জানা গেছে, ২০১৬ সালে বেবিচক এমন একটা সফটওয়্যার কেনার উদ্যোগ নেয়। একটা পরামর্শক প্রতিষ্ঠানকে সে সময় নিয়োগ দেওয়া হয় এ কাজের অবকাঠামো তৈরি করতে। পরামর্শ দেওয়ার কাজটি তিন কোটি টাকার ছিল। তবে ওই প্রতিষ্ঠান কাজটি করতে পারেনি এবং বিলও সম্পূর্ণ নিতে পারেনি।
বেবিচক জানায়, সর্বশেষ গত ২৮ ডিসেম্বর বেবিচকের পর্ষদ সভায় সফটওয়্যার রক্ষণাবেক্ষণের বিষয়টি উপস্থাপিত হয়। তবে সে সভায় এ কাজের বিষয়ে নতুন কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি।এদিকে সফটওয়্যারটি প্রস্তুতকারী সাউথটেক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মামনুন কাদির প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, সফটওয়্যারটি তৈরি ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজটি অনেক বড়। এটির প্রথম তিন বছর রক্ষণাবেক্ষণ ও আরও কিছু যন্ত্র (ডিভাইস) লাগানো বাবদ তাঁদের আরও ২৮ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। এই বাড়তি বিলের কথা বেবিচককে জানানো হয়েছে। বেবিচক বলেছে, কমিটি করে বিষয়টি যাচাই করবে। তবে সে কমিটি এখনো হয়নি। সফটওয়্যারটি হালনাগাদ করতে চিঠি দেওয়া হলেও কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
তবে বেবিচক সূত্র বলছে, ওয়ারেন্টি বা নিশ্চয়তার মেয়াদকাল তিন বছর। এই সময়টা রক্ষণাবেক্ষণ করার দায়িত্ব প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের।একটা সফটওয়্যার প্রস্তুতের চেয়ে রক্ষণাবেক্ষণের ব্যয় বেশি হওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সফটওয়্যার তৈরি ও রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়বহুল কাজ। বেবিচক যে প্রাক্কলন তৈরি করেছে, এর সঙ্গে বাজারমূল্য যাচাই করতে হবে। পাশাপাশি বিশেষজ্ঞের পরামর্শ ও মতামত নেওয়া উচিত। তা না হলে এখানে অনিয়মের একটি সুযোগ তৈরি হতে পারে।