সায়াহ্নের আবছা আলো পৃথিবীকে ক্রমশ গ্রাস করছে। আঁধারের সুমুদ্দুরে ডুবানোর মাধ্যমে ঝলমলে একটি দিনের পরিসমাপ্তি ঘটলো মাত্রই। তবুও গোটা আকাশে একটু যেন আলোর রেশ রয়েই গেছে। মাগরিবের নামাজ শেষে, বেলকনিতে গিয়ে দাঁড়ালো মৌনতা।
বেলকনির গ্রিলে হাত রাখতেই, দু’হাত বন্দি কঙ্কণেরা খিলখিল করে হেসে উঠলো। আকাশের আবছা আলো এতক্ষণে অন্ধকারের রূপ নিয়েছে। একটি সন্ধ্যা তারা হাসছে মিটিমিটিয়ে। এরম পরিবেশেও মৌনতার মুখে হাসি নেই। কষ্টের তাপদাহে সে অতিষ্ঠ। ধৈর্যের বাঁধ আর কোনো শক্তি দিয়েই আটকে রাখা যাচ্ছে না। তবুও সে দাঁতে দাঁত চেপে সয়ে যাচ্ছে। কেবল আল্লাহর উপর ভরশার খুঁটিটা এখনো মজবুত আছে বলে।
আপন কাউকে কষ্টের কথা বলে যেরম স্বস্তি পাওয়া যায়, মৌনতাও আকাশ পানে চেয়ে সেরম স্বস্তি খুঁজে পায়। ঐ আকাশের শেষ প্রান্তে আরশে আযীমে যে তার রব বসে আছেন। যিনি তাকে দেখছেন, শুনছেন সব না বলা কথা।
মৌনতার চোখে জমে থাকা বাধ্য জল এবার যেন তার অবাধ্য হয়ে টুপটুপ করে পড়ছে। পড়ুক, এখানে তো কেউ নেই রব ছাড়া। রব দেখুক না তার বেদনার নীল জল। রবকে দেখাতে তার কোনো সংকোচ নেই। বরং আছে শান্তি, আছে তৃপ্ততা।
কান্না জড়ানো অস্ফুটস্বরে সে বললো-
حَسْبِيَ اللّٰهُ لاَ إِلَهَ إِلاَّ هُوَ عَلَيْهِ تَوَكَّلْتُ وَهُوَ رَبُّ الْعَرْشِ الْعَظِيْمِ
আল্লাহই আমার জন্য যথেষ্ট, তিনি ছাড়া আর কোনো হক্ব ইলাহ নেই। আমি তাঁর উপরই ভরসা করি। আর তিনি মহান আরশের রব্ব।
একটু পর তার তিনমাস বয়সী বাচ্চার কান্নার শব্দে সে দ্রুতগতিতে ঘরের দিকে পা বাড়ালো।
[১]
মৌনতা।
নামের সাথে তার ব্যক্তিত্বেরও রয়েছে আশ্চর্য রকমের মিল। অযথা কথার ফুলঝুরি ফোটে না তার মুখে। খুব প্রয়োজনেও যেন অনিচ্ছাকৃতভাবে কথা বলে সে। কারো প্রতি অভিযোগ নেই, নেই পরনিন্দা। তবুও বিয়ের পরদিন থেকেই সে তার শাশুমার অপছন্দের পুত্রবধু হয়ে গেছে। তার হেতুটা এখনো অজানা।
বাসর রাতে, তাদের গল্পের সিংহভাগ জুড়ে ছিল তার শাশুমা। মা পাগল ছেলেটার বউ হয়ে নিজেকে খুব ভাগ্যবতী বলে মনে হয়েছিল মৌনতার। তার ধারণা ছিল, যে ছেলে তার মাকে খুব বেশি ভালোবাসে, সেই ছেলে তার সহধর্মিণীকেও খুব ভালবাসবে।
কিন্তু দিনকে দিন, তার ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়ে যাচ্ছিল। সেটাকে সত্য বলে প্রমাণ করতে কত যে শ্রম আর কত যে সাধনা করেছে সে, তার ইয়ত্তা নেই। কিন্তু শাশুমার মন পায়নি। আর শাশুমার মন না পাওয়ায় সে হয়েছে স্বামীর চোখের বিষ।
বিয়ের পরদিন, ছেলের বউ আর ছেলেকে সামনে বসিয়ে শাশুমা গল্প করেছিলেন। তারই ফাঁকে বলেছিলেন, “বৌমা তোমার সকল প্রয়োজনীয় জিনিস কেনা লাগলে আমাকে বলবে। ছেলেটা আমার বড্ড বেখেয়ালি, ওর কখনই কিছু মনে থাকে না। আর তুমি বউ মানুষ। তোমার বাজারে যাওয়া একিবারে বেমানান। বাজার করার সময় আমিই বরং কিনে নিয়ে আসব।”
মৌনতা কিছু না বুঝেই মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানিয়েছিল। তারপর থেকে সামান্য একটা ক্রিম কেনার কথা তার স্বামীকে বললেও, তার স্বামী অপরাগতা প্রকাশ করে তার মাকে জানাতে বলে।
এমনিতেই সে মুখচোরা। আর সামান্য একটা ক্রিমের কথা শাশুমাকে বলবে? লজ্জায় সে আর কিছুই বলেনি স্বামী এবং শাশুমা দু’জনের কাউকে। উনারাও লক্ষ করেনি মৌনতার দিকে।
বাসায় পরিহিত জামা ছিঁড়ে গেলেও কিনে দেওয়ার কথা মনে থাকে না কারোরই। বাপের বাড়ি থেকে জামা বানিয়ে দিলেই কেবল পড়তে পারতো সে। এভাবে দিন যায়, কথাগুলো বলা হয় না কাউকে।
নতুন বউ থেকে পুরোনো বউ হয়েও তার কোনো শখ আহ্লাদ তার স্বামী পূরণ করেনি। এরই মাঝে সে অসুস্থ হলে একদিন বাপের বাড়ি যায়। মা তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলে, ডাক্তার শুভসংবাদ জানান।
নতুন অতিথির কথা শুনে মৌনতার ফ্যাকাশ ঠোঁটে ফুটে উঠে এক চিলতি হাসির রেখা। স্বপ্ন দেখার শুরুটা যেন তখন থেকেই। মনে আবির্ভাব হয় সংসারের সব সুখ। কল্পনায় ভাসতে থাকে, শাশুমা কত আনন্দে নাতি অথবা নাতনিকে নিয়ে খেলছে। তার স্বামীর বুকে করে তার আদরের সন্তানকে নিয়ে ঘুমোচ্ছে। কতই না সুখে ভরে উঠবে তার সংসার।
কল্পনায় এসব খণ্ডচিত্র দেখে, ডাক্তারের চেম্বারে বসেই তার সুখাশ্রু ঝরছে।
[২]
ডাক্তার দেখিয়ে সেদিনই মৌনতা স্বামীর বাড়ি চলে যায়। পোশাক পরিবর্তন না করেই শাশুমার ঘরে গিয়ে সালাম জানায়।
তিনি তখন এক খিলি পান মুখে পুরে বিছানায় আধোশোয়া। হাতে রিমোট, চোখ টিভির পর্দায়। তিনি স্টার জলসার একটি নাটক দেখছেন। মৌনতাকে দেখেও শাশুমা নির্লিপ্ত। কোনোরকমে সালামের জবাব দিয়ে তিনি আবারও টিভির পর্দায় মনোযোগী হোন। বউমা বাসা থেকে এসেছে। কেউ তাকে নিতে যায়নি।
সে একা এলো নাকি তার স্বামী গিয়ে নিয়ে এলো, কোনো কিছুই জিজ্ঞেসও করছে না। মৌনতা তবুও শাশুমার পাশে বসে রইল। আধাঘণ্টা পর, ঐ নাটক শেষ হলে শাশুমা মুখ তুলে তাকায়। সেই তাকানোতে বিরক্তি। তিনি জিজ্ঞেস করে, এভাবে বসে আছো যে? কিছু বলবা?
মৌনতা কাঁচুমাচু হয়ে মুখ নামিয়ে সলজ্জে বললো, মা আপনি দাদী হতে যাচ্ছেন।
কথাটুকু বলতেই যেন লজ্জা আরও বেড়ে গেলো তার। মুখ তুলতেই পারছে না।
শাশুমা একটু থেমে বললো, এত জলদি? বিয়েরই তো কেবল ২মাস হলো। আচ্ছা, বাচ্চা পেটে এসেই গেছে যেহেতু, কী আর করবা। একটু সাবধান হওয়া উচিত ছিল।
কথাটা শুনে মৌনতার মনে হলো, কেউ যেন তার মুখে বালিশ চেপে ধরেছে আর সে আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে একটু নিঃশ্বাস নেওয়ার জন্য। এরপর সে উঠে দাঁড়ালো।
নিজের ঘরে যাবার জন্য দরজার চৌকাঠে কাছে আসতেই শাশুমা ডাকলো। বললো, শোন। আমার জন্য এক কাপ চা আর নুডলস করে নিয়ে এসো তো। বিকেলে নাস্তা করা হয়নি। দেরী করো না যেন। আমার খুব খিদে পেয়েছে।
মৌনতা ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালো।
[৩]
“কি ব্যাপার মৌনতা, এত জলদি বাচ্চা এলো কেন? তুমি কোনো ব্যবস্থা নিতে পারোনি? কেবল তো বিয়ে করলাম। সংসার গুছিয়ে না নিতেই আরেকজন আসছে। বলি কি সে আসলে যে খরচাপাতি বেড়ে যাবে সেই খেয়াল আছে?” আবির এক নাগাড়ে কথাগুলো বলে থামলো। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে বউয়ের দিকে তাকিয়ে আছে।
মৌনতা যারপরনাই অবাক স্বামীর এহেন আচরণে। পোশাক পরিবর্তন না করেই শাশুমাকে নাস্তা করে দিয়ে সে মাত্র ফ্রেস হলো। আয়নার সামনে দাড়িয়ে চুলে বেণী করছিলো। ভাবছিলো, মা তেমন খুশি না হলেও আবির যখন জানবে তখন খুশি না হয়ে পারবেই না।
ভাবনার ছেদ পড়লো স্বামীর অপ্রত্যাশিত কথায়।
অফিস থেকে ফিরে আবির মায়ের ঘরেই আগে প্রবেশ করে। মা-ছেলের সেই আড্ডায় আর কেউ অংশ নিতে পারে না। মৌনতাও পারেনি কখনো।
সে বুঝতে পারলো, মা-ছেলেতে আজ এই বিষয় নিয়ে কথা হয়েছে। মা-ই আবিরকে জানিয়েছে বাচ্চার বিষয়টা।
স্বামীর মুখে এরম কথা শুনে তার হাত যেন অবশ হয়ে আসছিল। সে কিছুতেই বেণীতে আর এক গোছা চুলও মোড়াতে পারলো না। ছেড়ে দিল। সিল্কি চুল ভীষণ অবাধ্য হয়ে পুরো বেণীটাই খুলে দিল।
মৌনতা নিশ্চুপ। আবিরও উত্তরের অপেক্ষায় চুপ হয়ে আছে। ঘরে আর কোনো শব্দ নেই। শুধু ফ্লোরের কার্পেটের উপর মৃদু শব্দ হচ্ছে ‘টুপ টাপ, টুপ টাপ’।
মৌনতা হাজার চেষ্টা করেও কান্না আটকিয়ে রাখতে পারছে না। নিরবে চোখের পানি ফেলছে। বুকটা ভারী হয়ে আছে। মনে হচ্ছে বুকের উপর কেউ ৭০ মণ ওজনের পাথর রেখে দিয়েছে। কষ্ট হচ্ছে খুব। হাউমাউ করে কাঁদতে পারলে বোধ হয় বুকের সেই পাথরটা সরে যেত।
কিন্তু স্বামীর সামনে কিছুতেই সে এত জোরে কাঁদতে পারবে না। কান্নার দমকে একটু পর পর হেঁচকি উঠছে।
তাতে বোধ হয় আবিরের মায়া হলো কিছুটা। সে একটু বিব্রতভাবেই বললো, কাঁদার কি আছে বুঝি না। একটু কিছু হলেই এত কাঁদো কেন? আমি তো বাস্তবতার কথা বললাম। আর কেঁদেও তো ফায়দা নেই। বাচ্চা নষ্ট করতেও তো পারবা না।
বাচ্চা নষ্ট করার কথা শুনে মৌনতা চমকে আবিরের দিকে তাকালো। এ কি বললো সে! এই বাচ্চা তো তারও। তাহলে একটুও মায়া নেই তার? মৌনতার স্বপ্নগুলো যেন ভাঙ্গা কাঁচের মতো ঝরঝর করে পড়ে গেল।
[৪]
আট মাসের গর্ভবতী অবস্থায় আবির মৌনতাকে রেখে যায় তার বাপের বাড়ি। মাঝেসাঝে সে যদিও দেখতে আসে কিন্তু কেমন যেন উদাসীন হয়ে থাকে। মৌনতার প্রতি যেন তার কোনো টান নেই, ভালোবাসা তো দূর কি বাত!
মৌনতা প্রায়ই শাশুমাকে কল করে। শাশুমার ইচ্ছে হলে রিসিভ করে, ইচ্ছে না হলে করে না। তবুও সে তার বাপের বাড়ির কাউকে কিচ্ছু বলে না, বুঝতেও দিতে চায় না।
কিন্তু তার মা কিছুটা আঁচ করতে পারে। তাকে জিজ্ঞেস করলে সে হাসিমুখে একটা বাহানা দেখিয়ে কথা কেটে দেয়।
দেখতে দেখতে তার ডেলিভারির সময় চলে আসে। মৌনতা বেদনায় ছটফট করতে থাকে। তার বাবা আবিরকে কল দিয়ে সবটা জানায়।
আবির জানায় সে অফিসে একটা গুরুত্বপূর্ণ মিটিং এ আছে। ফ্রি হলে কথা বলবে। আর অবস্থা বেশি খারাপ হলে হসপিটালে ভর্তি করার কথাও বলে। এরপর ফোন কেটে দেয়।
.
সন্ধ্যা ৭টা ৪৫ মিনিট। মৌনতার কোলে ফুটফুটে একটি মেয়ে। মেয়ের মুখের আদল একদম তার বাবার মতো হয়েছে। সেই মুখের দিকে তাকিয়ে মৌনতা ভুলে গেছে সকল দুঃখময়ী স্মৃতিকথা।
বাচ্চা কোলে নিয়েই সে শাশুমাকে ফোন দিয়েছিলো বেশ কয়েক বার। তিনি ফোন উঠাননি।
ঘণ্টাখানিক পর আবির এলো খালিহাতে। একগুচ্ছ ফুল কিংবা এক ঝুড়ি ফলও কিনতে বোধ হয় সে ভুলে গিয়েছিল। এই ভেবে মৌনতা নিজেকে সান্ত্বনা দেয়। সে যে এসেছে, এটাই তো বড় কথা।
বাচ্চাকে কোলে নিয়ে বসে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর হাতঘড়ি দেখে জানায়, রাত অনেক হয়েছে। এবার বাড়ি ফিরতে হবে, মা একা।
কেউ কিছু বলে না। আবির নিজের মতো করে উঠে চলে যায়। আর যাওয়ার আগে জানায়, কালও আসবে সে। মা অনুমতি দিলে রাতটা হাসপাতালেই কাটাবে মেয়ের সাথে।
[৫]
বাচ্চার বয়স তিন মাস। আজ বিকেলে কোর্ট থেকে বিচ্ছেদ কাগজ এসেছে। আবির জানিয়েছে, সে মৌনতার সাথে সংসার করতে পারবে না। তালাকনামায় যেন সই করে দেয়।
দরকার হলে বাচ্চাটাও তারা নিয়ে নিবে। তবুও মৌনতাকে নয়। কারণ কী?
কারণ হলো, শাশুমা মৌনতাকে পছন্দ করে না।
মৌনতা এরপর হাজারবার তার স্বামীকে কল করেছে। কিন্তু তার নাম্বারটা আবির ব্লাকলিস্টে ঢুকিয়ে রেখেছিল ততক্ষণে। মৌনতা পাগলের মতো যার ফোনই সামনে পায়, তার ফোন দিয়েই কল করে যায়। প্রথমে কল রিসিভ করলেও মৌনতার কন্ঠ শুনে সে কল কেটে দেয়।
শাশুমাও ফোন নাম্বার ব্লাকলিস্টে রেখে দিয়েছে। মৌনতা এই প্রথম উচ্চরবে কেঁদে উঠলো সন্তানকে বুকে জড়িয়ে।
মেয়ের এহেন কষ্ট সহ্য করতে না পেরে মৌনতার বাবা-মা দু’জনেই কেঁদে ফেলেন। মেয়েকে সান্ত্বনা দেবার ভাষাও তাদের জানা নেই। এরপর দু’জনে মৌনতার স্বামীর বাড়িতে তার শাশুমার কাছে যায়। শুধু এতটুকু জানতে যে, তাদের মেয়ের দোষ কী? কিন্তু শাশুমা ফটকের দরজাই খোলেনি।
___||”শাশুমা”||____
লেখা: মেহেজাবীন শারমিন প্রিয়া