দিনাজপুর সংবাদাতাঃ “সকালে উঠিয়া আমি মনেমনে বলি সারাদিন আমি যেন ভাল হয়ে চলি”, “লেখাপড়া করে যে গাড়ি ঘোড়ায় চড়ে সে” এ ছড়া পড়াতে পড়াতে তার শ্রেণিকক্ষ হত মুখরিত। তাঁর সুরলিত কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে শিক্ষার্থীরাও দেখিয়েছে কণ্ঠের যাদু। এমন মহান শিক্ষাগুরুর নিকট থেকে শিক্ষা নিয়ে এলাকার অনেক শিক্ষার্থী আজ বড় বাড়িতে থাকেন আর চড়েন বিলাশবহুল গাড়িতে। কিন্তু সেই শিক্ষাগুরু আজ জীবনের শেষ সময়ে এসে নিজের বিদ্যাপীঠে শিক্ষার্থীদেরকে শেখানো সেই মহামূল্যবান বাণীর নিকট পরাজিত হয়ে সহায়-সম্বলহীন জীবন-জাপন করছেন। শ্রেণিকক্ষের ব্লাকবোর্ডে চকের আঁচড়ে যে হাত ছিল শিক্ষার্থীদের জন্য আশা জাগানিয়া, দু’মুঠো ভাতের জন্য সেই হাত আজ পাততে হয় অন্যের নিকট।
মুজিবুর রহমান মন্ডল। বয়স ৮০। তিনি দিনাজপুর জেলার বিরামপুর উপজেলার ২নং মুকুন্দপুর ইউনিয়নের পটুয়াকোল গ্রামের মৃত ছলিম উদ্দিন মন্ডলের ছেলে। ১৯৮০ সালে জেলার ফুলবাড়ি উপজেলার বলিভদ্রপুর দাখিল মাদ্রাসায় কারি পদে ৩’শ টাকার বেতনের চাকরি নিয়েছিলেন। দীর্ঘ ৩৪ বছর চাকরি করে ২০১৪ সালে সেই চাকরি থেকে অবসর নেন। চাকরি থেকে অবসরকালে সরকারি তহবিল থেকে যা পেয়েছিলেন তা দিয়ে ব্যাংক ঋণের অংশবিশেষ পরিশোধ ও মেয়ের বিয়ের খরচ করতে গিয়ে “নুন আনতে পান্তা ফুরানো”র দশা শিক্ষক মুজিবুর রহমানের জীবনে।
বর্তমানে তার নিজের কোনো জমাজমি নেই। শেষ সম্বল বলতে পৈত্রিকসূত্রে পাওয়া ১২ শতক জমি। সেটিও মোহরানা হিসেবে প্রিয় স্ত্রীকে অর্ধেক আর বাকি অর্ধেক লিখে দিয়েছেন তার একমাত্র ছেলে আবুল কালাম আজাদ (৩৬) কে। স্ত্রী, এক ছেলে ও তিন মেয়ের সুখের জন্য জীবনের অঙ্ক মেলাতে গিয়ে নিজের হিসেবের খাতাটি কখন যে শুণ্য হয়েছে তা তিনি খেয়াল করেননি। নিজেই এখন হয়েছেন সম্বলহীন। স্ত্রীকে নিয়ে টিনের ছাউনি দেয়া এক ঝুঁপড়ি ঘরেই থাকেন। শুধু তাই নয়, তার সংসারে অভাব-অনটন তখন নিত্যসঙ্গী তখনও তার মাথার উপর এক লক্ষ টাকারও বেশি ব্যাংক ঋণ চেপে রয়েছে। এ বিশাল ঋণ কীভাবে শোধ দেবে এই চিন্তায় তিনি মাঝেমধ্যে ভেঙে পড়েন বয়সের ভারে নুয়ে পড়া মুজিবুর রহমান। একমাত্র ছেলে আবুল কালাম আজাদ (৩৬) রাজমিস্ত্রির কাজে অন্যের বাড়িতে শ্রম দেন। স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে তারও অভাবের সংসারে চলে নিত্য টানাপোড়ন।
গত কয়েকমাস আগেও তিনি পেটের জন্য দু’মুঠো ভাতের ব্যবস্থা করতে শুক্রবার করে এলাকার বিভিন্ন মসজিদে-মসজিদে গিয়ে সাহায্যের জন্য হাত পাততেন। একজন ভালো শিক্ষক হিসেবে বিভিন্ন এলাকায় তার জনপ্রিয়তা থাকায় অনেকেই তার জন্য সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতেন। কিন্তু কয়েক সপ্তাহ হলো তার দুই হাত-পায়ে প্রচন্ড ব্যথার কারণে তিনি আর বাহিরে চলাফেরা করতে পারছেন না। এছাড়া করোনা ভাইরাসের কারণে দেশে লকডাউন ঘোষণায় তিনি অনেকটাই অসহায় হয়ে পড়েছেন। একদিকে পেটের জন্য ভাতের যোগান অন্যদিকে শরীরে বাসাবাধা তীব্র ব্যথা ও রক্তে হাই প্রেসার এর চিকিৎসা খরচ মেটানো এখন আকাশ-কুসুম কল্পনা!
কথা হল অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক মুজিবুর রহমান মন্ডলের সাথে। সংসারে অভাবের কথা বলতে গিয়ে তিনি জানান, “যখন গায়ে শক্তি ছিল তখন বাড়ি থেকে প্রায় ৭ কিলোমিটার দূরে সাইকেল চালিয়ে মাদ্রাসায় চাকরি করেছি। অবসর নেয়ার পর থেকেই রোগে-শোকে আর আগের মত চলাফেরা করতে পারি না। নিজের কোনো জমাজমি নাই। এখন আমার কোনো আয়-রোজগার নাই, তার উপর আবার ব্যাংক ঋণের বোঝা। এসব মনে পড়লে খুব অসুস্থ হয়ে পড়ি। আল্লাহর দয়ায় কোনোমতে বেঁচে আছি।”
মুকুন্দপুর গ্রামের বাসিন্দা ইউসুফ আলী মাস্টার জানান, “মুজিবুর রহমান একজন অত্যন্ত ভাল মানুষ। চাকরি থেকে অবসর নেয়ার পর তিনি আর্থিক অনটনে অনেকটাই অসহায় পড়েছেন। উপজেলা প্রশাসনের নিকট অনুরোধ করছি, অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক মুজিবুর রহমানের মত একজন ভূমিহীন ও অসহায় মানষকে সরকার থেকে মুজিব শতবর্ষে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপহার হিসেবে একটি বাড়ি দেয়ার ব্যবস্থা করা হোক।”
এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) পরিমল কুমার সরকার জানান, আমাদের সমাজে একজন মানুষ গড়া কারিগরের জীবনের শেষ সময়ে এসে এরকম ঘটনা অত্যন্ত দুঃখজনক যা আমাদের কারো কাম্য নহে। এই মুহূর্তে সরকার থেকে শিক্ষক মুজিবুর রহমান মন্ডলের জন্য আর্থিক সহযোগিতা দেয়ার সুযোগ নেই। তবে সরকারিভাবে আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে বাড়ি করে দেয়ার বরাদ্দ আসলে তার জন্য বিষয়টি বিবেচনায় রাখা হবে। আর অন্য কোনোভাবে সরকারি সুযোগসুবিধা দেয়ার সুযোগ থাকলে তা অবশ্যই তাকে দেয়ার চেষ্টা করা হবে।