অহংকারঃ অন্তরের একটি রোগ

অহংকার অন্তরের মারাত্মক রোগগুলোর অন্যতম, যা আরবিতে ‘তাকাব্বুর’ নামে পরিচিত। অহংকার উদ্ভুত হয় আত্মম্ভরিতা থেকে; যার ফলে ব্যক্তি নিজের যোগ্যতা ও গুণের ব্যাপারে অতিশয় প্রভাবিত হয়ে পড়ে। ইংরেজিতে ‘to arrogate’ শব্দের অর্থ, কোনো ব্যাপারে অন্যায় দাবি করা। অহংকারী ব্যক্তি তার যোগ্যতা বা গুণের ব্যাপারে অন্যায় দাবি করে, যা প্রকৃতপক্ষে আল্লাহই তাকে দান করেছেন। সে অন্যকে উপহাস করার মাধ্যমে ঔদ্ধত্য প্রদর্শন করে। ইসলামে অহংকারকে তীব্র নিন্দা করা হয়েছে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা আমাদের বলেছেন, অহংকার কেবল তাঁর বৈশিষ্ট্য। একটি হাদিসে কুদসিতে আল্লাহ বলেন,

গৌরব আমার নিম্ন পোশাক এবং অহংকার আমার আবরণ। যে এই দুটি ব্যাপারে আমার সঙ্গে প্রতিযোগিতা করবে, নিশ্চয়ই আমি তাকে আজাবে পতিত করব। [১]

একইভাবে আল্লাহ সুরা লুকমানে বলেন,

﴿ۚوَ لَا تُصَعِّرۡ خَدَّکَ لِلنَّاسِ وَ لَا تَمۡشِ فِی الۡاَرۡضِ مَرَحًا ؕ اِنَّ اللّٰہَ لَا یُحِبُّ کُلَّ مُخۡتَالٍ فَخُوۡرٍ﴾

অহংকারের বশবর্তী হয়ে তুমি মানুষকে অবজ্ঞা করো না আর পৃথিবীতে গর্বভরে চলাফেরা করো না; নিশ্চয়ই আল্লাহ কোনো দাম্ভিক অহংকারীকে পছন্দ করেন না। [সুরা লুকমান : ১৮]

মুসলিমতিরমিজিতে বর্ণিত একটি সহিহ হাদিসে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বলেন,

অণু পরিমাণ অহংকার নিয়ে কেউ জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। [২]

অহংকার ও হিংসা অনেক সময় একত্র হয়ে যায়। শয়তানের জান্নাত থেকে বিতাড়িত হওয়ার কারণ ছিল তার অহংকার এবং নবি আদমের প্রতি হিংসা। এটি কুরআনে এভাবে বর্ণিত রয়েছে,

﴿قَالَ مَا مَنَعَكَ اَلَّا تَسْجُدَ اِذْ اَمَرْتُكَ ؕ قَالَ اَنَا خَیْرٌ مِّنْهُ ۚ خَلَقْتَنِیْ مِنْ نَّارٍ وَّ خَلَقْتَهٗ مِنْ طِیْنٍ ۝ قَالَ فَاهْبِطْ مِنْهَا فَمَا یَكُوْنُ لَكَ اَنْ تَتَکَبَّرَ فِیْهَا فَاخْرُجْ اِنَّكَ مِنَ الصّٰغِرِیْنَ﴾

তিনি বললেন, কীসে তোমাকে বাধা দিয়েছে যে সিজদা করছ না, যখন আমি তোমাকে নির্দেশ দিয়েছি? সে বলল, আমি তার চেয়ে উত্তম। আপনি আমাকে আগুন থেকে সৃষ্টি করেছেন আর তাকে সৃষ্টি করেছেন কাদামাটি থেকে। তিনি বললেন, সুতরাং তুমি এখান থেকে নেমে যাও। তোমার এ অধিকার নেই যে, এখানে তুমি অহংকার করবে। সুতরাং বের হও। নিশ্চয় তুমি লাঞ্ছিতদের অন্তর্ভুক্ত। [সুরা আরাফ : ১২, ১৩]

নবি মুসা আ.-এর মাধ্যমে আল্লাহর অলৌকিকতা আর সুস্পষ্ট নিদর্শন দেখার পরও ফিরআউন আল্লাহর ওপর ইমান আনেনি ঔদ্ধত্যের বশবর্তী হয়ে। সে তার অনুসারীদের বলেছিল,

﴿۫فَقَالَ اَنَا رَبُّکُمُ الۡاَعۡلٰی﴾

আর সে বলল, আমিই তোমাদের সর্বোচ্চ রব। [সুরা নাজিআত : ২৪]

অহংকারী মানুষজন একধরনের বিভ্রমে ভোগে। তাদের মনে হয়, তারা অন্য মানুষের তুলনায় উত্তম। তারা ধরেই নেয়, এসব গুণ (বুদ্ধিমত্তা, ক্ষমতা, সম্পদ) যা তাদের রয়েছে, সেগুলো চিরকালই তাদের সঙ্গে থাকবে। তারা বোঝে না, আল্লাহই তাদের এই নিয়ামত দান করেছেন। অহংকারের রোগ একক ব্যক্তিকে আক্রমণ করতে পারে, আবার গোষ্ঠীর ওপরও আঘাত হানতে পারে। কিছু মানুষ আধ্যাত্মিকতার দিক দিয়ে গৌরব অনুভব করে যখন তারা মনে করে, তারা অন্য ধর্মের মানুষদের তুলনায় শ্রেষ্ঠ। এ ধরনের অহংকার অমুসলিমদের প্রতি দাওয়াহর পথে মুসলিমদের জন্য সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। কারণ, এমন কাউকে দাওয়াহ দেওয়া সম্ভব নয়, যাকে আমরা অপছন্দ করি এবং মনে করি, আমরা সেই ব্যক্তির চেয়ে শ্রেষ্ঠ।

আরেক ধরনের অহংকার হচ্ছে ‘উজব’, যেখানে ব্যক্তি তার ক্ষমতা ও যোগ্যতার জন্য আত্মতুষ্টিতে ভোগে। ‘উজব’ নিজেই ইমানকে ধ্বংস করে দিতে যথেষ্ট এবং এটি আত্মতুষ্টিতে ভোগার ফল। তবে ‘উজব’ ভালো ও খারাপ উভয় কাজের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হতে পারে। একজন পুণ্যবান ব্যক্তি হয়তো তার সৎকাজ নিয়ে অন্তরে গৌরব লালন করতে পারে। একইভাবে কুকর্মকারীও তার কুকর্মের কারণে গর্ববোধ করতে পারে।

অহংকার ও আত্মতুষ্টিতে ভোগার এই রোগের সবচেয়ে উত্তম প্রতিষেধক হচ্ছে মৃত্যুকে সর্বদা স্মরণ করা। আমেরিকান মনোবিজ্ঞান এম. স্কট পেক পিএইচডি (M. Scott Peck), তার গ্রন্থ The Road Less Traveled-এ নারসিসিস্টদের [৩] ব্যাপারে লেখেন,

এ সকল মানুষ জীবনে সামান্য ব্যর্থতার ছোঁয়া পেলে তাদের অন্তরে লালিত হওয়া আত্মগৌরব আঘাতের সম্মুখীন হয়, যাকে মনোবিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় ‘নারসিসিস্টিক ইনজুরি’। আর যেকোনো মাপকাঠিতেই মৃত্যু সবচেয়ে গুরুতর নারসিসিস্টিক ইনজুরি। [৪]

তাই অধিক হারে মৃত্যুকে স্মরণ করলে তা অহংকার ও আত্মভরিতার অনুভূতিতে আঘাত হানবে। পাশাপাশি আমাদের মধ্যে বিনয়ের অনুভূতিকে লালন করতে হবে। নিজেদের সর্বদা মনে করিয়ে দিতে হবে, আমরা আল্লাহর দাস। আমরা নিজেদের অস্তিত্বের জন্য সম্পূর্ণরূপে তাঁর ওপর নির্ভরশীল। মক্কা বিজয়ের সময় উটে আরোহণরত অবস্থায় রাসুল রাসুল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম ১০ হাজার মানুষের বাহিনীর প্রধান হিসেবে শহরে প্রবেশ করেন। বিনয়ের কারণে তিনি তাঁর মাথাকে এতটাই অবনত করে রেখেছিলেন যে, তাঁর কপাল উটের কুঁজকে স্পর্শ করছিল। সালাত ও হজ আদায় ব্যক্তিকে বার বার প্রশিক্ষণ দিতে থাকে, সে সমাজের বিভিন্ন জাতের, বিভিন্ন পাতের মানুষদের মতোই আল্লাহর নিছক একজন দাস।

শায়খ হাসানুল বান্না (১৯০৬-১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দ) একজন আলিম ও ‘ইখওয়ানুল মুসলিমিন’-এর প্রতিষ্ঠাতা। ছাত্রজীবনে নিজের ব্যক্তিগত ডায়েরিতে তিনি তাঁর শিক্ষক শায়খ মুহাম্মাদ আবু শোশার ব্যাপারে লেখেন। শায়খ আবু শোশা তাঁর ছাত্রদের (তাদের মধ্যে হাসানুল বান্নাও ছিলেন) প্রতি সপ্তাহে কবরস্থানে নিয়ে যেতেন এবং তাদের মনে করিয়ে দিতেন, আমাদের প্রত্যেককেই একদিন এখানে চিরদিনের জন্য সমাহিত হতে হবে। মাঝেমধ্যে ছাত্রদের কবরের ভেতরে শুয়ে পড়তে বলতেন। কবরের একাকী জীবনের কথা কল্পনা করতে বলতেন। তিনি তাঁর ছাত্রদের বলতেন, এটাই হবে তাদের অন্তিম পরিণতি এবং তারা কবরের অন্ধকার জীবনেই একাকী সময় অতিবাহিত করবে। শায়খ আবু শোশা তাঁর ছাত্রদের উপদেশ প্রদানের সময় কাঁদতেন, যা তাঁর ছাত্রদের চোখেও অশ্রু এনে দিত। [৫] শায়খ হাসানুল বান্না ও তাঁর সহপাঠীরা যে অভিজ্ঞতা লাভ করেছেন, এর সঙ্গে কেবল এ-সংক্রান্ত গ্রন্থ অধ্যয়ন করা বা মৃত্যুর কথা শোনার কোনো তুলনাই হয় না। হাসানুল বান্নার শিক্ষক জানতেন, অধিক হারে মৃত্যুর স্মরণ আত্মিক অনেক রোগের মৃত্যু ঘটায়। এ ধরনের শিক্ষকদের অদম্য ছাপগুলো ছাত্রদের মধ্যে আল্লাহভীতি ও বিনয় সৃষ্টিতে অত্যন্ত কার্যকারী ভূমিকা রাখে।

[১] আল আদাবুল মুফরাদ : 554

[২] সহিহ মুসলিম : ৯১।

[৩] যারা অহংকারী ও নিজেকে অত্যধিক ভালোবাসে এবং সবসময় নিজেকে নিয়ে মুগ্ধতায় ভোগে।

[৪] Peck, M. Scott (1998). The Road Less Travelled. New York, Simon & Schuster.

[৫] হাসানুল বান্নার দিনলিপি, হাসানুল বান্না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *