জীবন সমস্যায় পরিপূর্ণ। আপনি এখন কোন সমস্যাতে না থাকলেও বুঝে নিতে হবে সমস্যা আপনার অপেক্ষায় রয়েছে। আল্লাহ আমাদের জন্য জীবনের এমন সূত্রই নির্ধারণ করেছেন। তাই অন্যের সমস্যা দেখে উৎফুল্ল হওয়া বা মশকরা করা অনুচিত। আপনার জীবনেও শীঘ্রই সমস্যা চলে আসতে পারে। অভিজ্ঞ প্রবীণ ব্যক্তিদের কাছে নিশ্চয়ই শুনেছেন, জীবনে চলার পথ মসৃণ নয়। এই মসৃণতা নবি-রাসুলদের জীবনেও ছিল না। বরং তাদের জীবনপথ ছিল সবচেয়ে প্রতিকূলতাময়। মুমিনদের জীবনটাও অনুরূপ। যদি জীবন সহজ-স্বাচ্ছন্দ্যময় হত তাহলে দুনিয়াটাই জান্নাত হয়ে যেত। কিন্তু দুনিয়া তো জান্নাত নয়, আপনাকে সমস্যায় জর্জরিত হতেই হবে। তাহলে সমস্যায় পড়লে আমরা মুক্তি পাবো কিভাবে?
জীবনে কষ্ট আসবেই। আপনার প্রিয় কোন ব্যক্তি চোখের সামনে মারা যাবে, তখন আপনি তাঁদের জন্য কাঁদবেন। অথবা আপনি মারা গেলে আপনাকে যারা ভালোবাসত তারা আপনার জন্য চোখের জল ফেলবে। কোন না কোন একটা তো ঘটবেই। এমন পরিস্থিতিতে কি করা উচিত?
একবার রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম এর কাছে নারী সাহাবারা অভিযোগ করে বলল, ‘আপনি শুধু পুরুষদেরকেই দীনী শিক্ষা দিচ্ছেন। আমাদের জন্যেও একটা দিন নির্ধারণ করে দিন।’ রাসুল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম তাঁদেরকে প্রথম যে জিনিসটা শিক্ষা দিলেন তা হল, ‘যার তিনজন সন্তান থাকবে আর সেই তিনজনই মারা যাবে এবং তাঁদের মায়েরা ধৈর্য্যধারণ করবে, তাঁদের গন্তব্য জান্নাত।’ একজন নারী জিজ্ঞেস করলেন, ‘দুজনের ক্ষেত্রে কি হবে?’ তিনি বললেন, ‘দুজনের জন্যেও।’ এরপরে নারীটি আবার জিজ্ঞেস করলেন, ‘একজনের জন্য?’ রাসুল বললেন, ‘একজনের জন্যেও।’
আবু মুসা আশআরী রা. হতে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘যখন কোন বান্দার সন্তান মারা যায়, তখন মহান আল্লাহ স্বীয় ফেরেশতাদেরকে বলেন, ‘তোমরা আমার বান্দার সন্তানের জীবন হনন করেছ কি?’ তাঁরা বলেন, ‘হ্যাঁ।’ তিনি বলেন, ‘তোমরা তার হৃদয়ের ফলকে হনন করেছ?’ তাঁরা বলেন, ‘হ্যাঁ।’ তিনি বলেন, ‘সে সময় আমার বান্দা কি বলেছে?’ তারা বলে, ‘সে আপনার হামদ (প্রশংসা) করেছে ও ইন্না লিল্লাহি অইন্না ইলাইহি রা-জিউন (অর্থাৎ আমরা তোমার এবং তোমার কাছেই অবশ্যই ফিরে যাব) পাঠ করেছে।’ মহান আল্লাহ বলেন, ‘আমার (সন্তানহারা) বান্দার জন্য জান্নাতের মধ্যে একটি গৃহ নির্মাণ কর, আর তার নাম রাখ, ‘বায়তুল হামদ’ (প্রশংসা-ভবন)।”
আপনার এই জীবনের কষ্ট হয়ত আপনার জান্নাতে যাবার পথকে সুগম করে দিচ্ছে। শিশুদের জান্নাতে যাবার অনুমতি রয়েছে। কিন্তু তারা জান্নাতে যাবার আগেই বলবে, ‘আমরা আমাদের পিতামাতাকে দেখতে পাচ্ছি না।’ তার পিতামাতা হয়ত পাপের কারণে জাহান্নামের সুগভীর অতলে পৌঁছে গিয়েছেন কিন্তু এরপরেও তারা তাঁদের পিতামাতাকে জান্নাতে নিতে চায়। যেই শিশুটির মৃত্যুতে আমরা কাঁদতে কাঁদতে বুক ভাসিয়ে দেই, আমরা যদি তাঁর মৃত্যুতে ধৈর্য্যধারণ করি তাহলে সে-ই আমাদের জান্নাতে যাবার কারণ হতে পারে। আল্লাহ শিশুটিকে বলবেন, ‘জান্নাতে প্রবেশ কর।’ তখন শিশুটি বলবে, ‘কিন্তু আমার পিতামাতা কোথায়?’ এরপরে আল্লাহ বলবেন, ‘যাও তোমার পিতামাতার হাত ধরেই জান্নাতে প্রবেশ কর।’
আমাদের নিজেদেরকে বদলে ফেলতে হবে। ইসলাম আমাদেরকে এমনভাবে পরিবর্তন করে যার সুশীতল স্পর্শে বদলে যায় আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি, বদলে যায় আমাদের চারপাশের পৃথিবী।
আমরা দুঃখের সময়ে আল্লাহর দিকেই প্রত্যাবর্তন করব। পুরো দুনিয়ায় মুসলিম উম্মাহর প্রতি নির্যাতনের স্টিম-রোলার চালানো হচ্ছে। এর চেয়ে বড় কষ্টের আর কি হতে পারে? ইরাকে আমাদের ভাইদেরকে দিন-রাত ভীতির চাদরে আচ্ছাদিত করে রাখা হয়েছে। এর পেছনের কারণ কি?
কারণ, আমরা তাদেরকে পরিত্যাগ করেছি, আমরা তাঁদের ব্যাপারে চিন্তা করার ফুরসতও পাই না। শত্রুদের উম্মাহর পেছনে লাগার অর্থ তারা পুরো মুসলিম জাতিকেই তাদের শত্রু বানিয়ে নিয়েছে। তারা নির্বিচারে ইরাকের নিরীহ মুসলিমদের হত্যা করছে। ছয় হাজার শিশু মারা গেল, আমরা আর কত ধৈর্যধারণ করব? আমাদের মুসলিম ভাইয়েরা, সন্তানেরা প্রতি মাসে হাজারে হাজারে মারা যাচ্ছে কেবল অপুষ্টিতে ভুগে। আপনার আপন সন্তানকে দামি দামি খাবার খাওয়াচ্ছেন অথচ আপনার একবেলার খাবারের খরচেই তাঁদের অপুষ্টি ঘুচত। যখন আমরা এরকম বেদনাদায়ক ঘটনা শুনি তখন ধৈর্যধারণ করতে হবে। যখন আমাদের উপরে বোমা ফেলা হয় তখন আমরা ধৈর্যধারণ করি, যখন আমাদের ভাইদের বুকে নির্বিচারে গুলি চালানো হয় তখন আমরা ধৈর্য ধরি, যখন কাশ্মিরে আমাদের ভাইদেরকে আগুনে পুড়িয়ে মারা হয় তখনও আমরা ধৈর্য ধরব। ধৈর্যই আমাদের প্রয়োজন।
নামাজ পড়া, ফজরে জেগে উঠা, আল্লাহর আদেশ পালন করা এমন সকল ক্ষেত্রেই ধৈর্যধারণ করতে হবে। তবে এ ব্যাপারে কথা বলার আগে দেখা যাক কেন আল্লাহ আমাদের উপরে বিপদ ও দুঃখ-কষ্ট আপতিত করেন? প্রথম কারণ হচ্ছে, এভাবে আল্লাহ আপনাকে দেখিয়ে দেন জান্নাতে আপনার অবস্থান, মর্যাদা কেমন হবে। আল্লাহ আপনার জন্মের আগে থেকেই জানতেন আপনার প্রকৃত অবস্থান কোথায় হবে। আল্লাহ জানেন আপনি জান্নাতে কোন অবস্থানে থাকবেন, কিন্তু ধৈর্যধারণের দ্বারা আপনি নিজেকে প্রমাণ করতে পারবেন।
কিয়ামত দিবসে আপনার প্রতিটি কাজের সাক্ষি থাকবে। আমরা যদি সবাই জাকাত প্রদান করি, হজে যাই কিংবা সবাই একই রকম কাজ করে তাহলে আল্লাহ জান্নাতে একজনের উপর অপরজনকে মর্যাদা দান করবেন কিভাবে? যদি মানুষকে বিপদের মধ্যে ফেলে পরিক্ষা না করা হয় কে ধৈর্যশীল তাহলে আল্লাহ মানুষের মর্যাদা বৃদ্ধি করবেন কিভাবে? বিপদে ধৈর্য অবলম্বন আপনার ইমানকে বৃদ্ধি করবে এবং জান্নাতে আরো সম্মানিত অবস্থানে নিয়ে যাবে।
وَ لِیُمَحِّصَ اللّٰہُ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا … ﴿۱۴۱﴾
আর যাতে আল্লাহ পরিশুদ্ধ করেন ইমানদারদেরকে। [সুরা আল ইমরানঃ ১৪১]
কারা পবিত্র? যারা বিপদে ধৈর্যধারণ করে।
لِیَمِیۡزَ اللّٰہُ الۡخَبِیۡثَ مِنَ الطَّیِّبِ … ﴿۳۷﴾
যাতে আল্লাহ পৃথক করেন মন্দকে ভাল হতে। [সুরা আল আনফালঃ ৩৭]
مَا کَانَ اللّٰہُ لِیَذَرَ الۡمُؤۡمِنِیۡنَ عَلٰی مَاۤ اَنۡتُمۡ عَلَیۡہِ حَتّٰی یَمِیۡزَ الۡخَبِیۡثَ مِنَ الطَّیِّبِ ؕ … ﴿۱۷۹﴾
আল্লাহ এমন নন যে, তিনি মুমিনদেরকে (এমন অবস্থায়) ছেড়ে দেবেন যার উপর তোমরা আছ। যতক্ষণ না তিনি পৃথক করবেন অপবিত্রকে পবিত্র থেকে। [সুরা আল ইমরানঃ ১৭৯]
আল্লাহ মুমিনদেরকে একই পরিস্থিতিতে ছেড়ে রাখবেন না। সবসময় সবকিছু আপনার অনুকূলে থাকবে না। কিছু একটা ঘটবে যা আপনার জীবনে প্রতিকূলতা আনবে। কিন্তু কেন আল্লাহ আমাদের প্রতিকূলতার মুখোমুখি করেন?
لِیَمِیۡزَ اللّٰہُ الۡخَبِیۡثَ مِنَ الطَّیِّبِ
যেন আল্লাহ ভালোকে মন্দ থেকে আলাদা করতে পারেন। যারা জান্নাতে সিদ্দিকিনদের সাথে থাকবে জান্নাতের সবচেয়ে উঁচু স্তরে।
اَمۡ حَسِبۡتُمۡ اَنۡ تَدۡخُلُوا الۡجَنَّۃَ وَ لَمَّا یَعۡلَمِ اللّٰہُ الَّذِیۡنَ جٰہَدُوۡا مِنۡکُمۡ وَ یَعۡلَمَ الصّٰبِرِیۡنَ ﴿۱۴۲﴾
তোমরা কি মনে কর যে, তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করবে? অথচ আল্লাহ এখনো জানেননি তাদেরকে যারা তোমাদের মধ্য থেকে জিহাদ করেছে এবং জানেননি ধৈর্যশীলদেরকে। [সুরা আল ইমরানঃ ১৪২]
আপনার কি মনে হয় আপনি জীবনে কোন দুঃখ দুর্দশার মধ্যে দিয়ে না যেয়ে যে সম্মান লাভ করবেন সেই সম্মান সমান হবে সেই লোকের সমতুল্য যে আল্লাহর পথে নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছে, যে জীবনের পদে পদে বিপদে পড়েছে?
বিপদ-আপদের পেছনে দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে আপনাকে এটা দেখানো যে, আপনার জীবন আপনার নিয়ন্ত্রণাধীন নয়। আপনি যদি কোথাও বেড়াতে যান, সেখানে কোন বিপদ-আপদ ছাড়াই একদম নির্ঝঞ্ঝাটে দশটা দিন কাটিয়ে দেন, তাহলে আপনি সেই জায়গাকেই ভালোবেসে ফেলবেন। সবসময় সেখানকার ব্যাপারে কথা বলবেন। বলবেন, সেখানে জীবনের সেরা কিছু দিন কাটিয়ে এসেছেন, আপনি সেই জায়গাকে ছেড়ে আসতে চাইবেন না। জীবনের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা অনেকটা একইরকম, যদি জীবন মাখনের মত মসৃণ হত তাহলে আপনার জন্য এই দুনিয়াকে ছেড়ে আখিরাতে পাড়ি জমানোটাও কষ্টকর হত। কিভাবে আপনি জান্নাতের আকাঙ্ক্ষা করবেন যখন আপনি দুনিয়াকেই জান্নাত বানিয়ে নিয়েছেন? জীবনে কিছু সমস্যা দরকার যা আপনাকে জান্নাতের নিয়ামতের কথা মনে করিয়ে দেবে।
তৃতীয় কারণ হচ্ছে, যেন আপনি আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেন, যেন আল্লাহ আপনাকে তাঁর নিকটে টেনে নেন। চিন্তা করে দেখুন, কখন মানুষ আল্লাহর সবচেয়ে নিকটবর্তী হয়? যখন তাদের সবকিছু ঠিকমত চলছে? মানুষের সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে তারা মসজিদে পর্যন্ত যায় না। আবার যখন তারা বিপদে পড়ে তখন ফোন দিয়ে বলে, ‘শাইখ আমি তো সমস্যায় পড়েছি।’
যখন তাদের আত্মীয় মারা যায়, যখন তার পিতার লাশ তার সামনে পড়ে থাকে, যখন সন্তান চোখের সামনে মারা যায় তখন তার হৃদয়ের এমন কিছু একটা দরকার হয় যা সে আঁকড়ে ধরে থাকতে পারবে, এটাই হয়ে যায় তার দুর্বলতম সময়। আল্লাহ এসব বিপদের মাধ্যমে মানুষকে তাঁর কাছে টেনে নেন। আমরা তো কত মানুষকেই চিনি যারা হিদায়াত পেয়েছেন তাদের আত্মীয় মারা যাবার পরে। আত্মীয়ের মৃত্যু তাদের জীবনকেই বদলে দিয়েছে। এগুলোই সেসব কারণের কয়েকটা যার কারণে আল্লাহ আমাদের বিপদে ফেলেন, পরিক্ষা করেন।