২০১৩ সালের বসন্তে গুগল রিসার্চ এক দারুণ ঘোষণা দেয়। তারা ঘোষণা দেয় যে, তারা কোয়ান্টাম এআই ল্যাব নিয়ে কাজ শুরু করতে যাচ্ছে। সেখানে তারা কোয়ান্টাম কম্পিউটার নিয়ে কাজ করবে। সেটা সেই সময়ে বড় এক বিষয় ছিল। তখন সর্বাধুনিক প্রযুক্তির যে কোয়ান্টাম কম্পিউটারটি বানিজ্যিকভাবে পাওয়া যেত তা হলে ডি-ওয়েভ টু যেটি নির্মাণ করেছিল ডি-ওয়েভ সিস্টেমস। যাইহোক, এভাবেই শুরু হয়য় কোয়ান্টাম কম্পিউটিংয়ে গুগলের যাত্রা।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন আগামী কয়েক দশকের মধ্যে কোয়ান্টাম কম্পিউটার আমাদের ডেস্কটপ কম্পিউটারগুলোকে প্রতিস্থাপন করবে এবং আমাদের জীবনে বিপ্লব ঘটাবে।
কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞানের অদ্ভুত বৈশিষ্ট্যকে কাজে লাগিয়ে মেশিন লার্নিংকে দ্রুততর করতে, জলবায়ু পরিবর্তনের সমাধান করতে এবং নতুন ওষুধ আবিষ্কার করতে সক্ষম হবে বলে বিশ্বাস করা হচ্ছে।
এখন, গুগল দাবি করেছে যে তারা “কোয়ান্টাম সুপ্রিমেসি” অর্জনের মাধ্যমে এই ধরনের একটি ডিভাইস তৈরির রিসার্চে একটি বড় মাইলফলক ছুঁয়েছে। এটি এমন সমস্যাগুলোর সমাধান করতে পেরেছে যা কোনো ক্লাসিক্যাল মেশিন করতে পারবে না।
টেক জায়ান্টটি বলছে যে, তারা এমন একটি কোয়ান্টাম কম্পিউটার তৈরি করেছে যা তাত্ক্ষণিকভাবে গণনা করতে সক্ষম। যে গণনাটি বর্তমান সময়কার সবচেয়ে দ্রুততম কম্পিউটারের করতে ৪৭ বছর সময় লাগবে।
আপনার মনে হতে পারে আপনি কথাটা আগেও শুনেছেন। গুগল ২০১৯ সালেই দাবি করেছিল যে তারা কোয়ান্টাম সুপ্রিমেসি অর্জন করেছে। যদিও সেই সময়ে গুগলের প্রতিদ্বন্দ্বীরা গুগলের দাবিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছিল।
গুগলের প্রতিদ্বন্দ্বী আইবিএম উল্লেখ করেছিল যে, গুগলের সাইকামোর কোয়ান্টাম কম্পিউটারটি যে কাজটি বা সমস্যাটির সমাধান করতে সক্ষম হয়েছিল তা বিশেষভাবে কঠিন ছিল না। ঐ একই সমস্যা ক্ল্যাসিক্যাল কম্পিউটার দিকে কিছুটা ধীর গতিতে করা সম্ভব।
চার বছর পর, গুগলের গবেষকরা পুনরায় দাবি করছেন যে, তারা এমন শক্তিশালী মেশিন তৈরী করেছেন যা ক্লাসিক্যাল মেশিনের চাইতে অনেক বেশী ক্ষমতাশালী। অর্থাৎ তারা কোয়ান্টাম সুপ্রিমেসির দাবি করছেন।
এই কোয়ান্টাম কম্পিউটারটি তৈরী করতে কি পরিমাণ খরচ হয়েছে সে ব্যাপারে কিছু জানা যায়নি।
গুগলের টিমটি বলেছে, “কোয়ান্টাম কম্পিউটার এমন সব কাজ করার সম্ভাবনা রাখে যেগুলো সাধারণ কম্পিউটারের সাধ্যের বাইরে। আমরা পরীক্ষণে যা পেয়েছি তাতে দেখেছি বর্তমান সুপার কম্পিউটারগুলোর চেয়ে আমাদের কম্পিউটারের ক্ষমতা অনেক বেশী।”
কোয়ান্টাম প্রযুক্তি তথ্য প্রক্রিয়াকরণকে ব্যাপকভাবে গতিশীল করতে কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞানের অদ্ভুতুড়ে প্রভাবকে ব্যবহার করে। যার দ্বারা পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী কম্পিউটার তৈরী করা সম্ভব।
বর্তমান পৃথিবীর সবচেয়ে দ্রুতগতির কম্পিউটার হল টেনেসির ফ্রন্টিয়ার সুপার কম্পিউটার। কিন্তু সেটাও কোয়ান্টাম কম্পিউটারের সাথে লড়াই করতে সক্ষম নয়।
প্রচলিত সাধারণ কম্পিউটারগুলো বাইনার কোডের প্রসেসিং ভাষা ব্যবহার করে। এই ভাষাটি শুণ্য বা এক – এই দুইটি অবস্থার ওপর ভিত্তি করে গঠিত।
তবে কোয়ান্টাম বলবিদ্যায় কোয়ান্টাম বিট বা কুইবিট বলে একটা পরিভাষা আছে। যেখানে একটা জিনিস শুণ্য, এক অথবা দুটোই একসাথে হতে পারে।
Google এর মতে, তাদের Sycamore কোয়ান্টাম প্রসেসরের নতুন সংস্করণটি ৭০ কুইবিট চালাতে পারে, যেখানে Sycamore-এর আগের সংস্করণ ৫৩ কিউবিটের ছিল।
৭০ কিউবিটের কোয়ান্টাম প্রসেসর মানে এটি ৭০ কোয়ান্টাম বিটের তথ্য ধারণ করতে এবং প্রক্রিয়া করতে পারে। যেটা ক্ল্যাসিক্যাল কম্পিউটারের পক্ষে অসম্ভব। সেই কম্পিউটার যতই ধীর বা দ্রুতগতির হোক না কেন।
এই কম্পিউটারটা কতটা শক্তিশালী সেটা বোঝানোর জন্য গুগলের টিমটি একটি উদাহরণ দিয়েছে। যে সমস্যাটির সমাধান করতে গুগলের ৫৩ কিউবিটের কম্পিউটারের ৬.১৮ সেকেন্ড লেগেছে সেটার সমাধান করতে ফ্রন্টিয়ারের লাগবে ৪৭.২ বছর।
গুগলের গবেষকরা বলছেন যে, তাদের মূল লক্ষ্য হচ্ছে তাদের এই ৬০ কিউবিটের ডিভাইসের পারফরমেন্স দেখানো এবং সেটাকে নিশ্চিত করা।
আইবিএম এখনো গুগলের এই নতুন কাজ নিয়ে কোনো মন্তব্য করেনি। কিন্তু কেমব্রিজ-ভিত্তিক কোয়ান্টাম কোম্পানি রিভারলেনের প্রধান নির্বাহী স্টিভ ব্রিয়ারলি টেলিগ্রাফকে বলেছেন যে গুগলের নতুন কাজ একটি “মাইলফলক”।
তবে ইউনিভার্সিটি অফ সাসেক্সের ইয়ন কোয়ান্টাম টেকনোলজি গ্রুপের সেবাস্টিয়ান উইড্ট, ২০১৯ সালের সমালোচনারই প্রতিধ্বনি করেছেন। তিনি বলেছেন যে, যে Google এখনো কোয়ান্টাম কম্পিউটার দিয়ে কোনো দরকারী সমস্যার সমাধান করতে পারেনি।
ওয়েইডট বলেন, “তারা কোয়ান্টাম অ্যাডভান্টেজের দারুণ প্রদর্শনী করেছে। তারা যে অর্জন করেছে তা অ্যাকাডেমিকভাবে বেশ ভালো বলতে হবে। তবে যে অ্যালগরিদম ব্যবহার করা হয়েছে সেটার বাস্তব দুনিয়ার কোনো প্র্যাকটিক্যাল অ্যাপ্লিকেশন নেই।”
“আমাদের এমন কোয়ান্টাম কম্পিউটার দরকার যেগুলো আমাদের কাজে আসবে। এমন কোয়ান্টাম কম্পিউটিং এর যুগে আমরা প্রবেশ করতে চাই যেখানে হাজার হাজার কুইবিট সমাজের জন্য উপকার বয়ে আনবে, যেগুলো ক্ল্যাসিক্যাল কম্পিউটারের পক্ষে কখনোই সম্ভবপর ছিল না।”
সাসেক্স সেন্টার ফর কোয়ান্টাম টেকনোলজিসের পরিচালক প্রফেসর উইনফ্রিড হেনসিঙ্গার মেইল অনলাইনকে বলেছেন: “গুগল একটি নির্দিষ্ট একাডেমিক সমস্যা সমাধান করেছে যা একটি ক্ল্যাসিক্যাল কম্পিউটারে গণনা করা কঠিন।”
তাদের নতুন এই প্রদর্শনী থেকে বোঝা গেছে যে, কোয়ান্টাম কম্পিউটারগুলো একটি স্থিতিশীল গতিতে বিকাশ লাভ করছে।
“পরবর্তী গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হচ্ছে এমন কোয়ান্টাম কম্পিউটার তৈরি করা যেগুলো তাদের অপারেশনের অন্তর্নিহিত সমস্যাগুলো সংশোধন করতে পারবে।”
সাসেক্স ইউনিভার্সিটি গুগল, আইবিএম ও মাইক্রোসফটসহ বড় প্রযুক্তি সংস্থাগুলোর সাথে একটি কোয়ান্টাম কম্পিউটার তৈরির জন্য যুক্তরাজ্যের হয়ে এই প্রতিযোগিতায় নেতৃত্ব দিচ্ছে।
শেষ পর্যন্ত লক্ষ্য হচ্ছে একটি “বাণিজ্যিক” কোয়ান্টাম কম্পিউটার তৈরি করা – যা জনসাধারণ কিনতে সক্ষম হবে।
তবে বানিজ্যিক কম্পিউটার পেতে এখনো অন্তত এক বা দুই দশক লাগবে। আপাতত কোম্পানিগুলো “পরীক্ষামূলকভাবে” কোয়ান্টাম কম্পিউটার তৈরি করছে যা এখনও গবেষণা এবং বিকাশের পর্যায়ে রয়েছে।
আইবিএম ইতিমধ্যেই কিউ সিস্টেম ওয়ান নামে একটি কোয়ান্টাম মেশিন তৈরি করেছে, যা ব্যবসার পাশাপাশি গবেষকরাও ব্যবহার করতে পারবেন।
২০১৯ সালে এই মেশিনটি লঞ্চ করা হয়। এর প্রসেসিং ক্ষমতা ছিল ২০ কুইবিট। যা কোয়ান্টাম সুপ্রিমেসি অর্জনের জন্য যথেষ্ট ছিল না।
২০১৯ সালে গুগল বলেছিল যে তার ৫৩-কুইবিট কোয়ান্টাম কম্পিউটার ২০০ সেকেন্ডের মধ্যে একটি গণনা সম্পাদন করতে পারে যা করতে ক্লাসিক্যাল কম্পিউটার ১০ হাজার বছর সময় নেবে।
নেচার জার্নালে গুগলের দলটি বলেছে যে, তারা একটি নির্দিষ্ট সেট অপারেশন করেছে যা একটি র্যান্ডম নম্বর স্যাম্পলিং টাস্ক সমাধানের জন্য ৫৩ কুইবিটকে কোয়ান্টাম অবস্থায় আটকে রাখে।
তবে IBM সহ কোয়ান্টাম প্রযুক্তি গবেষণায় গুগলের বড় প্রতিদ্বন্দ্বীরা Google এর কোয়ান্টাম সুপ্রিমেসি অর্জনের দাবিকে মেনে নেয় নি।
তারা যুক্তি দিয়েছিল যে, গুগলের কম্পিউটার যে কাজটি করেছে সেটা ক্ল্যাসিক্যাল কম্পিউটার ১০ হাজার বছর পরে হলেও সমাধান করতে পারবে।
কিন্তু কোয়ান্টাম সুপ্রিমেসি অর্জনের শর্ত এটা নয়। কোয়ান্টাম সুপ্রিমেসি এর মূল অর্থ হচ্ছে, যেমনটা জন প্রেস্কিল ২০১২ সালে বলেছিলেন যে, কোয়ান্টাম কম্পিউটারগুলো এমন কাজ করতে সক্ষম হবে যেগুলো ক্ল্যাসিক্যাল কম্পিউটার দিয়ে কোনোদিনও করা সম্ভব হবে না। এই জায়গায় এখনো আমরা পৌঁছাতে পারিনি।
সাসেক্স সেন্টার ফর কোয়ান্টাম টেকনোলজিসের ডিরেক্টর প্রফেসর উইনফ্রিড হেনসিঙ্গার সেই সময়ে ল্যাবরেটরি নিউজকে বলেছিলেন: “তারা [গুগল] যে সমস্যাটি বেছে নিয়েছে তা সম্পূর্ণরূপে ফালতু সমস্যা।”
“তাদের জন্য পরবর্তী পদক্ষেপ হলো দরকারী কোনো সমস্যা সমাধান করা।”