মাত্র তিন মাস আগেই পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ঢাকায় চালিয়েছে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ। পাকিস্তান রাষ্ট্রের মৃত্যুঘণ্টা বেজে গেছে এরই মধ্যে। বাঙালি জাতির মুক্তিসংগ্রাম তখন জনমত তৈরি করেছে পৃথিবীজুড়েই। নিজ দেশের একটি অংশের সাধারণ মানুষের ওপর নারকীয় অত্যাচারে মত্ত পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নৃশংসতা হতবাক করে দেয় বিশ্বের বিবেকবান মানুষদের। বাঙালি জাতি যখন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নির্বিচার নিধনের শিকার, সে সময় পাকিস্তান ক্রিকেট দল টেস্ট খেলতে পা রেখেছিল ইংল্যান্ডে।
বিলেতপ্রবাসী বাঙালিরা পাকিস্তান ক্রিকেট দলের সামনে সেদিন নিয়মতান্ত্রিক প্রতিবাদের মাধ্যমে রাষ্ট্রের নৃশংসতার বিরুদ্ধে জানিয়েছিল নিজেদের ক্ষোভ। সবাইকে ভাবতে বাধ্য করেছিল যে রাষ্ট্রের প্রতিনিধি হিসেবে ইন্তিখাব আলম, ইমরান খানরা ইংল্যান্ডে খেলতে গিয়েছেন, সেটি এখন বিভক্ত। সেই প্রতিবাদ ইংরেজ ক্রিকেট সমর্থকদের জানিয়ে দিয়েছিল কত বড় অন্যায়, কত বড় অনাচার পাকিস্তানিরা নিজেদের দেশের মানুষের সঙ্গেই করেছে। বাঙালিদের প্রতিবাদের মুখে পাকিস্তানি ক্রিকেটাররাও সেদিন ছিলেন বিব্রত, কিছুটা হয়তো লজ্জিতও।
বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী তখন বিলেতে প্রবাসী বাঙালিদের প্রতিবাদের মুখ। বাঙালিদের মুক্তি আন্দোলনের প্রতিনিধি। লন্ডনে তিনি বাঙালিদের সংগঠিত করছেন স্বাধীনতাসংগ্রামে উদ্বুদ্ধ হওয়ার জন্য। ব্রিটেনে তিনি ছড়িয়ে দিচ্ছেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার দাবি। জনমত গঠন করছেন পূর্ব পাকিস্তানে সব নারকীয় অত্যাচার আর অমানবিকতার বিরুদ্ধে।১৯৬৯ সালে আবু সাঈদ চৌধুরী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিযুক্ত হয়েছিলেন। ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের অধিবেশনে যোগ দিতে জেনেভায় গিয়েছিলেন। জেনেভায় থাকতেই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী সূত্রপাত করেছিল ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম অধ্যায়ের। ১৯৭১ সালের মার্চে ছাত্র আন্দোলনের ওপর সেনা ও পুলিশের গুলি চালানোর প্রতিবাদে ১৫ মার্চ উপাচার্যের পদ থেকে পদত্যাগ করেন বিচারপতি আবু সাঈদ
। শিক্ষাসচিবকে লেখা চিঠিতে সোজা জানিয়ে দিয়েছেন, ‘যে রাষ্ট্র নিরীহ ছাত্রদের নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করে, সে রাষ্ট্রে আমি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে থাকতে পারি না।’ ২৫ মার্চের কালরাত্রিতে গণহত্যার পর তিনি দেশের স্বাধিকারের সংগ্রামে অংশ নেওয়ার গুরুত্ব উপলব্ধি করে লন্ডন চলে যান। সেখানে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে জনমত গঠনে তাঁর ভূমিকা ঠাঁই নিয়েছে ইতিহাসে।লন্ডনে আবু সাইদ চৌধুরী খুব নিশ্চিন্তে যে জনমতের কাজ করতে পেরেছিলেন, সেটি বলা যাবে না। বরং পাকিস্তানি গুপ্তচরেরা বারবার তাঁর কাজে বাধার সৃষ্টি করেছে। ব্রিটেনের সঙ্গে পাকিস্তানের ভালো কূটনৈতিক সম্পর্ক একটা বড় বাধা ছিল। কিন্তু ব্যক্তির মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী ব্রিটিশ সরকার সেভাবে তাঁর কাজে সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়নি। আবু সাঈদ চৌধুরী ব্রিটেন সরকারের এ ব্যাপারই সুযোগ হিসেবে কাজে লাগিয়েছিলেন। কিন্তু সবকিছুই তাঁকে করতে হয়েছিল নিয়মতান্ত্রিক পন্থা অবলম্বন করেই, যুক্তরাজ্যের আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকেই। পাকিস্তান ক্রিকেট দলের বিরুদ্ধে প্রতিবাদও আবু সাঈদ চৌধুরীকে সংগঠিত করতে হয়েছিল নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে, আইনশৃঙ্খলা ঠিক রেখেই।
আবু সাঈদ চৌধুরীর সঙ্গে ছিলেন ইংল্যান্ডপ্রবাসী বাঙালিরা, নিজ জাতির দুঃসময়ে যাদের হৃদয়ে চলছিল রক্তক্ষরণ। প্রবাসীরা নিজ নিজ জায়গা থেকেই জানাচ্ছিলেন প্রতিবাদ। বাঙালিদের বিভিন্ন সংগঠনও কাজ করছিল জনমত গঠনে। ১৯৭১ সালের জুনে প্রবাসীরা মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যেকোনো মূল্যে পাকিস্তান ক্রিকেট দলের ইংল্যান্ড সফর প্রতিহত করার।তবে এতে একটা বড় সমস্যা ছিল। আবু সাঈদ চৌধুরী তাঁর ‘প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলি’তে এ সময়ের বর্ণনা দিয়েছেন। তাঁরা সচেতন ছিলেন প্রতিবাদের সময় এমন কিছু যেন না ঘটে, যাতে খেলাপাগল ব্রিটিশদের মধ্যে নেতিবাচক ধারণার জন্ম না হয়। এমনিতে সাধারণ ব্রিটিশরা বাঙালিদের ব্যাপারে ছিলেন সহানুভূতিশীল।বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি ব্রিটিশদের ক্ষুব্ধ করেছিল। কিন্তু তারপরও খেলা ও রাজনীতিকে দুটি ভিন্ন স্রোতে দেখতেই আগ্রহ ছিল তাদের। তাই পাকিস্তান ক্রিকেট দলের বিরুদ্ধে প্রতিবাদটা প্রবাসী বাঙালিদের করতে হয়েছিল খুবই সতর্কতার সঙ্গে।
সে সময় সিদ্ধান্ত হয়, টেস্ট ম্যাচগুলোতে মাঠের বিভিন্ন প্রবেশপথে প্ল্যাকার্ড নিয়ে দাঁড়িয়ে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ করার। পাকিস্তান দলকে বয়কট কিংবা টেস্ট ম্যাচ পণ্ড করে দেওয়ার চাইতে ম্যাচ দেখতে আসা হাজার হাজার দর্শককে পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নৃশংসতার ব্যাপারটি জানানোই সঠিক পদক্ষেপ।সে সফরে তিনটি টেস্ট অনুষ্ঠিত হয়েছিল এজবাস্টন, লর্ডস ও হেডিংলিতে। পাকিস্তান দলের খেলোয়াড়দের মধ্যে ছিলেন ইন্তিখাব আলম, জহির আব্বাস, ইমরান খান, আসিফ মাহমুদ, আসিফ ইকবাল, সেলিম আলতাফ, সাদিক মোহাম্মদের মতো ক্রিকেটাররা। ইলিংওয়ার্থের নেতৃত্বে ইংলিশ দলে ছিলেন বাসিল ডি’অলিভিয়েরা, কলিন কাউড্রে, অ্যালান নট, ডেরেক আন্ডারউড, ডেনিস অ্যামিসরা। তিনটি ভেন্যুতে প্রবাসী বাঙালিরা গ্যালারির প্রবেশমুখে দাঁড়িয়ে দর্শকদের মধ্যে প্রচারপত্র বিলি করেন। সেখানে লেখা ছিল পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালি হত্যাযজ্ঞের কথা।
ইংল্যান্ডের প্রবাসী পাকিস্তানিরাও বাঙালিদের প্রতিবাদ পণ্ড করতে এঁটেছিল নানা ফন্দি। গুজব ছিল, পাকিস্তানিরা গুন্ডা বাহিনী তৈরি করে স্যাবোটাজ করতে পারে নিয়মতান্ত্রিক প্রতিবাদের। আবু সাঈদ চৌধুরী তাঁর ‘প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলি’ বইয়ে সেটিও জানিয়েছেন। টান টান উত্তেজনার মধ্যে হাজারখানেক বাঙালি যখন সেই প্রতিবাদ করছিলেন, তখন তাঁদের মধ্যে পাকিস্তানের পতাকা নিয়ে প্রবেশ করতেন পাকিস্তানিরা। তাঁরা পাল্টা স্লোগান দিয়ে উত্তেজনা সৃষ্টি করতেন। কিন্তু সবার ওপর নির্দেশ ছিল, কোনোভাবেই পাকিস্তানিদের উসকানির ফাঁদে পড়া যাবে না।বাঙালিদের প্রতিবাদ ছিল পুরোপুরি শান্তিপূর্ণ। অনেক চেষ্টা করেও পাকিস্তানিরা কোনো উত্তেজনাই সৃষ্টি করতে পারেনি। ব্রিটিশ সরকার, লন্ডন পুলিশের কাছে প্রশংসিত হয়েছিল মুক্তিসংগ্রামী বাঙালিদের প্রতিবাদ। আবু সাঈদ চৌধুরীদের মূল উদ্দেশ্য হয়েছিল সফল।ক্রিকেট মাঠের ঐতিহাসিক সেই প্রতিবাদ সবাইকে জানাতে পেরেছিল, পাকিস্তান যখন খেলতে এসেছে, সেটি মোটেও স্বাভাবিক কোনো পরিস্থিতি নয়। নিজেদের দেশের মানুষ যখন হত্যাকাণ্ডের শিকার, তখন ক্রিকেট খেলাটা কোনোমতেই মানবিক কিছু হতে পারে না।বিলেতপ্রবাসীদের এ প্রতিবাদ রণাঙ্গনে যুদ্ধের চেয়েও কম কিছু ছিল না!