আপনি দাম্পত্য জীবনে প্রবেশ করেছেন মানে আপনি অর্ধেক দ্বীন পুরণ করে ফেলেছেন, আলহামদুলিল্লাহ। কেননা হাদিসে এসেছে,
হযরত আনাস ইবনু মালিক রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে, রাসুল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেন, “ যে বিয়ে করল তার ঈমানের অর্ধেক পুর্ণ হয়ে গিয়েছে। বাকি অর্ধেক অংশের জন্য যেন সে আল্লাহ তায়ালাকে ভয় করে।” [ তাবারানী, হাদিস নং ৭৬৪৭]
অনেকের মুখেই শুনেছি যে, বিয়ের প্রথম কয়েকটা দিন বা কিছু মাস অথবা প্রথম একটা বছর ভালই সুখের মধ্য দিয়ে কাটে, এরপর বৈবাহিক সম্পর্ক নাকি বিস্বাদ হয়ে যায়। আবার অনেকে নাকি দায়িত্ববোধ থেকে সংসার করে যায় আবার অনেকের মাঝে বিচ্ছেদও হয়ে যায়। কারো বিচ্ছেদের কথা শুনলে বরাবরই আমার মন খারাপ হয়। আমাদের উচিত সম্পর্কগুলোর যত্ন নেয়া। এক্ষেত্রে স্বামী স্ত্রী উভয়কেই এগিয়ে আসতে হবে।
দাম্পত্য সম্পর্ক উন্নয়ন ও স্বামী স্ত্রীর মাঝে ভালবাসা অটুট রাখার জন্য অনেক বিষয় আছে। তবে আজকে আমরা মাত্র একটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করব। এটা এমন একটি বিষয়, যেটি অনুসরণ করার মাধ্যমে আপনি শুধু দাম্পত্য সম্পর্ক নয়, যেকোনো সম্পর্ক মজবুত করতে পারবেন। সেই বিষয়টি হলো “সালাম”।
আবু হুরাইরা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “ঐ সত্তার কসম, যার হাতে আমার প্রাণ, তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করবে না, যতক্ষণ না তোমরা মু‘মিন হয়েছো, আর তোমরা মু‘মিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না তোমরা পরস্পরকে ভালবাসবে। আমি কি তোমাদেরকে এমন একটি আমলের সন্ধান দিব না, যা পালন করলে তোমরা পরস্পরকে ভালবাসতে পারবে? সেটি হলো: “তোমরা পরস্পরের মাঝে সালামের ব্যাপক প্রচলন ঘটাও।”
[সহীহ মুসলিম ৫৪; ইবনু মাজাহ ৬৮; তিরমিযী: ২৬৮৮]
দেখুন এখানে আমাদের নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কত সুন্দরভাবে সালামের বিষয়টি ব্যক্ত করেছেন,সুবহানাল্লাহ। তিনি প্রথমে বলেছেন আমরা মুসলিমরা একে অপরকে ভাল না বাসলে মু’মিনই হতে পারব না। এরপর তিনি সেই আমলের সন্ধান দিয়েছেন, যা পালন করলে আমরা একে অন্যকে ভালবাসতে পারব। তারমানে ‘সালাম’ও একটি ইবাদত। আপনি যতবার কাউকে সালাম দিচ্ছেন ততবার আপনার আমলনামায় সওয়াব লেখা হচ্ছে।
আমরা মুসলিমরা সাধারনত কারো সাথে দেখা হলে কম বেশি সালাম বিনিময় করি। চেনা-অচেনা সবাইকে সালাম দিতে হবে। কারন এটা রাসুলের নির্দেশ। আবদুল্লাহ ইবনে আমর রা: থেকে বর্ণিত-
এক লোক এসে জিজ্ঞেস করল ইসলামের কোন কাজ উত্তম? নবীজী সা: বললেন, ‘তুমি খানা খাওয়াবে যাকে চেন অথবা চেন না সবাইকে সালাম দেবে’ (বুখারি হা-১২)।
সালামের মাধ্যমে মুসলমানদের হক আদায় করাও হয়। এক মুসলমানের ওপর অপর মুসলমানের ছয়টি হক রয়েছে।
১. যখন কোনো ব্যক্তি রোগে আক্রান্ত হয়, তখন তাকে দেখতে যাবে; ২. কোনো লোক মৃত্যুবরণ করলে, জানাজায় অংশ নেবে; ৩. কেউ দাওয়াত করলে, সে দাওয়াত কবুল করবে; ৪. কারো সাথে সাক্ষাৎ হলে, প্রথমে সালাম দেবে; ৫. যখন সে হাঁচি দেয় তখন সে হাঁচির জওয়াব দেবে; ৬. কেউ উপস্থিত বা অনুপস্থিত উভয় অবস্থায় তার কল্যাণ কামনা করবে’ (তিরমিজি হা-২৭৩৭)।
ছোট বড়কে সালাম দেবে; আরোহী পদচারীকে; পদচারী উপবিষ্টকে এবং অল্পসংখ্যক অধিক সংখ্যককে সালাম দেবে। এটাই ইসলামের রীতি। (বুখারি হা-৬২৩২)
কিন্তু খুব কম মুসলিমই আছি যারা তাদের পরিবারের আপনজনদের সালাম দেই। আমাদের মা, বাবা, ভাই,বোন, স্বামী, স্ত্রীদেরকে সালাম দিতে আমাদের লজ্জা লাগে। তাদের সালাম দেয়ার বিষয়টি আমরা এড়িয়ে যাই। অথচ তাদের সাথেই আমাদের সম্পর্ক গাঢ় করা উচিত।
প্রতিটা দাম্পত্য সম্পর্কের মাঝে এই যে টানাপোড়ন চলে, মান অভিমান বা মনোমালিন্য হয়। এইসব কারনে আমরা আপসেট হয়ে যাই, আমাদের মন খারাপ হয়, আমরা বুঝতে পারি না কি করব! কিভাবে এর সমধান করব!
এরও সমাধান আছে, যা আমরা এর আগে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর হাদিস থেকে জেনে এসেছি। সেটা কী? সেটা হলো, আমাদের স্বামী স্ত্রীদের মাঝে অধিকহারে সালামের চর্চা করা।
- স্বামী স্ত্রীরা সালামের প্রতিযোগিতা করবেন। কারন যে আগে সালাম দিবে তার সওয়াব বেশি।
- স্বামীরা বাইরে থেকে ফিরে স্ত্রীদের সালাম দিয়ে ঘরে প্রবেশ করবেন। স্ত্রীরাও চেষ্টা করবেন স্বামীর আগে সালাম দিতে। “সালাম” বিনিময়ের মাধ্যমে দম্পতিরা তাদের সম্পর্কের মধ্যে শান্তি ও প্রশান্তি গড়ে তোলার গুরুত্বের কথা মনে করিয়ে দেয়।
- কোনো প্রয়োজনে একে অপরকে যতবার ফোন করবেন, ততবারই প্রথমে সালাম বিনিময় করবেন। এরপর প্রয়োজনীয় কথা শেষে আবারও সালাম বিনিময় করে ফোন কেটে দিবেন। কারণ সালাম হচ্ছে এক প্রকার দুয়া। আপনারা যতবার সালাম বিনিময় করছেন ততবার একে অপরের জন্য শান্তি ও কল্যাণের জন্য দুয়া করছেন। এর ফলে আপনাদের দাম্পত্য সম্পর্কের মাঝে আল্লাহ শান্তির বীজ বপন করে দিবেন ইন শা আল্লাহ।
- আপনার সঙ্গীকে মুচকি হেসে সালাম দিন। এতে ২ ধরনের সওয়াব আপনার আমলনামায় যুক্ত হবে। কারন মুচকি হাসাও সুন্নাত, সালাম দেয়াও সুন্নাত।
- উভয়ের মনোমালিন্যকে সালামের মাধ্যমে নিষ্কৃতি দিন। ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হলে, প্রথমে যতটা সম্ভব কোমল কন্ঠে আপনার সঙীকে সালাম দিন। এরপর তার চোখে চোখ রেখে সরি বলুন। তার অভিমান ভাঙ্গান।
- সালাম না দেয়া কৃপণতা। এই কৃপণতা থেকে বাঁচতে হলে বেশি বেশি সালাম দাও। আবু হুরায়রা রা: বলেন, ‘যে ব্যক্তি সালাম দিতে কার্পণ্য করে সে সব চেয়ে বড় কৃপণ। যে ব্যক্তি দোয়া করার ব্যাপারে অক্ষম, সে সব চেয়ে বড় অক্ষম’ (আল আদাবুল মুফরাদ হা-১০৪২)।
দাম্পত্য সম্পর্ক উন্নত করতে সালামের গুরুত্ব অপরিসীম। সালাম দেয়া রাসূলুল্লাহর নির্দেশ। নবীজী সা: মদিনায় এসে নতুন এক রাষ্ট্রীয় কাঠামো তৈরি করেন, যেখানে ইসলাম প্রচারে নানা ধরনের লোক এসে মুসলমান হয়ে নতুন জীবন যাপন করা শুরু করেছেন। এ সময়ে নানা ধরনের লোকের মধ্যে পরস্পর সম্প্রীতি ভালোবাসা প্রতিষ্ঠায় সালামের ভূমিকা প্রয়োজনীয় হয়ে ওঠে। আবদুল্লাহ ইবনে সালাম রা: বলেন, নবীজী সা: মদিনায় পদার্পণ করেই সর্বপ্রথম যে কথা বললেন, ‘হে লোক সকল, তোমরা পরস্পর সালাম বিনিময় করো, অভুক্তকে আহার করাও, গভীর রাতে সালাত আদায় করো’ (তিরমিজি-২৪৮৫)।
জান্নাতে জান্নাতিদের ফেরেশতারা সালাম দিয়ে অভিবাদন জানাবে এবং পরস্পরের শুভেচ্ছা বিনিময় হবে আসসালামু আলাইকুম দ্বারা। আর তাদের শেষ কথা হবে আল হামদুলিল্লাহি রাব্বিল আলামিন’ (সূরা ইউনুস-১০)।
জান্নাতে এক জান্নাতি এবং অপর জান্নাতিদের মধ্যে অভিবাদন হবে সালাম। আল্লাহ বলেন, ‘যারা ঈমান আনে এবং সৎকর্ম করে তারা প্রবেশ করবে জান্নাতে সেখানে তারা থাকবে চিরকাল। সেখানে অভিবাদন হবে সালাম’ (সূরা ইবরাহিম-২৩)। তারা শুনবে না কোনো বাজে কথা অথবা পাপবাক্য, সালাম আর সালাম ব্যতীত’ (সূরা আল ওয়াকিয়াহ : ২৫-২৬)।
শুধু ফেরেশতারা কিংবা জান্নাতিরাই নয়, স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা সব জান্নাতিকে সালাম দিয়ে অভিবাদন জানাবেন, সুবহানাল্লাহ! আল্লাহ বলেন, ‘পরম দয়ালু প্রতিপালকের পক্ষ থেকে তাদের বলা হবে সালাম’ (সূরা ইয়াসিন-৫৮)।
কারো অনুপস্থিতিতে অন্যের মাধ্যমে সালাম প্রেরণ করার রীতিও ইসলামে আছে। এরকম একটি হাদিসও আছে। আয়েশা রা: থেকে বর্ণিত, একদা নবীজী সা: বললেন, হে আয়েশা জিবরাইল তোমাকে সালাম দিচ্ছেন। আয়েশা রা: উত্তরে বললেন, তার প্রতিও সালাম, রহমত, বরকত বর্ষিত হোক (বুখারি হা-৩২১৭)।
সুতরাং চলুন, দুনিয়াতেই আমরা সালামের চর্চা করি, সালামের প্রসার ঘটাই, অন্যকেও সালাম বিনিময়ে অনুপ্রাণিত করি। সালাম পরস্পরের প্রতি দয়ামায়া, আন্তরিকতা ভালোবাসা, মমত্ববোধ, দায়িত্ববোধ সহমর্মিতা জাগ্রত করে। তখন মানব মনের কোণে অহঙ্কার বড়ত্ব হিংসা বিদ্বেষ, অন্যের প্রতি মন্দ ধারণা পোষণ ইত্যাদি দূরীভূত হয়। মুসলিম ভ্রাতৃত্ববোধ সুদৃঢ় হয়।
ইহজীবন সুন্দর করার ক্ষেত্রে সালামের বিকল্প নেই। আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে বেশি বেশি সালামের প্রচার প্রসার করার তাওফিক দান করুন, আমিন।