জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ (JWST) হচ্ছে একটি স্পেস টেলিস্কোপ যা দিয়ে বর্তমানে ইনফ্রারেড অ্যাস্ট্রোনোমির কাজ করা হয়। এটি এযাবতকালে মহাকাশের জন্য সবচেয়ে বড় টেলিস্কোপ। এতে আছে হাই-রেজোলিউশন এবং উচ্চ-সংবেদনশীল যন্ত্র। যে জিনিসগুলো হাবল স্পেস টেলিস্কোপ দিয়ে দেখা যায় না বা আবছা দেখা যায়, সেগুলো জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ দিয়ে বেশ স্পষ্ট দেখা সম্ভব। এটি জ্যোতির্বিদ্যা এবং মহাজাগতিক বিজ্ঞানের অনেক বিষয়াদি তদন্ত করতে সাহায্য করছে। যেমন প্রথম তারা পর্যবেক্ষণ, প্রথম ছায়াপথের গঠন এবং সম্ভাব্য বাসযোগ্য এক্সোপ্ল্যানেটের বায়ুমণ্ডলীয় বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে নানা তথ্য দিতে পারছে জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ।
৯৯৬ সাল থেকে পরিকল্পিত এ প্রকল্পটি একটি আন্তর্জাতিক সহযোগিতামূলক প্রচেষ্টার ফল, যার নেতৃত্বে রয়েছে মার্কিন মহাকাশ গবেষণা প্রতিষ্ঠান নাসা। নাসা-র গডার্ড মহাকাশ যাত্রা কেন্দ্র (Goddard Space Flight Center; GSFC) যন্ত্রটির নির্মাণ প্রচেষ্টার ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত ছিল। অন্যদিকে উৎক্ষেপণের পরে মহাকাশ দূরবীক্ষণ যন্ত্র বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট এটির পরিচালনা করবে। নরথ্রপ গ্রামেন কোম্পানিকে যন্ত্রটি নির্মাণের মূল ঠিকাদার হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়। এ ছাড়া ইউরোপীয় মহাকাশ সংস্থা এবং কানাডীয় মহাকাশ সংস্থাও এই কর্মসূচিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। সব মিলিয়ে বিশ্বের ১৪টি দেশ ও ২৯টি মার্কিন অঙ্গরাজ্যের ৩ শতাধিক বিশ্ববিদ্যালয়, সংস্থা ও কোম্পানির পাশাপাশি শতশত বিজ্ঞানী ও হাজার হাজার প্রকৌশলী এই প্রকল্পের উপরে কাজ করেছেন। সব মিলিয়ে এই প্রকল্পটি শেষ করতে ১০০০ কোটির বেশি মার্কিন ডলার অর্থ ব্যয় হয়েছে (যার মধ্যে নাসার অবদান ৯৭০ কোটি মার্কিন ডলার)। এতে প্রায় ৩০ বছর সময় লেগেছে। এর সাথে তুলনায় বলতে হয়, হাবল টেলিস্কোপের পেছনে এ যাবৎ ১৫০০ কোটি মার্কিন ডলার খরচ হয়েছে। নাসার দ্বিতীয় প্রশাসক এবং অ্যাপোলো অভিযানে গুরুত্বপূর্ণ অবদানকারী জেমস ই. ওয়েবের নামানুসারে যন্ত্রটির নামকরণ করা হয়েছে।
জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপটি ২০২১ সালের ২৫ ডিসেম্বর ফ্রেঞ্চ গুয়ানার কৌরো থেকে একটি আরিয়ান ৫ রকেটে করে মহাকাশে প্রেরণ করা হয়। পরে ২০২২ সালের জানুয়ারিতে Sun–Earth L2 Lagrange point-এ গিয়ে পৌঁছায়। জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ থেকে প্রাপ্ত প্রথম ছবিটি একটি প্রেস কনফারেন্সের মাধ্যমে জনসাধারণের কাছে প্রকাশ করা হয়েছিল ১১ জুলাই ২০২২ তারিখে।
জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপের ভর হাবল স্পেস টেলিস্কোপের প্রায় অর্ধেক। ওয়েব টেলিস্কোপের একটি সাড়ে ছয় মিটার বা ২১ ফুট-ব্যাসের সোনার প্রলেপযুক্ত বেরিলিয়াম প্রাইমারি মিরর রয়েছে যা 18টি পৃথক ষড়ভুজাকৃতি আয়না দিয়ে তৈরি। ইনফ্রারেড রিফ্লেকশন পাওয়ার জন্য আয়নায় একটি সোনার আবরণ রয়েছে। এটিকে স্থায়িত্ব দেওয়ার জন্য কাচের একটি পাতলা স্তর দ্বারা আবৃত করা হয়েছে।
জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ একটি অত্যন্ত শক্তিশালী টেলিস্কোপ যা এমন বস্তু দেখতে পায় যেগুলো খুব অস্পষ্ট বা অন্য টেলিস্কোপ দ্বারা দেখা যায় না। এটি ইনফ্রারেড আলোতে মহাবিশ্বকে গবেষণা করার মতো করে ডিজাইন করা হয়েছে। ফলে মহাশুণ্যে ধুলোমেঘ দ্বারা লুকানো বস্তুগুলোও দেখা যায়।
ওয়েব হাবল স্পেস টেলিস্কোপের চেয়ে ১০০ গুণ ক্ষীণ বস্তু শনাক্ত করতে পারে। এটি মহাবিশ্বের ইতিহাসের শুরুর দিকের গঠিত বস্তুগুলো দেখতে পারে। কি আশ্চর্য ব্যাপার তাই না! এটি সৌরজগতের এমন বস্তুগুলোও দেখতে পায় যেগুলো স্থল-ভিত্তিক টেলিস্কোপ দ্বারা অস্পষ্টভাবে দেখা যায়।
ওয়েব একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ টেলিস্কোপ কারণ এটি আমাদের মহাবিশ্বকে এমনভাবে বুঝতে সাহায্য করবে যা আমরা আগে কখনো করতে পারিনি। এটি আমাদেরকে এমন বস্তু দেখতে দেবে যা আমরা আগে কখনো দেখিনি এবং এটি আমাদের ছায়াপথ, নক্ষত্র এবং গ্রহের গঠন সম্পর্কে আরও জানতে সাহায্য করবে।
ওয়েব টেলিস্কোপ যা যা করতে পারে এমন কিছু জিনিস হল:
- মহাবিশ্বের ইতিহাসের প্রথম দিককার গঠিত বস্তুগুলি দেখা যায়।
- ধুলো মেঘ দ্বারা লুকায়িত বস্তু দেখা যায়।
- এক্সোপ্ল্যানেটের বায়ুমণ্ডল ।
- ছায়াপথের গঠন নিয়ে গবেষণা করা যায়।
- নক্ষত্রের বিবর্তন নিয়ে গবেষণা করা যায়।
- সৌরজগত নিয়ে গবেষণা করা যায়।
ইতিমধ্যেই যুগান্তকারী কিছু আবিষ্কার করছে। অপারেশনের প্রথম বছরেই টেলিস্কোপটি যা যা অর্জন করেছে তা হল:
- এখন পর্যন্ত দূরবর্তী মহাবিশ্বের গভীরতম এবং তীক্ষ্ণতম ইনফ্রারেড চিত্র ক্যাপচার করেছে৷
- একটি এক্সোপ্ল্যানেটের বায়ুমণ্ডলের জলীয় বাষ্প সনাক্ত করেছে।
- বৃহস্পতি গ্রহের চাঁদ ইউরোপার বায়ুমণ্ডল নিয়ে গবেষণা করেছে। ইউরোপার একটি উপতল মহাসাগর থাকতে পারে।
জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ মাত্র তার কাজ শুরু করেছে। আগামী বছরগুলোতে টেলিস্কোপটি আরও আশ্চর্যজনক আবিষ্কার করবে বলে আশা করা হচ্ছে। এই টেলিস্কোপটিকে সত্যিকার অর্থেই মহাবিশ্বের একটি জানালা বলা যায়। এটি মহাবিশ্বে আমাদের অবস্থান বুঝতে সাহায্য করছে।
এ ছাড়া জেমস ওয়েব টেলিস্কোপের ব্যাপারে আরো কিছু চমকপ্রদ তথ্য হচ্ছেঃ
- এটি এখন পর্যন্ত নির্মিত সবচেয়ে বড় এবং সবচেয়ে শক্তিশালী স্পেস টেলিস্কোপ।
- এটি হাবল স্পেস টেলিস্কোপের উত্তরসূরি।
- এটি ২৫ ডিসেম্বর, ২০২১-এ লঞ্চ করা হয়। এটি বর্তমানে পৃথিবী থেকে প্রায় এক মিলিয়ন মাইল দূরে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করছে।
- এর চারটি প্রধান যন্ত্র রয়েছে: NIRCam, NIRSpec, MIRI এবং FGS/NIRISS।
- এটিকে ইনফ্রারেড আলোতে মহাবিশ্ব নিয়ে গবেষণার জন্য ডিজাইন করা হয়েছে।
- এটি ছায়াপথের গঠন, নক্ষত্রের বিবর্তন এবং এক্সোপ্ল্যানেটের বায়ুমণ্ডল সম্পর্কে যুগান্তকারী আবিষ্কার করবে বলে আশা করা হচ্ছে।
নাসার জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপের জন্য তৈরি করা নতুন প্রযুক্তিগুলো ইতিমধ্যে অপটিক্স, মহাকাশ, জ্যোতির্বিদ্যা, চিকিৎসা এবং উপকরণসহ বিভিন্ন শিল্পে বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহার করা হয়েছে। এর মধ্যে কিছু প্রযুক্তি ব্যবহারের জন্য গবেষণা করা হচ্ছে।
উদাহরণস্বরূপ, ওয়েবের জন্য তৈরি করা “ওয়েভফ্রন্ট সেন্সিং” নামক অপটিক্যাল মেজারমেন্ট প্রযুক্তি বর্তমানে চোখের চিকিৎসার জন্য প্রয়োগ করা হচ্ছে। এতে মানুষের চোখের পরিমাপ, চোখের রোগ নির্ণয় এবং সম্ভাব্য উন্নত অস্ত্রোপচারে উন্নতি হয়েছে।
আসুন, জেমস ওয়েব টেলিস্কোপে তোলা বিস্ময়কর কিছু ছবি দেখি আমরা।