একটা সিরিয়াস প্রশ্ন!
ইসলামের কি কোনো বিকৃতি হয়েছে? বিগত ১৪ শতাব্দীতে এর সাথে কিছু ঘটেছে?
আবদুল্লাহ ইবনু আমর রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
لَيَأْتِيَنَّ عَلَى أُمَّتِي مَا أَتَى عَلَى بَنِي إِسْرَائِيلَ حَذْوَ النَّعْلِ بِالنَّعْلِ حَتَّى إِنْ كَانَ مِنْهُمْ مَنْ أَتَى أُمَّهُ عَلاَنِيَةً لَكَانَ فِي أُمَّتِي مَنْ يَصْنَعُ ذَلِكَ وَإِنَّ بَنِي إِسْرَائِيلَ تَفَرَّقَتْ عَلَى ثِنْتَيْنِ وَسَبْعِينَ مِلَّةً وَتَفْتَرِقُ أُمَّتِي عَلَى ثَلاَثٍ وَسَبْعِينَ مِلَّةً كُلُّهُمْ فِي النَّارِ إِلاَّ مِلَّةً وَاحِدَةً قَالُوا وَمَنْ هِيَ يَا رَسُولَ اللَّهِ قَالَ مَا أَنَا عَلَيْهِ وَأَصْحَابِي
বনি ইসরাইল যে অবস্থায় পতিত হয়েছিল, নিঃসন্দেহে আমার উম্মাতও সেই অবস্থার সম্মুখীন হবে, যেমন একজোড়া জুতার একটি আরেকটির মতো হয়ে থাকে। এমনকি তাদের মধ্যে কেউ যদি প্রকাশ্যে তার মায়ের সাথে ব্যভিচার করে থাকে, তবে আমার উম্মাতের মধ্যেও কেউ তাই করবে। আর বনি ইসরাইল ৭২ দলে বিভক্ত হয়েছিল। আমার উম্মাত ৭৩ দলে বিভক্ত হবে। শুধু একটি দল ছাড়া তাদের সবাই জাহান্নামী হবে।
সাহাবিগণ বললেন, হে আল্লাহর রাসুল! সে দল কোনটি?
তিনি বললেন, আমি ও আমার সাহাবিগণ যার উপর প্রতিষ্ঠিত।[১]
ইসলাম বিকৃত হয়েছে কী না এটা জানার আগে জানতে হবে ধর্মকে বিকৃত করা দ্বারা কি বোঝায়। মূলত ধর্মের বিকৃতি মানে ধর্মের ভিত্তি ও এর মূল কিতাবকে সামান্য হলেও পরিবর্তন করে ফেলা। মূল কিতাবের বিকৃতি ঘটানো হলে সেই কিতাবে বর্ণিত মূলনীতি বা বিশ্বাসেরও বিকৃতি ঘটে। ইয়াহুদিবাদ ও খ্রিষ্টবাদসহ[২] ইতিহাসজুড়ে প্রতিটি ধর্মের সাথে এটা ঘটেছে।
আল্লাহ ইয়াহুদিদের ব্যাপারে বলেন,
اَفَتَطۡمَعُوۡنَ اَنۡ یُّؤۡمِنُوۡا لَکُمۡ وَ قَدۡ کَانَ فَرِیۡقٌ مِّنۡهُمۡ یَسۡمَعُوۡنَ کَلٰمَ اللّٰهِ ثُمَّ یُحَرِّفُوۡنَهٗ مِنۡۢ بَعۡدِ مَا عَقَلُوۡهُ وَ هُمۡ یَعۡلَمُوۡنَ ﴿۷۵﴾
তোমরা কি এই আশা কর যে, তারা তোমাদের কথায় ইমান আনবে? অথচ তাদের একদল আল্লাহর বাণী শ্রবণ করত ও বুঝার পর জেনে শুনে তা বিকৃত করত। [সুরা বাকারা : ৭৫]
مِنَ الَّذِیۡنَ هَادُوۡا یُحَرِّفُوۡنَ الۡکَلِمَ عَنۡ مَّوَاضِعِهٖ وَ یَقُوۡلُوۡنَ سَمِعۡنَا وَ عَصَیۡنَا وَ اسۡمَعۡ غَیۡرَ مُسۡمَعٍ وَّ رَاعِنَا لَـیًّۢا بِاَلۡسِنَتِهِمۡ وَ طَعۡنًا فِی الدِّیۡنِ ؕ وَ لَوۡ اَنَّهُمۡ قَالُوۡا سَمِعۡنَا وَ اَطَعۡنَا وَ اسۡمَعۡ وَ انۡظُرۡنَا لَکَانَ خَیۡرًا لَّهُمۡ وَ اَقۡوَمَ ۙ وَ لٰکِنۡ لَّعَنَهُمُ اللّٰهُ بِکُفۡرِهِمۡ فَلَا یُؤۡمِنُوۡنَ اِلَّا قَلِیۡلًا ﴿۴۶﴾
ইয়াহুদিদের কতক লোক কথাকে প্রকৃত স্থান থেকে সরিয়ে বিকৃত করে এবং বলে, ‘আমরা শুনলাম ও অমান্য করলাম’ এবং শুনেও না শোনার মত আর নিজেদের জিহবা কুঞ্চিত করে এবং দীনের প্রতি দোষারোপ করে বলে, ‘রাইনা’ (আমাদের রাখাল)। কিন্তু তারা যদি বলত ‘আমরা শুনলাম ও মেনে নিলাম, শোন এবং আমাদের প্রতি লক্ষ্য কর, তবে তা তাদের জন্য উত্তম এবং সঙ্গত হত, কিন্তু তাদের কুফরির কারণে আল্লাহ তাদেরকে লানত করেছেন, তারা স্বল্পসংখ্যক ব্যতীত ইমান আনবে না। [সুরা নিসা : ৪৬]
কোনো আসমানি কিতাবের বিকৃতি ঘটলে আল্লাহ নতুন আসমানি গ্রন্থ নাজিল করতেন। যেন মানবজাতির জন্য তাওহিদের প্রকৃত বাণী পৃথিবীতে অবিচল থাকে। মানবজাতির প্রতি প্রেরিত সর্বশেষ ও পূর্ণাঙ্গ আসমানি গ্রন্থ হল কুরআন। প্রকৃতপক্ষে ইসলামের সামান্যতম বিকৃতিও ঘটেনি কারণ ইসলামের ভিত্তি ও আসমানি গ্রন্থ কুরআন ১৪০০ বছর পরও একই রয়ে গেছে। তবে অন্য সকল ধর্মের ধর্মগ্রন্থের বিকৃতি ঘটেছে।
কুরআনের সত্যতা প্রমাণের অসংখ্য উপায় রয়েছে। যেমন, কুরআনের নিখুঁত বিন্যাস, আয়াতের গাণিতিক বিন্যাস, কুরআনের বিজ্ঞানময় প্রকৃতি, বিভিন্ন ভবিষ্যদ্বাণী সত্য হওয়া, যে কোনো সমস্যার সমাধান হিসেবে যুক্তিসঙ্গত সমাধান উপস্থাপন সবগুলোই প্রমাণ করে যে এই কিতাবটি আল্লাহর রহমতে আজও সংরক্ষিত রয়েছে।[৩] এই গ্রন্থটিকে পালটে ফেলাও অসম্ভব, কারণ বিশ্বের লক্ষ লক্ষ হাফিজের সিনায় কুরআন রয়েছে।
ভেবে দেখুন, পৃথিবীর সবগুলো বই যদি কোনোভাবে ধ্বংস করে দেওয়া হয় এরপরে যদি সেগুলোকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হয় তাহলে একমাত্র যে গ্রন্থটিকে শতভাগ বিশুদ্ধরূপে ফিরিয়ে আনা যাবে তা হল কুরআন। কারণ লক্ষ লক্ষ হাফিজ কুরআনের প্রতিটা শব্দ, প্রতিটা হরফ হিফজ করেছে। তাই কুরআনের একটা হরফও বদলানো সম্ভব না।
আল্লাহ ওয়াদা করেছেন, তিনি ইসলামের ভিত্তি কুরআনকে সকল প্রকার বিকৃতির হাত থেকে রক্ষা করবেন।
اِنَّا نَحۡنُ نَزَّلۡنَا الذِّکۡرَ وَ اِنَّا لَهٗ لَحٰفِظُوۡنَ ﴿۹﴾
নিশ্চয় আমিই কুরআন নাজিল করেছি আর অবশ্যই আমি তার সংরক্ষক। [সুরা হিজর : ৯]
তবে এর অর্থ এই নয় যে, মানুষের ইমানও সংরক্ষিত থাকবে। কারণ দুনিয়া পরীক্ষার জায়গা। এ জন্যই উপরোক্ত হাদিসে বলা হয়নি যে ইসলামের পরিবর্তন ঘটবে, বরং ইসলামের অনুসারীরাই ৭৩-টি ফিরকা বা দলে বিভক্ত হবে। তাদের প্রত্যেকেই ইসলামের নামে ভিন্ন ভিন্ন বিশ্বাস ও ফিকহ লালন করবে। কিন্তু যারা প্রকৃত ইসলাম অর্থাৎ কুরআন ও সুন্নাহর অনুসরণ করবে তারাই বিচার দিবসে নিরাপদ থাকবে।
হাদিসও কি সংরক্ষিত আছে?
হাদিস শব্দটি আরবি, অর্থ কথা বা বাণী। বিশেষ অর্থে মহানবি সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর কথা, কাজ ও তাঁর সমর্থনকেই হাদিস বলা হয়। সাহাবি ও তাবিয়িদের কথা, কাজ ও সমর্থনকেও হাদিস বলা হয়। প্রতিটি মুসলিমের মননে ও হৃদয়ে এই বিশ্বাস প্রতিষ্ঠিত থাকতে হবে যে, রাসুলের প্রতি নাজিলকৃত ওহির দুটি অংশের একটি কুরআন, অপরটি সুন্নাহ। আল্লাহ কুরআনে বলেন,
وَ مَا یَنۡطِقُ عَنِ الۡهَوٰی ؕ﴿۳﴾ اِنۡ هُوَ اِلَّا وَحۡیٌ یُّوۡحٰی ۙ﴿۴﴾ع َلَّمَهٗ شَدِیۡدُ الۡقُوٰی ۙ﴿۵﴾
আর সে মনগড়া কথা বলে না। এটাতো ওহি, যা তার প্রতি প্রত্যাদেশ হয়। তাকে শিক্ষা দিয়েছে প্রবল শক্তিধর। [সুরা নাজম : ৩-৫]
স্বয়ং আল্লাহ বলছেন রাসুলুল্লাহর কথাবার্তা হচ্ছে ওহি। নিশ্চিতভাবেই ওহি হচ্ছে জিকর। আর জিকিরও সংরক্ষিত থাকে। কুরআনও জিকির এবং কুরআন সংরক্ষিত আছে।
اِنَّا نَحۡنُ نَزَّلۡنَا الذِّکۡرَ وَ اِنَّا لَهٗ لَحٰفِظُوۡنَ ﴿۹﴾
নিশ্চয় আমিই কুরআন নাজিল করেছি আর অবশ্যই আমি তার সংরক্ষক। [সুরা হিজর : ৯]
যেহেতু বোঝা গেল সুন্নাহও ওহি, এবার কুরআন ও সুন্নাহর একমাত্র পার্থক্যটা জানতে হবে। কুরআন হচ্ছে সরাসরি মহান আল্লাহর বাণী যা দীর্ঘ ২৩ বছর যাবৎ হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম -এর নিকট নাজিল হয়। তবে সুন্নাহ সরাসরি আল্লাহর বাণী না হলেও এটি তাঁর ওহি। কুরআনে আল্লাহর ওহি মৌখিকভাবে এসেছে, আর সুন্নাহয় এসেছে ওহির অর্থ। এটা বুঝতে পারলে ধরতে পারব কেন সুন্নাহর মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে হুবহু একই শব্দ প্রচার না করে বরং রাসুলুল্লাহর কথা ও কাজের অর্থগুলো মানুষের কাছে প্রচার করা। আল্লাহ কুরআনের সম্পূর্ণ হিফাজত করেন এবং সুন্নাহর ক্ষেত্রে সাধারণ অর্থগুলোর হিফাজত করেন।
ইসলামি জীবনব্যবস্থার রূপায়ন ঘটেছে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামের জীবনব্যাপী কথা ও কাজের মাধ্যমে। এই কারণে তাঁর যাবতীয় কথা ও কাজ মুসলিম সমাজের নিকট মহামূল্য সম্পদ। সাহাবায়ে কিরাম রাসুলুল্লাহর প্রত্যেকটি কথা মনোযোগ সহকারে শুনতেন। তাঁর প্রত্যেকটি কাজ ও গতিবিধি সূক্ষ্ণদৃষ্টিতে লক্ষ্য করতেন। ফলে রাসুলুল্লাহর কথা ও কাজ সাহাবাদের মধ্যে স্বতঃস্ফূর্তভাবেই সঞ্চিত ও সঞ্জীবিত হয়।
তাঁর সুন্নাহ যেন পরবর্তী প্রজন্মে সঠিকভাবে বাহিত হতে পারে, এ জন্য তিনি সাহাবিদের তাঁকে অনুকরণের উপরই নির্ভর করেননি, বরং তিনি তাদেরকে তাঁর সুন্নাহগুলো প্রচারের নির্দেশ দেন।
নবি করিম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম সাহাবায়ে কিরামকে ইসলাম সম্পর্কিত যাবতীয় কথা, আদেশ-নিষেধ ও উপদেশাবলী মনোনিবেশ সহকারে শুনতে যেমন বলেছেন; এগুলো স্মরণ রাখতে ও অন্য লোকদের পর্যন্ত তা যথাযথভাবে পৌঁছে দিতেও তেমনি আদেশ করেছেন।[৪]
আবদুল্লাহ ইবনু মাসউদ রা. থেকে বর্ণিত যে, তিনি বলেন,
نَضَّرَ اللَّهُ امْرَأً سَمِعَ مِنَّا شَيْئًا فَبَلَّغَهُ كَمَا سَمِعَ فَرُبَّ مُبَلَّغٍ أَوْعَى مِنْ سَامِعٍ
আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছি যে, আল্লাহ তাআলা সেই ব্যক্তিকে আনন্দোজ্জ্বল করুন যে ব্যক্তি আমার নিকট থেকে কিছু হাদিস শুনেছে। কেননা পরে যার নিকট তা পৌঁছেছে সে প্রয়াশই প্রথম শ্রোতার তুলনায় সেটাকে অধিক হিফাজত করে রাখতে সক্ষম হয়েছে।[৫]
আবদুল কায়স গোত্রের এক প্রতিনিধি দল রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ্য আলায়হি ওয়াসাল্লামের নিকট উপস্থিত হলে তিনি তাদেরকে ইসলামের মূল বিষয়াদি সম্পর্কে বিস্তারিত শিক্ষাদান করেন তাদেরকে বলেন,
احْفَظُوهُ وَأَخْبِرُوهُ مَنْ وَرَاءَكُمْ
তোমরা এগুলো মনোযোগ সহকারে স্মরণ রাখ এবং তোমাদের পশ্চাতে যারা রয়েছে তাদের নিকট পৌঁছে দাও।[৬]
কোনো হাদিস জাল কী না তা জানার জন্য ইলমুল হাদিস জানতে হয়। একটি হাদিস সহিহ কী না তা বোঝার উপায় কি? এটা অনেকটা ডাক্তারকে প্রশ্ন করার মতো যে তিনি কীভাবে রোগীর ওপর চিকিৎসা করবেন এবং কি কি পদক্ষেপ তিনি অনুসরণ করবেন। আপনার-আমার মতো সাধারণ মানুষ এটা বুঝতে পারবে না। আপনি যদি পেশাদার মেকানিক হয়ে থাকেন, তাহলে মেকানিকের কাজ বোঝা যেমন নিউরোসার্জনের পক্ষে সম্ভব না, তেমনি আপনার পক্ষেও নিউরোসার্জনের কাজ বোঝা সম্ভব না। প্রত্যেকেরই নিজ নিজ খাতে দক্ষতা আছে, যা তার রুটি-রুজির ব্যবস্থা করে।
ইলমুল হাদিস বুঝতে গেলে একদম শুরু থেকে শুরু করতে হবে। শুরু করতে হবে মুসতালাহ আল হাদিস দিয়ে, এরপর ইলমুর রিজাল, আল-জারহ ওয়া তাদিল ইত্যাদি। এ সবগুলো বুঝতে হলে প্রচুর অধ্যয়ন করতে হয়। অনেক সময় দিতে হয়, অসংখ্য দারসে বসতে হয়। আপনি কীভাবে এই জ্ঞানসমুদ্রে বিচরণ করবেন তা শিখিয়ে দেবেন উসতাদগণ।
[১] সুনানু তিরমিজি : ২৬৪১
[২] Corruption of Judaism, the human trend | Submission.org – Your best source for Submission (Islam). (n.d.). Copyright 2013 Submission.org. https://submission.org/Corruption_in_Judaism.html
[৩] Quran: Evidence of Truth. (2011, October 23). Faith Forum. https://faithforum.wordpress.com/theology/guidance/sacred-scriptures/quran-evidence-of-truth/
[৪] হাদীস সংকলনের ইতিহাস, মাওলানা আবদুর রহিম। পৃষ্ঠা ১৮।
[৫] সুনানু তিরমিজি : ২৬৫৮
[৬] সহিহ বুখারি : ৮৭