নামায ও নামাযের বাইরের জীবনে স্বাভাবিক কারণেই একটা সম্পর্ক গড়ে ওঠে। নামাজ যে মানের হয় সে মানেই বাইরের জীবনে এর প্রভাব পড়ে। যে নামাযকে শুধু একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান মনে করে তার জীবনে নামাযের কোন ইতিবাচক প্রভাব পড়ার কথা নয়। কিন্তু যে নামাযকে কালেমায়ে তাইয়েবার ওয়াদা অনুযায়ী চলার, মহান রবের হিদায়াতের পথে শত কষ্ট সত্ত্বেও টিকে থাকার ট্রেনিং হিসেবে গ্রহণ করে তার জীবনে নামাযের প্রভাব অবশ্যই পড়বে। নামায যে পরিমাণ জীবন্ত হবে, সে পরিমাণ ইতিবাচক প্রভাবই নামাযীর বাস্তব জীবনে পড়বে।
সচেতন নামাযী সহজেই উপলব্ধি করতে পারবে যে, নামাযের প্রভাব তার জীবনে কতটুকু পড়ছে। নামাযের বাইরের জীবনের প্রভাবও নামাযের উপর পড়ে। বাস্তব জীবনে নামাযী যে পরিমাণ তাকওয়া অবলম্বন করতে সক্ষম হয়, সে পরিমাণেই নামাযের সময় তা প্রতিফলিত হয়। নামাযের বাইরে ঈমানের দাবি পূরণ করতে পারলে নামাযের সময় ঈমানের বিরোধী কোন ভাব মনে জাগবে না।
আমরা এটা রোজ যাচাই করে দেখতে পারি। বাইরের জীবনে বিবেকের বিরদ্ধে কিছু করলে ওটা নামাযের সময়ও মনকে কলুষিত করবে। এ হিসেবে আমরা বলতে পারি যে, আমার নামাযে বাইরের জীবনের রিপোর্ট আসে এবং বাইরের জীবনেও নামাযের রিপোর্ট পাওয়া যায়। নামায ও বাস্তব জীবন পরম্পর বিচ্ছিন্ন নয়, অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত।
নামাযের বাইরে মনকে কী কাজ দেওয়া যায়?
নামাযের মাধ্যমে মনের যে ব্যাপক ট্রেনিং হয় এর সুফল যাতে বহাল থাকে সে উদ্দেশ্যে নামাযের বাইরে মনকে এমন কাজ দিতে হবে, যাতে মন শয়তানের খপ্পরে না পড়ে।
অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দিয়ে আমরা যখন কাজ করি তখন এ কাজটি ভালোভাবে সমাধা করার জন্য মনোযোগ দিয়েই কাজটি করতে হয়। অবশ্য এটা কাজের ধরনের উপর অনেকটা নির্ভর করে। কৃষক ও শ্রমিকদেরকে শুধু হাত ও পা ব্যবহার করে গতানুগতিক ধরনের এমন কাজও করতে হয়, যে কাজে মনের তেমন কোন দায়িত্ব থাকে না। রিক্সা চালকের দেহ রিক্সা টেনে নিয়ে যাবার সময় এ কাজে মনের তেমন কোন দায়িত্ব নেই বলে তখন হাজারো ভাব মনে জাগতে পারে।
কিন্তু হাত যখন কলম দিয়ে লিখে তখন মন এ কাজ থেকে বিচ্ছিন্ন নয়, মুখ যখন বক্তৃত করে অথবা কান যখন বক্তৃতা শুনে তখন মন এ কাজেই শরীক থাকে। তাই আমাদেরকে হিসাব করতে হবে যে, দেহ যে কাজ করছে সে কাজে মনের দায়িত্ব কতটুকু আছে। যে কাজের সময় মন বেকার থাকে তখন তাকে কাজ দেওয়া প্রয়োজন। তা না হলে আমাদের অজান্তেই ইবলীস তাকে বাজে কাজে বেগার খাটাবে।
এটাই মানবজীবনের বিরাট এক সমস্যা। মন অত্যন্ত শক্তিশালী যন্ত্র। এর যোগ্যতা ও কর্মক্ষমতা অসীম। কাজ ছাড়া এক মুহূর্তও সে থাকতে পারে না। তাকে সব সময়ই কাজ দেওয়ার যোগ্যতা অনেকেরই নেই। ফলে আমাদের এ মূল্যবান কর্মচারী ইবলীসের বেগার খাটে। আপনার দেহ কোথাও বসে বা দাঁড়িয়ে পাহারা দিচ্ছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে বা পায়চারি করে কাটাতে হচ্ছে। একা একা পার্কে বা রাস্তায় ভ্রমণ করছেন। যানবাহনের অপেক্ষায় স্টেশনে বসে বা কিউতে দাঁড়িয়ে আছেন। যানবাহনে চুপচাপ বসে আছেন। বসার জায়গা না পেয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। দৈহিক পরিশ্রম করার পর ক্লান্তি দূর করার উদ্দেশ্যে বসে বা শুয়ে আছেন। ঘুমের কামনায় বিছানায় চোখ বুজে পড়ে আছেন। এমন সময় রোজই আমাদের জীবনে কেটে যায় যখন সচেতনভাবে আমরা মনকে কোন বিশেষ চিন্তায়, ভাবনায় বা পরিকল্পনা রচনায় ব্যবহার করি না। মনকে আমরা এভাবে যখনই বেকার রেখে দেই তখন সে ইবলীসের বেগার কর্মচারীতে পরিণত হয়।
এর প্রতিকার হিসেবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি ইতিবাচক ও একটি নেতিবাচক উপদেশ দিয়েছেন। নেতিবাচক উপদেশটির সারমর্ম হলো, তোমরা আল্লাহকে লজ্জা কর। মনে এমন ভাব আসতে দিও না, যা আল্লাহ অপছন্দ করেন। আল্লাহ মনের গোপন ভাবও জানেন। তাই এ কথা খেয়াল রাখবে যে, এমন কথা আমি মনে কী করে স্থান দিতে পারি, যা আমার মনিব অপছন্দ করেন? এভাবে লজ্জাবোধ করলে মনকে বাগে রাখা যায়।
আর ইতিবাচক উপদেশ হলো, জিহ্বাকে সব সময় আল্লাহর জিকিরে চলমান রাখা, মনে খারাপ ভাব আসতে না দিলে মুখের জিকির মনকে জিকিরে মশগুল রাখবে। অর্থাৎ মন ও মুখ কোনটাই খালি রাখা নিরাপদ নয়। মুখের জিকির মনকে জিকির করতে সাহায্য করে। মনকে দেওয়ার মত কোন কাজ না থাকলে তাকে জিকিরে ব্যস্ত করে দিতে হবে এবং এ উদ্দেশ্য সফল করার জন্য মুখেও যিকর জারি করা দরকার।
জিকিরের ব্যাপারে একটি কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, হাদীসে শুধু ‘আল্লাহ, আল্লাহ’ জিকির কোথাও শিক্ষা দেওয়া হয়নি। আল্লাহ শব্দের সাথে আল্লাহর কোন একটি গুণ থাকা দরকার। যেমন সুবহানাল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহু আকবার, লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ ইত্যাদি। সহীহ বুখারীর শেষে একটি চমৎকার তাসবীহ শেখানো হয়েছে।
রাস্থল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
দুটো বাক্য এমন আছে যা মুখে উচ্চারণ করা খুব সহজ, কিনতু দাঁড়ি – পাল্লায় বেশ ভারী এবং আল্লাহর নিকট বড় প্রিয়। তা হলো, সুবহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহী, সুবাহানাল্লাহিল আযীম।
কিছু বাস্তব পরামর্শ
খালি মনকে কাজে ব্যস্ত রাখার জন্য কতক পরামর্শ আপনাদের সামনে তুলে ধরছি।
১.সব সময় সব অবস্থায় ইসলামী বই সাথে রাখুন, যখনই মন অবসর হয়ে যায়, বই পড়বেন। এটা যিকির থেকেও বেশি কার্যকর পন্থা। যিকিরে মনোযোগের অভাব হতে পারে। বই পড়ার সময় তা হয় না। তাছাড়া সকল রকম নফল ইবাদতের মধ্যে দীনের ইলম তালাশ করা শ্রেষ্ঠতম।
২. অনেক সময় বই পড়ার পরিবেশ বা সুযোগ থাকে না। তখন কয়েকটি কাজ করতে পারেনঃ
ক. কুরআন পাকের মুখস্থ করা সৃরাগুলো আওড়াতে থাকুন। পরিবেশ অনুকূল থাকলে গুনগুন করেই পড়তে পারেন।
খ. কালেমা তাইয়েবা, তিন তাসবীহ, দরূদ বা যে কোন জিকির মুখে ও মনে জপতে থাকুন।
গ. আপনার করণীয় কাজগুলো সুষ্ঠুভাবে করার পরিকল্পনা করুন। কারো সাথে আলোচনার কথা থাকলে বিষয়টি মনে মনে গুছিয়ে নিন।
ঘ. নিঃশ্বাস টানার সময় সচেতনভাবে ‘লা ইলাহা এবং নিঃশ্বাস ছাড়ার সময় ইল্লাল্লাহ নিঃশব্দে মনে মনে পড়তে থাকুন।
ঙ. একটানা অনেকক্ষণ একই ধরনের কাজ করতে মন চায় না। তাই এসব কাজ অদল-বদল করে করতে থাকুন।