দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণের প্রায় দেড় বছর হতে চলল। এই সময়ে অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানই তাদের কর্মী কমিয়েছে। স্বাভাবিকভাবে কমেছে তাদের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি। গত এপ্রিল থেকে সরকারি প্রতিষ্ঠানের নতুন নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিও খুবই কম। করোনার বিস্তার মোকাবেলায় সরকারের জারি করা বিধি-নিষেধের কারণে আটকে আছে একাধিক সরকারি নিয়োগ পরীক্ষাও।
পরীক্ষা নিতে না পারায় বিসিএসেও জট লেগে আছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বন্ধ থাকায় স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ের পরীক্ষাগুলোও আটকে আছে। কিন্তু চাকরিতে প্রবেশের বয়স তো স্থির হয়ে নেই। এ কারণে চাকরিপ্রার্থী তরুণরা খুবই হতাশ ও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত।
আগামী জুলাই মাসে ৩০ বছর পূর্ণ হবে রাজধানীর সরকারি তিতুমীর কলেজ থেকে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করা মো. শাহরিয়ারের। চাকরিতে প্রবেশের বয়স শেষ হয়ে যাবে তাঁর। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘স্বাভাবিক সময়ের মতো যদি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হতো তাহলে এই শেষ সময়ে অন্তত ১৫ থেকে ২০টা আবেদন করে রাখতে পারতাম। কিন্তু গত দুই মাস ধরে সরকারি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি নেই বললেই চলে। ব্যাংকসহ বড় বড় কম্পানিগুলোতেও নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি খুবই কম। সরকারও চাকরিপ্রার্থীদের ব্যাপারে অনেকটাই নীরব। ফলে প্রচণ্ড হতাশা ঘিরে ধরেছে।’
প্রায় এক বছর আগে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের আওতাধীন সরকারি কলেজে প্রদর্শক পদে আবেদন করেছিলেন সানাউল হক। তিনি বলেন, ‘গত এপ্রিলে আমাদের লিখিত পরীক্ষা হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু লকডাউনের কারণে তা আর হয়নি। এখন কবে পরীক্ষা হবে তাও বলছে না। এ ছাড়া তিতাস গ্যাসসহ আরো কয়েকটি সরকারি চাকরির পরীক্ষাও লকডাউনে আটকে আছে। এভাবে পরীক্ষা আটকে থাকলে বয়স চলে যাবে। খুবই চিন্তায় দিন পার করছি।’
করোনার ঊর্ধ্বমুখী সংক্রমণ ঠেকাতে সরকারের জারি করা ‘লকডাউনের’ কারণে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের (বিসিএস) একাধিক পরীক্ষা স্থগিত করেছে সরকারি কর্মকমিশন (পিএসসি)। ২০১৮ সালের আগস্টে ৪০তম বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে পিএসসি। এতে অংশ নেন তিন লাখ ২৭ হাজার পরীক্ষার্থী। তাঁদের মধ্যে প্রিলিমিনারিতে উত্তীর্ণ হন ২০ হাজার ২৭৭ জন। করোনা সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার কারণে তাঁদের মৌখিক পরীক্ষাও আটকে আছে। এ ছাড়া নন-ক্যাডারের কিছু পরীক্ষাও স্থগিত করা হয়েছে। তবে করোনার মধ্যেই গত ১৯ মার্চ ৪১তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষা নেওয়া হয়। আগামী ৬ আগস্ট ৪৩তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষা নেওয়ার কথা রয়েছে।
গত বছরের মার্চে দেশে প্রথম করোনা সংক্রমণ ধরা পড়ে। এরপর টানা ৬৬ দিন সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে সরকার। এরপর পরিস্থিতির উন্নতি হতে শুরু করলেও চলতি বছরের মার্চের শেষ সপ্তাহে আবার সংক্রমণ বাড়তে শুরু করে। এমন অবস্থায় গত ৫ এপ্রিল থেকে সরকার নিষেধাজ্ঞা (লকডাউন) জারি করে, যা এখনো চলছে।
গত এপ্রিলে বিধি-নিষেধ জারির পর তিতাস গ্যাস, সিলেট গ্যাস ফিল্ড, সেতু বিভাগ, পল্লী বিদ্যুৎ, শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর (ইইডি), দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়, রেলপথ মন্ত্রণালয়সহ আরো কয়েকটি সরকারি দপ্তর তাদের নিয়োগ পরীক্ষা স্থগিত করে। এ ছাড়া মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা (মাউশি) অধিদপ্তরের প্রায় চার হাজার লোক নিয়োগের একটি পরীক্ষাও আটকে আছে। যেখানে আবেদন করেছেন ৯ লাখেরও বেশি চাকরিপ্রার্থী।
মাউশি অধিদপ্তরের নিয়োগ কমিটির সদস্যসচিব ও উপপরিচালক (প্রশাসন) মো. রুহুল মমিন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘করোনার দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হওয়ায় আমরা লিখিত পরীক্ষা নিতে পারিনি। আমরা জুন মাসের প্রতি শুক্রবার পরীক্ষা নিয়ে অর্থাৎ চলতি অর্থবছরেই লিখিত পরীক্ষা শেষ করতে চেয়েছিলাম। প্রার্থীদের ইন্টারভিড কার্ডও দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু করোনার ঊর্ধ্বগতিতে তা আর সম্ভব হয়নি। সরকারি বিধি-নিষেধ শেষ হলে আমরা পরীক্ষা নেওয়ার চেষ্টা করব।’
আবু বকর নামের ঢাকা কলেজের এক শিক্ষার্থী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের পড়ালেখা শেষ করতেই বয়স হয়ে যায় ২৪-২৫ বছর। করোনার কারণে দেড় বছর ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। সে হিসাবে সরকারি-বেসরকারি চাকরির বয়স ফুরিয়ে আসছে। ফলে আমরা যাঁরা চাকরির বাজারে নতুন যুদ্ধে নেমেছি, তাঁরা অনেকটাই হাবুডুবু খাচ্ছি।’
চাকরিপ্রার্থীদের ক্ষতি পোষাতে গত বছরের সেপ্টেম্বরে বয়সের ক্ষেত্রে এক দফা ছাড় দেয় সরকার। তাতে ২০২০ সালের ২৫ মার্চ পর্যন্ত যাঁদের বয়স ৩০ বছর পেরিয়ে গেছে, তাঁরাও সরকারি চাকরিতে আবেদন করতে পেরেছেন। কিন্তু এখনো করোনার সংকট কাটেনি। সরকারের তরফ থেকে নতুন কোনো সিদ্ধান্ত না হওয়ায় চাকরিপ্রত্যাশীদের উদ্বেগ বাড়ছেই।
বেসরকারি অনেক প্রতিষ্ঠানে সংকট থাকলেও সরকারি চাকরিতে এখনো প্রায় সাড়ে তিন লাখ পদ ফাঁকা রয়েছে। এ ছাড়া বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ (এনটিআরসিএ) সর্বশেষ ৫৪ হাজার শিক্ষক নিয়োগের জন্য আবেদন গ্রহণ করেছে। কিন্তু উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী ওই নিয়োগ আটকে আছে।
কয়েকজন চাকরিপ্রার্থীর সঙ্গে কথা বললে তাঁরা জানান, অন্তত সরকারি চাকরির বিজ্ঞপ্তিগুলো করোনার মধ্যে চলমান থাকলেও প্রার্থীদের মনে আশার সঞ্চার হতো।
‘চাকরিতে প্রবেশের বয়স ৩২ চাই’ নামের একটি প্ল্যাটফর্মের কেন্দ্রীয় টিমের সদস্য তানভীর হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘করোনার প্রায় দেড় বছর হতে চলল। এই সময়ে মাত্র একটা বিসিএস পরীক্ষা হয়েছে। বড় চাকরির বিজ্ঞপ্তি নেই বললেই চলে। আমাদের হিসাবে, এই সময়ে প্রায় দেড় লাখ উচ্চশিক্ষিত চাকরিপ্রার্থী তাঁদের বয়স হারিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর কাছে করোনাকালীন প্রণোদনা হিসেবে চাকরিতে প্রবেশের বয়স ৩২ বছর করার দাবি জানাচ্ছি।’
সম্প্রতি বিডিজবসের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এ কে এম ফাহিম মাশরুর কালের কণ্ঠকে বলেছেন, ‘গত নভেম্বর থেকে চাকরির বাজার অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে আসছিল। কিন্তু করোনার দ্বিতীয় ঢেউ শুরুর পর এপ্রিল মাসে এরই মধ্যে ৫০ শতাংশ চাকরির বিজ্ঞাপন কমেছে। এখন এই দ্বিতীয় ঢেউ যদি তিন-চার মাস অব্যাহত থাকে, তাহলে বেসরকারি চাকরির বাজারে বড় ধরনের প্রভাব পড়বে।’