ফিলিস্তিনে আজ বৃহস্পতিবার পবিত্র ঈদুল ফিতর। অথচ আজও ফিলিস্তিনিদের ঘুম ভেঙেছে ইসরায়েলের বোমার শব্দে। গত রাত থেকে এই লাগাতার বোমা হামলা চলছে। গাজা উপত্যকাসহ বিভিন্ন এলাকায় হামলায় নারী-শিশুসহ অন্তত ৬৫ জন গত কয়েকদিনে নিহত হয়েছেন। জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই ফিলিস্তিনিদের মৃত্যু দেখে আসছি। জানি না এর শেষ কোথায়!
আমার মনে আছে, ছোটবেলায় ঈদ ও জুমার নামাযে গেলেই ফিলিস্তিনিদের জন্য শুধু দোয়া করা হতো। একটু বড় হয়ে খবরের কাগজে নিয়মিত পড়ে আর টিভিতে খবর দেখে মন খারাপ হতো। বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন নিয়ে বিস্তারিত পড়তে পড়তে মনে হতো, পৃথিবীর ইতিহাসে এমন অনাচারও ঘটে। এই যে গত ৭৩ বছর ধরে এভোবে চলছে এর শেষ কোথায়?
চলেন একটু ইতিহাসে যাই। পবিত্র আল আকসা মসজিদ আর জেরুজালেম নিয়ে মুসলমান, খ্রিষ্টানদের মধ্যে সংঘাত হয়েছে বহুবার। তবে সপ্তম শতক থেকেই ইসরায়েল মুসলিমদের দখলে। ১০৯৯ সালে এটি খ্রিস্টানদের দখলে যায়। ১১৮৭ সালে এটি আবার আইয়ুবীয় রাজবংশের অধীনে চলে যায়। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে ইসরায়েল মিশরের মামলুক সুলতান এর নিয়ন্ত্রণে আসে। ১৫১৭ সালে এটি উসমানীয় সাম্রাজ্যভুক্ত হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়েও উসমানীয় খেলাফতের অধীন ছিল। কিন্তু তুরস্ক ওই বিশ্বযুদ্ধে ছিল বৃটেন বিরোধী জোটে৷ তাদের পরাজয় হয়।
এমনটা শোনা যায়, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটেনের প্রয়োজন দুর্লভ বোমা তৈরির উপকরণ কৃত্রিম ফসফরাস তৈরি করতে সক্ষম হন ইহুদি বিজ্ঞানী ড. হেইস বাইজম্যান৷ ফলে আনন্দিত ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ড. হেইসের কাছে জানতে চাইলেন কী পুরস্কার চান? উত্তর ছিল, অর্থ নয় তিনি তাঁর স্বজাতি ইহুদিদের জন্য এক টুকরো ভূমি চান আর তা হবে ফিলিস্তিনে। আবার হাঙ্গেরীতে জন্ম নেয়া আরেক ইহুদি বিজ্ঞানী এডওয়ার্ড টেলার যাকে হাইড্রোজেন বোমার জনক বলা হয়, যিনি নাজি বাহিনী থেকে বাঁচতে আমেরিকায় চলে যান এবং মার্কিন পরমাণু পদার্থবিদ ছিলেন। মনে করা হয় এই ধরনের বিজ্ঞানীদের কাজের পুরস্কার হিসেবেই আমেরিকা-ব্রিটেন ইহুদিদের জন্য একটা রাষ্ট্র গঠন করার প্রতিশ্রুতি দেন। তবে এগুলোর রেফারেন্স পাওয়া কঠিন।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তুরস্কের উসমানীয় সাম্রাজ্যের পতনের পর ইসরায়ের ভূখণ্ডটি ব্রিটিশরা তাদের অধীনে নিয়ে নেয় এবং নাম রাখে ‘মেন্ডেটরি প্যালেস্টাইন’। ১৯১৭ সালের ২ নভেম্বর ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী আর্থার জেমস বালফোর ইহুদীবাদীদেরকে লেখা এক পত্রে ফিলিস্তিনী ভূখণ্ডে একটি ইহুদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি ঘোষণা করেন।
১৯১৭ সালের নভেম্বর মাসে তুরস্কের সেনাদের হাত থেকে জেরুজালেম দখল করে ব্রিটেন। স্বাধীনতা দেয়ার অঙ্গীকারে ১৯১৭ সালে থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত ফিলিস্তিনের ভূমি ব্রিটেনের নিয়ন্ত্রণে রাখে৷ মূলত এই সময়টিই ফিলিস্তিনকে আরব শূন্য করার জন্য ভালোভাবে কাজে লাগায় ইহুদি বলয় দ্বারা প্রভাবিত ইঙ্গ-মার্কিন শক্তি।
ইহুদীরা কিন্তু সপ্তম শতাব্দী থেকেই বিভিন্ন জায়গায় পালিয়ে বেড়িয়েছে। তারা ছড়িয়ে ছিল ইউরোপ মহাদেশে। বালফোর ঘোষণার পর থেকে আলাদা রাষ্ট্রের সম্ভাবনা উজ্জ্বল হলে বিপুলসংখ্যক ইহুদি ইউরোপ থেকে ফিলিস্তিনে এসে বসতি স্থাপন করতে থাকে। তারা সমানে জমি কিনতে থাকে। তবে তখনো মুসলমান এবং ইহুদীদের মধ্যে সম্পর্ক মোটামুটি বন্ধুত্বপূর্ণ ছিল।
ইউরোপ কিংবা খ্রিষ্টীয় চার্চ লাগাতারভাবে ইহুদিদের ওপর নিপীড়ন ও গণহত্যা চালালেও মুসলামনরা কিন্তু সিরিয়া থেকে শুরু করে অনেক আরব দেশেও তাদের জায়গা দিয়েছে মানবিক কারণে। তবে ইহুদিদের মধ্যে সবসময় স্বাধীন একটা রাষ্ট্রের আকাঙ্খা ছিল।
১৯২৩ সালে স্বাধীন তুরস্কের জন্ম হলে এই অঞ্চলে ইহুদীরা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য উদগ্রীব হয়ে যান। ইউরোপের বিভিন্ন দেশ যেমন ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি, নরওয়ে, পোল্যান্ড, গ্রীস এবং সুইজাল্যান্ডে বসবাসকারী ইহুদীদেরকে নেতারা আহ্বান জানান ইসরায়েলে বসতি গড়তে। তাছাড়া ব্রিটিশ সরকার ইহুদীদেরকে তাদের নিজস্ব ভূমি ছেড়ে দেবে বলে প্রতিশ্রুতি দেয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে প্রায় আড়াই লাখ ইহুদী মানুষ ইসরায়েল ভূখণ্ডে পাড়ি জমায়। তারা দলে-দলে সেখানে আসে এবং জমি ক্রয় করতে থাকে।
১৯৩৩ সালের পর থেকে জার্মানির শাসক হিটলার ইহুদিদের প্রতি কঠোর হতে শুরু করেন। তখন জাহাজে করে হাজার হাজার ইহুদি অভিবাসী ফিলিস্তিনী ভূখণ্ডে আসতে থাকে এবং ইহুদিদের তৎপরতা আরও বেড়ে যায়। তারা সমানে দখল করতে চায়। ব্রিটিশ শাসন ও ইহুদিদের এই দখলদারির বিরুদ্ধে ১৯৩৬-১৯৩৯ সালে সংঘটিত হয় আরব বিদ্রোহ। ওই বিদ্রোহ দমন করা হয়। নিহত হয় পাঁচ হাজার আরব।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলে ফিলিস্তিন নিয়ে আরব ও ইহুদিদের মধ্যে বৈরিতা বেড়ে যায়। এই সময় ফিলিস্তিনের ওপর ম্যানডেট ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় ব্রিটিশ সরকার। এই ভূ-ভাগ্য নির্ধারণে সদ্যগঠিত জাতিসংঘকে অনুরোধ জানানো হয়।
এরপর ১৯৪৭ সালের ২৯ নভেম্বর, নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ফিলিস্তিনকে বিভক্ত করা নিয়ে বিতর্কিত ‘প্রস্তাব ১৮১’গ্রহণ করে। প্রস্তাবটি তিন মিনিটের কম সময়ের ভোটাভুটিতে পাস হয়। প্রস্তাব পাসের সময়টায় ফিলিস্তিন ছিল ১৩ লাখ ফিলিস্তিনি আরবের বসতি; বিপরীতে সেখানে ছিল ৬ লাখ ইহুদির বাস। বিভক্তির প্রস্তাব অনুসারে ইহুদিরা মোট ভূখণ্ডের ১০ শতাংশের মালিক হলেও তাদের দেয়া হয় মোট জমির অর্ধেক। পরের বছরের ১ আগস্টের মধ্যে স্বাধীন ইহুদি ও আরব রাষ্ট্র গঠনের কথা ছিল। আরবদের বিরোধিতা সত্ত্বেও যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনে পরিকল্পনাটি এগিয়ে যায়।
প্রস্তাবিত ইহুদি রাষ্ট্রের জন্য বরাদ্দ হয় ১৪ হাজার বর্গকিলোমিটার (৫ হাজার ৪০০ বর্গমাইল) স্থান। আর সংখ্যাগরিষ্ঠ ফিলিস্তিনি আরবদের জন্য বরাদ্দ হয় সাড়ে ১১ হাজার বর্গকিলোমিটারের (৪ হাজার ৪০০ বর্গমাইল) তিনটি এলাকা। আর জেরুজালেম ও এর আশপাশের এলাকা নিয়ে গঠন করা হয় এক বিশেষ আন্তর্জাতিক অঞ্চল। স্বভাবতই আরবরা এই সিদ্ধান্ত মেনে নেয়নি।
অন্যদিকে জাতিসংঘের সিদ্ধান্তের পর বিজয় উল্লাস শুরু করে ইহুদিরা। এই প্রথম একটি স্বাধীন ভূখণ্ড পেল তারা। ইহুদিদের সশস্ত্র দলগুলো তখন প্রকাশ্যে আসা শুরু করে। তবে ইহুদীরা বুঝতে পেরেছিল যে নতুন রাষ্ট্র গঠনের পর আরবরা মেনে না নিয়ে প্রতিরোধ করবে। ইহুদিদেন ছিল বিচক্ষণ নেতৃত্ব। সম্ভাব্য যুদ্ধের জন্য আগে থেকেই তৈরি ছিল ইহুদিরা। তাদের গোপন অস্ত্র কারখানাও ছিল।
ফিলিস্তিনী আরবরা বুঝতে পারে যে তাদের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়ছে। নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য তারা তখন বিদ্রোহ করে। তাদের হামলার লক্ষ্যবস্তু হয়েছিল ব্রিটিশ সৈন্য এবং ইহুদি নাগরিকরা। কিন্তু আরবদের সে বিদ্রোহ কঠোর হাতে দমন করেছে ব্রিটিশ সৈন্যরা। সাথে ছিল ইসরায়েলের গোপন বাহিনী। হত্যা, ধর্ষণ থেকে শুরু করে নানা অপরাধ করতে থাকে।
ওই সময় ফিলিস্তিনদের উপর ব্রিটিশ সৈন্যরা এতো কঠোর দমন-পীড়ন চালিয়েছিল যে তারা ভূমি ছাড়তে বাধ্য হয়। ইহুদিরা একের পর এক কৌশলগত জায়গা দখল করে নেয়। আরবরাও তখনো দ্বিধাগ্রস্ত। ফিলিস্তিনের একজন নেতা আল-হুসেইনি সংকট মোকাবেলায় সিরিয়া গিয়েছিলেন অস্ত্র সহায়তার জন্য। কিন্তু সিরিয়া সরকার ফিলিস্তিনদের সে সহায়তা দিতে অস্বীকৃতি জানায়। সেখান থেকে ফিরে এসে আল হুসেইনি আবারো যুদ্ধে নামেন। এর কয়েকদিন পরেই তিনি নিহত হন।
ইহুদিরা তখন আক্রমণের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দেয়। ইহুদি গোপন সশস্ত্র গ্রুপগুলোর নৃশংসতা আরবদের মনে ভয় ধরিয়ে দেয়। বহু ফিলিস্তিনী আরব তাদের বাড়ি ঘর ছেড়ে পালিয়ে যায়। ইহুদিদের ক্রমাগত এবং জোরালো হামলার মুখে ভেঙ্গে পড়তে শুরু করে ফিলিস্তিনীরা। এরপর এলো সেই কালো দিন।
১৯৪৮ সালের ১৪ই মে। ওইদিন ফিলিস্তিন ছেড়ে চলে যায় ব্রিটেন তৎকালীন ইহুদি নেতারা ঘোষণা করেন যে সেদিন রাতেই ইহুদি রাষ্ট্রের জন্ম হবে। হলোও তাই। অবশ্য ইসরায়েল রাষ্ট্রের জন্মের এক ঘন্টার মধ্যেই আরবরা আক্রমণ শুরু করে। একসাথে পাঁচটি আরব দেশ মিশর, ইরাক, লেবানন, জর্ডান এবং সিরিয়া ইসরায়েলকে আক্রমণ করে।
ওই সময় সবার দৃষ্টি ছিল জেরুজালেম শহরের দিকে। জাতিসংঘ সিদ্ধান্ত দিয়েছিল জেরুজালেম আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রণে থাকেবে। তবে আরব কিংবা ইহুদি- কোন পক্ষই সেটি মেনে নেয়নি। ইহুদিরা ভাবলো জেরুজালেম ছাড়া ইহুদি রাষ্ট্রের কোন অর্থ নেই। অন্যদিকে মুসলমানদের জন্যও জেরুজালেম পবিত্র জায়গা। ফলে লড়াই চললো।
তীব্র লড়াইয়ের এক পর্যায়ে ইসরায়েলি বাহিনী পিছু হটতে থাকে। তাদের অস্ত্রের মজুত শেষ হয়ে যায়। সম্ভাব্য পরাজয় আঁচ করতে পেরে ইহুদিরা নিজেদের শক্তি সঞ্চয়ের জন্য সময় নেয়। আর কিছুদূর অগ্রসর হলেই মিশরীয় বাহিনী তেল আবিবের দিকে অগ্রসর হতে পারতো। কিন্ত আবারও এলো জাতিসংঘ।
জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় দুই পক্ষের যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়। আর এই সময়ে চেকোস্লোভাকিয়ার কাছ থেকে আধুনিক অস্ত্রের চালান আসে ইসরায়েলের হাতে। যুদ্ধ বিরতী শেষ হলে নতুন করে আরবদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ইসরায়েলি বাহিনী। এবার উল্টো তারা একের পর এক গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল করে নেয় ইহুদিরা। পরাজিত হয় আরবরা। আর ইসরায়েল দেশটির জন্ম স্থায়ী হয়ে যায়। আর গত ৭৩ বছরে তো ইসরায়েল মোটামুটি সুপারপাওয়ার হয়ে গেছে।
মিত্রদের সহযোগিতা ও আশকারায় এখন তো অপ্রতিরোধ্য ইসরায়েল। ষাটের দশকে পারমাণবিক বোমার মালিক হয়েছে। যতো শক্তি বেড়েছে তাদের দখলদারি ও বর্বরতা আরও বেড়েছে। এরপর আরব-ইসরায়েলের মধ্যে ১৯৫৬, ১৯৬৭ ও ১৯৭৩ সালে আরও তিনটি যুদ্ধ হয়েছে। কিন্তু তাতে ফিলিস্তিনের ভাগ্যে দুর্ভোগ ছাড়া আর কিছুই জোটেনি।
বরং ১৯৬৭ সালের ছয় দিনের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের পর গাজা এবং সিনাই উপদ্বীপ দখল করে নেয় ইসরায়েল যা ১৯৪৮ সাল হতে মিশরের নিয়ন্ত্রণে ছিল। অন্যদিকে পূর্ব জেরুসালেম-সহ পশ্চিম তীরও তারা দখল করে নেয় জর্দানের কাছ থেকে। সিরিয়ার কাছ থেকে দখল করে গোলান মালভূমি। আরও পাঁচ লাখ ফিলিস্তিনিকে তাদের বাড়ি-ঘর ফেলে পালাতে হয়।
জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়গুলো সবসময় ইসরায়েলের দুর্বৃত্তপনার পক্ষে। আর মুসলমানররাও ঐক্যবদ্ধ নয়। ফলে মধ্যপ্রাচ্যের ৩২ কোটি মুসলমানের বিপরীতে মাত্র ৭০ লাখ ইহুদি বারবার জয়ী হয়। তাদের যখন ইচ্ছে হয়, বায়তুল মুকাদ্দাস মসজিদে নামাজ আদায় বন্ধ করে দেয়। এমনকি নামাজরত মুসুল্লিদের ওপরও গুলি চালিয়েছে একাধিকবার। কিন্তু মুসলমানরা ঐক্যবদ্ধভাবে কিছেু করতে পরেনি।
বরং বিস্ময় জাগে, আজকে যে তুরস্ককে আমরা মুসলমানদের খেলাফত মনে করি সেই তুরুস্ক কিন্তু ১৯৪৯ সালের মার্চ মাসে ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দিয়ে দেয়। একবার ভাবুন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতিদানকারী প্রথম মুসলিমসংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ সেই তুরুস্ক।
এরপর একই পথে দুই আরব প্রতিবেশী মিশর ও জর্দানের সাথেও ইসরায়েল শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করে। এই দেশ দুইটিও স্বীকৃতিও দেয় ইসরায়েলকে। সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইনের সাথে ইসরায়েলের ঐতিহাসিক চুক্তি তো কদিন আগেই হলো সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের উপস্থিতিতে। সৌদি আরবের সঙ্গে তো ইসরায়েলের দারুণ সম্পর্ক। কিন্তু ব্যতিক্রম বাংলাদেশ।
বর্তমানে পৃথিবীর ১৬১টি রাষ্ট্র ইসরায়েলকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিলেও বাংলাদেশসহ ৩১টি রাষ্ট্র ইসরায়েলের সার্বভৌমত্ব মেনে নেয়নি। ইসরায়েলের সাথে বাংলাদেশের কোনও কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই। অথচ ইসরায়েল কিন্তু বাংলাদেশকে প্রথম স্বীকৃতি দিয়েছিল।
১৯৭১ সালের এপ্রিলের ২৮ তারিখে বাংলাদেশ সরকারকে ইসরাইল স্বীকৃতি প্রদান করে একটি চিঠি পাঠায় এবং সেই সাথে অস্ত্র সাহায্য দেবে বলে প্রতিশ্রুতি প্রদান করে। কিন্তু তৎকালীন মুজিব নগর সরকার সেই স্বীকৃতি ফিরিয়ে দেয়। ইসরায়েল দ্বিতীয়বার আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয় ১৯৭২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি। ইসরায়েলের পররাষ্ট্র মন্ত্রী বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুস সামাদ আজাদকে তারবার্তা পাঠান। তবে তৎকালীন সরকার এর জবাব দেবার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেনি।
বাংলাদেশের মুসলমানিত্ব নিয়ে অনেক সময় আরবরা প্রশ্ন তুলে। অথছ বাংলাদেশ কিন্তু ইসরায়েলকে নৈতিক রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকার করে না। বরং বাংলাদেশী নাগরিকদের ইসরায়েলে ভ্রমনে সরকারী নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। বাংলাদেশের পাসপোর্ট ইসরায়েল ব্যতিত বিশ্বের সকল দেশ ভ্রমনের জন্য বৈধ। শুনে অবাক হবেন, বাংলাদেশ পৃথিবীর একমাত্র রাষ্ট্র যেটি ইসরায়েলের সাথে সকল প্রকার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ বাণিজ্যের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে।
অন্যদিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেই ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে তার প্রথম ভাষণেই ফিলিস্তিনি জনগণের সংগ্রাম ও আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানান। ১৯৭৪ সালে ওআইসির দ্বিতীয় সম্মেলনেও তিনি একই সমর্থন জানান। স্বাধীনতার পর থেকেই ফিলিস্তিনের পক্ষে বাংলাদেশের এ অবস্থানে অটল রয়েছে।
সম্প্রতি আল-আকসা মসজিদ এলাকায় ইসরায়েলি বাহিনীর হামলাকে সন্ত্রাসী হামলার সঙ্গে তুলনা করে কঠোর ভাষায় নিন্দা জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসকে লেখা এক চিঠিতে সঙ্কটময় এই পরিস্থিতিতে ফিলিস্তিনের ভ্রাতৃপ্রতীম জনগণের পাশে থাকার কথাও জানিয়েছেন তিনি।
শেখ হাসিনা স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রতি সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করে বলেন, পূর্ব জেরুজালেমকে রাজধানী করে ১৯৬৭ সালে নির্ধারিত সীমা অনুযায়ী একটি স্বাধীন সার্বভৌম ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের অধিকার ওই ভূখণ্ডের জনগণের আছে।
তবে আদৌ কী কোনদিন ফিলিস্তিন একটি স্বাধীন ভূখন্ড পাবে? এই তো আর দুদিন পর ১৫ মে ফিলিস্তিনকে বিভক্ত করে দুটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় জাতিসংঘের গৃহীত প্রস্তাবের ৭৪ বছর হতে যাচ্ছে। ১৯৪৭ সালের জাতিসংঘের প্রস্তাব অনুসারে কিন্তু একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রেরও প্রতিষ্ঠার কথা। কিন্তু ৭৪ বছর পরেও অধরাই রয়ে গেছে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র। তবে স্বাধীন রাষ্ট্রের দাবিতে ফিলিস্তিনিদের রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম চলছে। চলবে। আর তাতে সমর্থন আছে বাংলাদেশের। এখানকার সব মানুষের।
Shariful Hasan