ইতিহাস জুড়ে, পশ্চিমা সভ্যতার লজ্জাশীলতার প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি বেশ অনেক বার পরিবর্তনের সম্মুখীন হয়েছে। প্রাচীন গ্রীস ও রোমে নগ্নতাকে সহজাতভাবে অশ্লীল বলে মনে করা হত না। শিল্প ও ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় নগ্নতাকে তারা স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করত। রেনেসাঁ যুগে অশ্লীলতার প্রতি আগ্রহের পুনরুজ্জীবন দেখা যায় তাদের মধ্যে। যার ফলে অসংখ্য নগ্ন ভাস্কর্য ও চিত্রকর্ম তৈরি করা হয়। পশ্চিমে খ্রিস্টধর্মের উত্থান এবং পশ্চিমা সমাজে এর প্রভাবের কারণে খ্রিষ্টধর্মের লজ্জার ধারণাগুলো ধর্মীয় বিশ্বাস ও শিক্ষার সাথে জড়িয়ে পড়ে।
১৯ শতকে ভিক্টোরিয়ান যুগে, শালীনতা ও পোষাকআশাকের ওপর জোর দিয়ে কঠোর সামাজিক আচরণবিধি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এই যুগটি ছিল পূর্ববর্তী সময়ের সাথে সম্পূর্ণ বৈপরীত্যের সাক্ষী। এই সমাজে নারীদের শরীরের আবরণ অত্যন্ত মূল্যবান বলে মনে করা হয়তো। পোশাক সামাজিক মর্যাদা এবং নৈতিক গুণের প্রতীক হয়ে ওঠে। সমাজের সেট করা মানদণ্ড থেকে যে কোনো বিচ্যুতি ঘটলে কঠোর বিচার করা হতো।
কিন্তু এরপর পশ্চিমের আরো অধঃপতনের গল্পই রচিত হয়েছে। মানুষ ও পশুর মধ্যে পার্থক্য নির্ণয়কারী যেসব গুণাবলি আছে, পাশ্চাত্য সমাজ তার সবগুলোকেই বিসর্জন দিয়েছে। তাদের অধঃপতন ও চারিত্রিক বিকৃতি এতো নিচে নেমে গেছে যে, তারা আজকাল সমকামিতাকেও তেমন কোনো চারিত্রিক বিচ্যুতি বলে মনে করে না ।
নৈতিকতাকে তারা জীবনের সকল ক্ষেত্র থেকে ঝেটিয়ে বিদায় করলেও রাজনীতি ও অর্থনীতির ক্ষেত্রে এখনো কিছুটা রাখতে বাধ্য হয়েছে। তবে এটা নৈতিকতা বা আদর্শবাদিতার কারণে নয়; বরং নিছক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ফায়দা লাভের জন্য। নিছক স্বার্থ রক্ষার জন্য এই দুটো সেক্টরে তারা কিছুটা সতর্কতা অবলম্বন করছে। একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যাবে। বেশ কিছুদিন আগে প্রফুমো নামক একজন বৃটিশ মন্ত্রী একই সাথে ক্রিশ্চিয়ান কিলার নামে এক মহিলা ও রাশান দূতাবাসের এক কর্মকর্তার সাথে যৌন কেলেংকারিতে জড়িয়ে পড়ে। আবার এই মন্ত্রী পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে এ ব্যাপারে মিথ্যা বিবৃতিও দিয়েছিল। সবমিলিয়ে তার অপরাধের পাল্লাটি যখন তাদের দৃষ্টিতে ভারী হয়ে উঠলো তখন তারা মন্ত্রীকে খুবই তিরস্কার করলো। তবে তাদের এই সমালোচনা বা তিরস্কার এ কারণে ছিল না যে, তাদের মন্ত্রী নীতি-আদর্শ হারিয়ে পশুর মতো যথেচ্ছা যৌনচারী হয়ে ওঠেছে; বরং তাদের এই সমালোচনা ও তিরস্কারের মূল কারণ ছিলো যে, একজন মন্ত্রী যদি এই ধরনের লোকদের সাথে যৌন সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে তাহলে তা রাষ্ট্রের গোপনীয়তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে। কেননা, এসব বিদেশী প্রতিনিধিদের সাথে যৌন সম্পর্কের দুর্বলতার কারণে সে হয়তো রাষ্ট্রের কোনো গোপন তথ্য তাদের কাছে ফাঁস করে দিতে পারে। আমেরিকার সিনেটের বুড়ো ভামগুলোও এ ব্যাপারে একেবারে কম যায় না। যৌন কেলেংকারির ঘটনা তাদের ওখানেও তেমন কোনো ব্যাপার নয় ।
এদিকে রাশিয়া এই ধরনের যৌন সম্পর্কের মাধ্যমে গুপ্তচর বৃত্তির অভিযোগে অভিযুক্ত আমেরিকান ও বৃটিশদের আশ্রয় দিতে এগিয়ে আসে। কেননা, তাদের কাছেও এসব বেহায়াপনা তেমন কোনো ব্যাপারই নয়।
আজকাল সকল জাহেলি সমাজই মানুষকে সহজলভ্য যৌনাচারের দিকে ঠেলে দিতে ব্যস্ত। এসব সমাজে সাহিত্য, সাংবাদিকতা, লিখনী, গল্প, উপন্যাস, চলচ্চিত্র, নাটক সবকিছুর মাধ্যমেই মানুষের মাঝে যৌন সুড়সুড়ি জাগিয়ে তোলার অব্যাহত প্রচেষ্টা চলতে থাকে। এমন সব সস্তা দর্শন তারা মানুষের মাঝে ছেড়ে দেয় যে, মানুষগুলো সহজেই এক একটা ‘যৌন পশু’ হয়ে ওঠে। ক্ষণিকের উন্মাদনা ও পশুসুলভ যৌনতাকে তাদের মধ্যে সারাক্ষণ জাগিয়ে রাখার মাধ্যমকে নিজেদের জীবনের লক্ষ্য উদ্দেশ্য বানিয়ে ফেলে। মানুষে যাতে সহজেই এই কুকর্মে জড়িয়ে পড়ে এজন্য তারা বলে যে, মনের মিলই বড় মিল, সুতরাং, মনের মিল থাকলে শারীরিক লেনদেন কোনো ব্যাপারই নয়’। সভ্যতা, শালীনতা, বিয়ে-শাদী তাদের কাছে কোনো বিষয়ই নয়। তারা শুধু ধর্ষণকেই অপরাধ মনে করে। পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে এই পশুসুলভ কুকর্মকে তারা বৈধতার সার্টিফিকেট দিয়ে দেয়। এমনকি স্বামীর সাথে সামান্য মনোমালিন্য সৃষ্টি হলে তারা নারীর শরীরটাকে অযথা ফেলে না রেখে নতুন প্রেমিক খুঁজে নিয়ে শরীরটাকে কাজে লাগিয়ে দেয়ার পরামর্শ দেয়। আর একথা সবারই জানা যে-বেপর্দা পরিবেশে যুবক-যুবতী, নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা, ক্ষণিকের চোখাচোখি, চোরা চাহনির সূত্র ধরে সাময়িক সম্পর্ক গড়ে ওঠা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। আর এই যৌনগুরুদের দর্শন দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে ক্ষণিকের সম্পর্কটাকে যখন যৌন সম্পর্কে রূপান্তরিত করা হয় তখন সমাজটা যৌন পশুতে ভরে যাওয়াই স্বাভাবিক। জাহেলি সমাজের এসব নোংরা দর্শনগুলোকে মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য এসব যৌনগুরুরা গল্প, উপন্যাস, ছবি, নাটক, শিল্প-সাহিত্যসহ বিভিন্ন মাধ্যম ব্যবহার করে। সত্যিকার মানবীয় দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে যদি আমরা এ ধরনের সমাজের গুণগতমান যাচাই করতে চাই তাহলে আমাদেরকে কোনো রাখঢাক না রেখেই বলতে হবে যে, এ ধরনের সমাজ হলো জাহেলি সমাজ, অসভ্য সমাজ, পশুদের সমাজ। পক্ষান্তরে, ইসলামি সমাজব্যবস্থা চায় মানুষের চরিত্র থেকে এসব পশুবৃত্তিকে দূর করে তাকে উঁচুমানের পরিচ্ছন্ন মানবীয় মূল্যবোধের আলোয় আলোকিত করে তুলতে। এই পশুবৃত্তি দমন করার জন্য প্রয়োজনীয় সকল ব্যবস্থা গ্রহণের পাশাপাশি ইসলাম মানুষের দৈহিক প্রয়োজন পূরণ ও মানসিক প্রশান্তির জন্য শালীন এবং সভ্য যে নিয়মের প্রবর্তন করে তা-ই হলো ‘বিবাহভিত্তিক পরিবার ব্যবস্থা’। নিছক শারীরিক চাহিদা পূরণকেই বিয়ের একমাত্র উদ্দেশ্য ইসলাম মনে করে না; বরং শালীন, সভ্য ও পবিত্র প্রক্রিয়ায় দৈহিক প্রয়োজন পূরণের সাথে সাথে, এর সূত্র ধরে জন্ম নেয়া অনাগত ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ধারক-বাহক তথা সন্তানদেরকে সুষ্ঠুভাবে লালনপালন, তাদের চরিত্র গঠন, তাদের মধ্যে মানবীয় গুণবৈশিষ্ট্য বিকাশের মাধ্যমে সত্যিকার মানুষ হিসেবে গড়ে তোলাই এই পরিবার ব্যবস্থার সর্বপ্রধান উদ্দেশ্য।
প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে, যুগ থেকে যুগান্তরে মানবসভ্যতাকে টিকিয়ে রাখার জন্য ইসলামের পারিবারিক ব্যবস্থার কোনো বিকল্প নেই। পরিবারকে কেন্দ্র করেই যেহেতু মানবসভ্যতার বিকাশ সাধিত হয়, তাই পরিবার নামক এই সংস্থাটিকে সকল ধরনের কলুষতা থেকে পবিত্র রাখতে ইসলাম বদ্ধপরিকর। মানুষের মানবীয় মূল্যবোধ, নীতি-নৈতিকতা ও মেধার বিকাশের স্বার্থে এবং সমাজকে কলুষমুক্ত রাখতে পরিবারকে পশুসুলভ উন্মাদ যৌনবৃত্তির ছোবল থেকে মুক্ত রাখা অপরিহার্য। পরিবার যাতে নিছক যৌনচারের ময়দান না হয়ে যায় বরং মানবসমাজকে পবিত্র পরিচ্ছন্ন করে গড়ে তোলার একটা আদর্শ সংগঠনে পরিণত হয়, সেজন্য প্রয়োজনীয় সকল ব্যবস্থা গ্রহণ করা বাঞ্ছনীয়। আর একমাত্র ইসলামি সমাজই এই দায়িত্বকে নিজের অপরিহার্য ফরয কর্তব্য হিসেবে বিবেচনা করে।
পক্ষান্তরে, অতীত কিংবা বর্তমানের যেসব সমাজব্যবস্থা মানুষের মনুষ্যত্ববোধকে দূর করে তাদের পশুসুলভ যৌনবৃত্তি উস্কে দেয়ার জন্য সাহিত্য, সংস্কৃতি ও সকল প্রচার মাধ্যমে অভিযান চালায় তাকে কি করে অসভ্য সমাজ না বলে পারা যায়? কি করে এই সমাজে মানুষের নীতি-নৈতিকতা ও আদর্শবাদিতার বিকাশ সম্ভব! এমনি একটি সমাজে বাস করে আজকের মানবশিশুটি কি আগামী দিনের যোগ্য নাগরিক হয়ে গড়ে উঠতে পারবে?
কিছুতেই না। কস্মিনকালেও না। এই ব্যবস্থা কখনোই মানবজাতিকে সত্যিকার আদর্শ সমাজ উপহার দিতে পারবে না; বরং এই সমাজের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থভোগী নেতারা আপনাকে আমাকে এবং আমাদেরই আদরের সন্তান – অনাগত ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে অসভ্যতা, নোংরামী ও বেহায়াপনার দিকে ঠেলে দিয়ে নিজেদের স্বার্থরক্ষায় সদা ব্যস্ত থাকবে। এটাই সত্য, এটাই বাস্তবতা। তাই আমাদেরকে আজ বুঝতে হবে যে, ইসলামি আদর্শ, ইসলামি মূল্যবোধ, ইসলামি সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থাই মানবজাতির জন্য একমাত্র কল্যাণকর ব্যবস্থা। মানবসভ্যতা বিকাশের জন্য ইসলাম যে শাশ্বত জীবনব্যবস্থা প্রণয়ন করেছে, তা দেখে যে কোনো সুস্থ বিবেকবান মানুষ এ কথা স্বীকার করে নিতে বাধ্য যে, ইসলামি সমাজই একমাত্র সভ্য সমাজ, ইসলামি সভ্যতাই একমাত্র মানবসভ্যতা।