আপনি হয়তো অবাক হয়ে ভাবছেন, ইসলাম কি তাড়াতাড়ি ঘুমোতে যাওয়া নিয়েও কথা বলেছে নাকি?
প্রিয় পাঠক! ঠিকই ধরেছেন। সঠিকভাবে ঘুমেরও নিয়ম আছে। আর তাড়াতাড়ি ঘুমোতে যাওয়া সঠিকভাবে ঘুমের নিয়মের অংশ। শুধু ঘুম কেন, মুমিনের জীবনের প্রতিটি আচরণ ও উচ্চারণ, কাজ-কর্ম সবকিছুর জন্যই আছে সুনির্দিষ্ট নিয়ম-রীতি। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম এসব কিছু আমাদেরকে শিখিয়ে গিয়েছেন।
আমাদেরকে ঘুমের সঠিক পদ্ধতি জানতে হবে। আল্লাহ তাআলা ঘুমের যে পদ্ধতি নির্ধারণ করেছেন, প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে পদ্ধতিতে শয্যাগ্রহণ করেছেন, তা-ই হলো ঘুমের সঠিক পদ্ধতি।
এবার জেনে যাক, তাড়াতাড়ি ঘুমোতে যাওয়ার বিষয়টি নিয়ে।
ইসলামী শিক্ষাবিমুখ এই সমাজে কত রকম ভ্রান্ত চিন্তা মানুষের মাঝে বাসা বেঁধেছে! অনেকে মনে করে, রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমাতে যাওয়া একটি মানসিক ব্যাধি। আবার অনেকে মনে করে, এটি ভালো, তবে কেবল শিশুদের জন্য।
না, এগুলো সবই ভ্রান্ত ধারণা। অড়াতাড়ি ঘুমাতে যাওয়া কোন ব্যাধি বা ত্রুটিও নয়; কেবল শিশুদের জন্যও প্রযোজ্য নয়। বরং আগে আগে শয্যাগ্রহণ করা সুন্নাতে ইলাহী ও মানুষের জন্য স্রষ্টা নির্ধারিত স্বভাব-রীতি; পাশাপাশি তা প্রিয় নবীজীর সুন্নাত। আজকের পৃথিবীর বুদ্ধিজীবী সমাজ ও চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের সম্মিলিত অভিমতও এই ধারণাকে সমর্থন করে। নিঃসন্দেহে এটি ইসলামের চিরন্তনতা ও শ্রেষ্ঠত্বের এক অনন্য দলিল ।
আল্লাহ তাআলা পশু-পাখি, জলজ প্রাণীসহ পুরো সৃষ্টিজগৎকে এমনভাবে সৃষ্টি করেছেন যে, সকলে রাতে বিশ্রাম করে এবং দিনে জাগ্রত থাকে। মানুষও এই সৃষ্টিস্বভাবের বহির্ভূত নয়। এজন্য মানুষ যেমনই প্রত্যাশা করুক না কেন, আল্লাহ তাআলা প্রত্যুষে সূর্যকে আলোকিত করেন, যেন মানুষ জেগে ওঠে।
এরপর আল্লাহ তাআলা-ই রাতে সূর্যকে আলোহীন করে দেন, যেন মানুষ নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারে। এটি আল্লাহ তাআলার অন্যতম সুস্পষ্ট নিদর্শন। তারপরও মানুষ কেন দ্রুত ঘুমের বিরোধিতা করে তা বোধগম্য নয়।
অনেক মানুষ বিশেষ করে যুবসমাজ মনে করে যে, তারা রাতে যত দীর্ঘ সময় জেগে থাকতে পারবে, ততই তাদের তারুণ্য প্রস্ফুটিত হবে। রাতকে নির্ঘুম ও দিনকে ঘুমে কাটাতে পারলেই বুঝি সভ্য হওয়া যাবে, সভ্যতা ও সংস্কৃতির পাঠ আদায় হবে। হায়! কত অলীক তাদের চিন্তাভাবনা।
আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেছেন-
اَللّٰهُ الَّذِیۡ جَعَلَ لَکُمُ الَّیۡلَ لِتَسۡکُنُوۡا فِیۡهِ وَ النَّهَارَ مُبۡصِرًا ؕ اِنَّ اللّٰهَ لَذُوۡ فَضۡلٍ عَلَی النَّاسِ وَ لٰکِنَّ اَکۡثَرَ النَّاسِ لَا یَشۡکُرُوۡنَ ﴿۶۱﴾
আল্লাহ যিনি তোমাদের জন্য রাত্রি বানিয়েছেন যাতে তোমরা তাতে প্রশান্তি লাভ করতে পার, আর দিনকে করেছেন আলোকময়। আল্লাহ মানুষদের প্রতি বড়ই অনুগ্রহশীল, কিন্তু অধিকাংশ মানুষই (আল্লাহর অনুগ্রহ লাভের পরও) কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে না। [সুরা মুমিন : ৬১]
আল্লাহ তাআলা-ই মানুষের দেহ সৃষ্টি করেছেন, তিনিই মানবদেহের কোষ ও গ্রন্থিসমূহে উদ্দীপক হরমোন সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহ তাআলা মানুষের দেহপ্রক্রিয়া এমন পদ্ধতিতে বিন্যস্ত করেছেন, যেন সে রাতে ঘুমায় এবং দিনে জেগে থাকে। মানুষ যখন এই মানবিক স্বভাব-চাহিদার বিপরীত চলে, তখন তার দেহযন্ত্র সঠিকভাবে কাজ করে না এবং স্বাভাবিক আচরণ করে না।
যারা মানুষের জন্য সুন্দর ও স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ তৈরি করতে মানবদেহ ও পৃথিবী নিয়ে বুদ্ধিবৃত্তিক গবেষণা করে যাচ্ছেন, তারাও এ বিষয়টি উপলব্ধি করেছেন। এ কারণেই তারা সকলে আগে আগে ঘুমাতে যাওয়ার এবং আগে আগে (ফজরের নামাজের নির্ধারিত সময়ে) শয্যাত্যাগের উপদেশ দিয়েছেন। গবেষকগণ দীর্ঘ গবেষণার পর যে সূত্র উদ্ঘাটনে সক্ষম হয়েছেন, পবিত্র কুরআন ও প্রিয় নবীজীর সুন্নাহ তা শত শত বছর পূর্বেই মুসলমানদের শিখিয়ে দিয়েছে। আফসোসের বিষয় হলো, ‘তারা’ তাদের গবেষণালব্ধ সূত্র নিজেদের জীবনে বাস্তবায়ন করছে আর ‘আমরা’ হেলায় পাওয়া সম্পদ ছুড়ে বসে আছি।
পশ্চিমা দেশগুলোতে দেখা যায়, সেখানকার অধিবাসীরা মুসলমানদের ধারণার চেয়েও অনেক আগে ঘুমিয়ে পড়ে। অনেকেই রাত আটটা থেকে নয়টার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ে। এতে আশ্চর্যের তেমন কিছু নেই। রাত আটটা-নয়টার পর খুব কম সংখ্যক লোককেই রাস্তায় চলতে দেখা যায়!
এর অর্থ এই নয় যে, তাদের কাছে রাতজাগার বিভিন্ন উপকরণের অভাব আছে। বরং রাতজাগার সকল উপকরণ তাদের কাছে আছে এবং বেশিই আছে। তাদের সমাজে টেলিভিশন, স্যাটেলাইট চ্যানেল, ইন্টারনেট, ক্যাসিনো, চব্বিশ ঘণ্টা খোলা দোকান-পাট, প্রমোদকেন্দ্র, রাত কাটানোর সঙ্গী-সাথী, বিনোদন অনুষ্ঠান সবই আছে। কিন্তু জাগতিক স্বার্থের দাবী ও স্বাস্থ্য-সচেতনতার কারণে তারা তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ে এবং প্রত্যূষে জেগে ওঠে। আর এই শৃঙ্খলিত নিদ্রারীতি তাদের পুরো জীবনধারাতেই ইতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করে। তাদের সারাদিনের কাজ-কর্ম রুটিনমাফিক হয়, প্রতিটি কাজ ও প্রচেষ্টা কার্যকর ও সফল হয়। প্রত্যেকে উচ্ছ্বল প্রাণোদ্যম ও প্রাণশক্তি নিয়ে কাজ করে।
বিষয়টা এটা না যে তাদের কর্মধারার প্রতি আমাদের কোনো মুগ্ধতা আছে। আর আগে আগে ঘুমানো পশ্চিমাদের কোনো আবিষ্কারও নয়। আফসোসের মূল বিষয় হল, কুরআন-সুন্নাহয় উল্লিখিত এই অমূল্য সম্পদ আজ মুসলমানরা কাজে লাগাচ্ছে না, আগ্রহও দেখাচ্ছে না!
আজকের আমেরিকা, জাপান, চীন, জার্মানি, ইংল্যান্ড ও অন্যান্য উদ্যমী দেশের অধিবাসীরা যে রীতি পালন করছে, তা তো ইসলামেরই দাবী। এটি নতুন কোন আবিষ্কার নয়। তারা যে বস্তুগত উৎকর্ষ ও জীবনধারার নিয়ন্ত্রণ অর্জন করেছে, তা কেবল এ কারণেই যে, তারা পৃথিবীর জন্য স্রষ্টার সুনির্ধারিত স্বভাবরীতির অনুসরণ করেছে; বলা ভালো, সুন্নাতুল্লাহর অনুসরণ করেছে। আর সুন্নাতুল্লাহ সম্পর্কে আল্লাহ তাআলার প্রতিশ্রুতি হলো, যে এই রীতি অবলম্বন করবে, সে মুমিন হোক বা ফাসিক কিংবা কাফির, সে আপন কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছতে সক্ষম হবে।
উম্মাহর নেতা রাসুলে আরাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে ও সমগ্র মুসলিম উম্মাহকে যথাসম্ভব শীঘ্র ঘুমিয়ে যাওয়ার শিক্ষা দিয়েছেন; যেন রাতের সর্বোচ্চ সঠিক ব্যবহার হয়। রাতের সর্বোচ্চ সঠিক ব্যবহার হলে আপনাআপনি দিনেরও সঠিক ব্যবহার হবে।
হযরত আবু বারযা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, নবি করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এশার আগে ঘুমিয়ে যাওয়া অপছন্দ করতেন (যেন এশার নামায ছুটে না যায়) এবং এশার পর কথা-বার্তা বলা অপছন্দ করতেন।
এশার পর সুস্পষ্ট কোন প্রয়োজনে বা এমন সুনিশ্চিত কোন কল্যাণের উদ্দেশ্যেই কথা বলা যেতে পারে, যা এই নির্দিষ্ট সময় ছাড়া বাস্তবায়ন হবে না। আর এশার পর এই দেরি হতে পারবে সুনির্দিষ্ট ও সীমিত সময়ের জন্য।
ইসলাম পুরোপুরি সুবিন্যস্ত ও সুশৃঙ্খলিত একটি ধর্ম। ইসলাম একটি সামগ্রিক জীবনবিধান। আমি-আপনি যদি ইসলামকে পরিপূর্ণ গ্রহণ করি, ইসলাম আমার-আপনার ইহকালীন-পরকালীন কল্যাণ বয়ে আনবে আর যদি আমরা প্রবৃত্তির চাহিদা অনুযায়ী ইসলামকে ব্যবচ্ছেদ করি; কিছু গ্রহণ করি, কিছু বর্জন করি, তাহলে তা আমাদের দুনিয়া-আখিরাতে কোন কাজে আসবে না।
وَ اَنَّ هٰذَا صِرَاطِیۡ مُسۡتَقِیۡمًا فَاتَّبِعُوۡهُ ۚ وَ لَا تَتَّبِعُوا السُّبُلَ فَتَفَرَّقَ بِکُمۡ عَنۡ سَبِیۡلِهٖ ؕ ذٰلِکُمۡ وَصّٰکُمۡ بِهٖ لَعَلَّکُمۡ تَتَّقُوۡنَ ﴿۱۵۳﴾
আর এটি তো আমার সোজা পথ। সুতরাং তোমরা তার অনুসরণ কর এবং অন্যান্য পথ অনুসরণ করো না, তাহলে তা তোমাদেরকে তাঁর পথ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেবে। এগুলো তিনি তোমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন, যাতে তোমরা তাকওয়া অবলম্বন কর। [সুরা আনআম : ১৫৩]