‘হৃৎপিণ্ড পাম্পের মতো কাজ করে’ এ উপমাটি প্রথম দেওয়া হয় ১৮ শতকে, যখন বাষ্পীয় ইঞ্জিন আবিষ্কৃত হয়। ইঞ্জিনের পিস্টনগুলোর পাম্পিংয়ের মতো নড়াচড়া শারীরতত্ত্ববিদদের এতটাই ভালো লেগে যায় যে, তারা হৃৎপিণ্ডকে পাম্প বলতে শুরু করেন। হৃৎপিণ্ডের পাম্পিং দক্ষতার দিকে তাকালে বিস্মিত হতে হয়। হৃৎপিণ্ড দিনে প্রায় 1 লাখ বার স্পন্দিত হয়। বছরে 4 কোটি বার এবং প্রায় ৬০ থেকে ৭০ বছর একটুও না থেমে স্পন্দিত হতে থাকে। এটি প্রতি মিনিটে দুই গ্যালন এবং প্রতি ঘণ্টায় ১০০ গ্যালনেরও বেশি রক্ত পাম্প করে। যে সংবহনতন্ত্র এই প্রাণের জন্য অপরিহার্য রক্ত পরিবহন করছে, তা ৬০ হাজার মাইলের চেয়েও অধিক দীর্ঘ, যা পৃথিবীর পরিধির দ্বিগুণেরও বেশি। স্পন্দনের শুরুর মুহূর্ত থেকে জীবনাবসানের মাধ্যমে স্পন্দনের সমাপ্তি ঘটার আগ পর্যন্ত এটি ক্লান্তিহীন কাজ করে যায়। গড়ে একজন মানুষের জীবদ্দশায় হৃৎস্পন্দন হয় 2৫০ কোটিরও বেশি বার; একমুহূর্তের জন্য বিশ্রাম না নিয়েই।
চিত্র : হৃৎপিণ্ডের রক্ত পাম্পিং।
তবে হৃৎপিণ্ডের রক্ত সঞ্চালনের বিষয়টি এর সবচেয়ে চমকপ্রদ বিষয় নয়। সম্প্রতি নতুন একটি মেডিক্যাল ফিল্ডের জন্ম হয়েছে, যার নাম নিউরোকার্ডিওলজি–যেখানে হৃৎপিণ্ডে স্নায়ুতন্ত্র (ব্রেইন) কীভাবে কাজ করে, তা নিয়ে গবেষণা করা হয়। জে. অ্যান্ড্রু আর্মার (J. Andrew Armour) পিএইচডি হৃৎপিণ্ডের অন্তর্নিহিত স্নায়ুতন্ত্রের এনাটমি ও ফাংশনের বিষয়ে তার যুগোপযোগী গবেষণার জন্য নিউরোকার্ডিওলজির ফিল্ডে একজন অগ্রদূত। তিনি হৃৎপিণ্ডের স্নায়ুতন্ত্রকে ‘হৃৎপিণ্ডের ক্ষুদ্র মস্তিষ্ক’ (little brain on the heart) আখ্যা দেন। এর কারণ, হৃৎপিণ্ডে ঠিক মস্তিষ্কের মতোই (একই ধরনের) ৪০ হাজারের অধিক নিউরন রয়েছে। সংখ্যাটা বেশ বড়; কারণ, মানবমস্তিষ্কের অনেক ক্ষুদ্র অংশই এই পরিমাণ নিউরন দ্বারা গঠিত। এ ছাড়া হৃৎপিণ্ডের স্নায়ুতন্ত্র সেসব নিউরন দ্বারা গঠিত, যেগুলো মস্তিষ্কের নিউরনের সাহায্য ছাড়াই তথ্যকে বিশ্লেষণ করতে সক্ষম। হৃৎপিণ্ডের এসব নিউরন (হৃৎপিণ্ডের ক্ষুদ্র মস্তিষ্ক) দেহের অন্য অংশ থেকে তথ্য গ্রহণ করে, সেগুলোতে উপযুক্ত সমন্বয় সাধন করে এবং তথ্যগুলোকে আবার বাকি দেহে পাঠায়, যার মধ্যে মস্তিষ্কও রয়েছে। এ ছাড়া এই নিউরনগুলোর স্বল্প মেয়াদি একধরনের স্মৃতিশক্তি রয়েছে, যা তাদের কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের বাইরে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুবিধা দেয়।
যদিও হৃৎপিণ্ডের কালনির্ধারণকে মস্তিষ্কের দ্বারা প্রভাবিত করা যায় (অটোনোমিক স্নায়ুতন্ত্রের মাধ্যমে), তবে হৃৎস্পন্দনের উৎস হৃৎপিণ্ডের অভ্যন্তরেই অবস্থিত। দেখা গেছে, হৃৎপিণ্ড ও মস্তিষ্কের মধ্যে স্নায়ুবিক কোনো সংযোগ নেই। এ জন্য হৃৎপিণ্ড প্রতিস্থাপনের সময় হৃৎপিণ্ড ও মস্তিষ্কের মধ্যকার সকল স্নায়ুবিক সংযোগ কেটে দেওয়া হলেও হৃৎপিণ্ডের কার্যক্রম চলমান থাকে।
নিউরোকার্ডিওলজির ফিল্ডে ড. আর্মার ও তার সহকর্মীদের করা এই গবেষণা উপস্থাপনের পর ড. আর্মার হৃৎপিণ্ডের ব্যাপারে তার গ্রন্থ Neurocardiology : Anatomical and Functional Principles-এ এই মন্তব্য করেন,
The heart possesses its own little brain, capable of complex computational analysis on its own. Data clearly indicate that the intrinsic cardiac nervous system acts as much more than a simple relay station for the extrinsic autonomic projections to the heart…. An understanding of the complex anatomy and function of the heart’s nervous system contributes an additional dimension to the newly emerging view of the heart as a sophisticated information processing center, functioning not only in concert with the brain but also independent of it.
হৃৎপিণ্ডের নিজস্ব ক্ষুদ্র মস্তিষ্ক রয়েছে, যে নিজেই তথ্যের ওপর জটিল গাণিতিক বিশ্লেষণ করতে সক্ষম। উপাত্ত থেকে স্পষ্টভাবে দেখা যায়, অন্তর্নিহিত কার্ডিয়াক স্নায়ুতন্ত্র হৃৎপিণ্ডের বহির্মুখী অটোনোমিক প্রোজেকশনের জন্য একটি সাধারণ রিলে স্টেশনের চেয়ে অধিক কাজ করে… হৃৎপিণ্ডের স্নায়ুতন্ত্রের জটিল গঠনের ব্যাপারে ধারণা ও এর কার্যক্রম সম্পর্কে জানার মাধ্যমে হৃৎপিণ্ডের জটিল তথ্য প্রক্রিয়াকরণকে বোঝা সম্ভব হবে, হৃৎপিণ্ডের ব্যাপারে গবেষণার নতুন একটি দুয়ার খুলে যাবে। হৃৎপিণ্ড যে শুধু মস্তিষ্কের সঙ্গে সমবেতভাবে কাজ করে তা-ই নয়; এটি স্বতন্ত্রভাবেও কাজ করতে সক্ষম।
70-এর দশকে শারীরতত্ত্ববিদরা (physiologist) বিশ্বাস করতেন, মস্তিষ্ক একমুখীভাবে হৃৎপিণ্ডের দিকে তথ্য পাঠায় এবং হৃৎপিণ্ড সে নির্দেশনার আনুগত্য করে। সত্তরের দশকেই ওহিওর ফেলস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (Fels Research Institute) দুইজন শারীরতত্ত্ববিদ (physiologist) জন ও বিয়েট্রিস লেসি (John and Beatrice Lacey) আবিষ্কার করেন, হৃৎপিণ্ড ও মস্তিষ্কের মধ্যে দ্বিমুখী যোগাযোগ বিদ্যমান। তাঁরা আবিষ্কার করেন, যখন মস্তিষ্ক স্নায়ুতন্ত্রের মাধ্যমে হৃৎপিণ্ডকে নির্দেশনা পাঠায়, হৃৎপিণ্ড অন্ধভাবে সেটার আনুগত্য করে না। দেখা গেছে, হৃৎপিণ্ড নিজের যুক্তি বা বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে। কখনো কখনো মস্তিষ্ক হৃৎপিণ্ডকে একটি উদ্দীপনা বৃদ্ধির সংকেত পাঠাতে পারে এবং এর ফলে হৃদস্পন্দনের গতি বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি শরীরের অন্য অঙ্গও উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠে। কিন্তু অন্য সময়ে, মস্তিষ্ক থেকে উদ্দীপনার সংকেত এলেও হৃৎপিণ্ড কোনো অজানা কারণে ধীরগতির হয়ে যায়; যদিও দেহের অন্য অঙ্গ ঠিকই উদ্দীপ্ত হয়। তারা আরও দেখেন, হৃৎপিণ্ড নিজেই মস্তিষ্ককে পালটা সংকেত পাঠাচ্ছে, যা মস্তিষ্ক কেবল বুঝেছে তা-ই নয়; বরং অনুসরণও করেছে। ৬০ ও ৭০-এর দশকে লেসির করা গবেষণার সারাংশ তুলে ধরতে গিয়ে হার্টম্যাথ ইনস্টিটিউটের রলিন ম্যাকক্রেটি পিএইচডি (Rollin McCraty PhD) তাঁর গ্রন্থ Heart-Brain Neurodynamics: The Making of Emotions-এ লেখেন,
As their research evolved, they found that the heart, in particular, seemed to have its own peculiar logic that frequently diverged from the direction of other ANS responses. In essence, the heart seemed to behave as if it had a mind of its own.
তাদের গবেষণা এগিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তারা দেখেন, হৃৎপিণ্ড নিজস্ব কোনো অদ্ভুত কারণে অটোনোমিক স্নায়ুতন্ত্রের মাধ্যমে আসা সংকেতের অভিমুখ থেকে নিয়মিতভাবে নিজেকে সরিয়ে নেয়। অর্থাৎ, দেখে মনে হয়েছে হৃৎপিণ্ড এমন আচরণ করছে, যেন এর নিজস্ব বুদ্ধিমত্তা রয়েছে।
- এ লেখাটি ড. গওহার মুশতাকের দ্য ইন্টেলিজেন্ট হার্ট গ্রন্থ থেকে অনূদিত।
তথ্যসূত্রঃ
- Lacey, Beatrice C. & Lacey, John I. (1978). Two-Way Communication Between the Heart and the Brain: Significance of Time Within the Cardiac Cycle. American Psychologist, 99-113.
- Lacey, Beatrice C. & Lacey, John I. Some autonomic-central nervous system interrelationships. In: Black, Perry. Ed. (1970). Physiological Correlates of Emotion. New York, Academy Press: pp. 205-227.
- McCraty, Rollin, Ph.D. (2003). Heart-Brain Neurodynamics: The Making of Emotions. Boulder Creek, California, Institute of HeartMath.
- Pearce, Joseph Chilton (2002). The Biology of Transcendence. Rochester, Vermont, Park Street Press.
- Schiefelbein, S. The Powerful River. In: Poole, R. ed. (1986). The Incredible Machine. Washington, D.C., The National Geographic Society.
- Armour, J. Andrew, M.D., Ph.D. & Ardell, Jeffry L., Ph.D. ed. (1994). Neurocardiology. New York, Oxford University Press.
- Armour, J. Andrew, M.D., Ph.D. (2003). Neurocardiology: Anatomical and Functional Principles. Boulder Creek, California, Institute of HeartMath.
- Childre, Doc & Martin, Howard (1999). The HeartMath Solution. New York, Harper SanFrancisco.
- Armour, J. Andrew, M.D., Ph.D. (2003). Neurocardiology: Anatomical and Functional Principles. Boulder Creek, California, Institute of HeartMath.