বর্তমানে উম্মাহ একটি ক্রান্তিলগ্ন অতিক্রম করছে। ইসলামের বিরুদ্ধে এবং প্র্যাকটিসিং মুসলিম ও মুসলিমাহদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে যুদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এই পরিস্থিতিতেও দুঃখজনকভাবে কিছু নামধারী মুসলিম কুফর ও কুফফারদের পক্ষ নিয়ে প্র্যাকটিসিং মুসলিম ভাই-বোনদের নিজে ঠাট্টা-উপহাস করে থাকেন, জেনেশুনে না হয় নিজের অজান্তে। কিভাবে কেউ এমন কাউকে উপহাস করতে পারে যে আইশা এবং হাফসা (রা.) এর মত করে নিজেকে উপস্থাপনের চেষ্টা করছে? তারা তো সেসব দেশের নেতৃত্বস্থানীয় লোকদের মত আচরণ করে যারা বলে আমাদের দেশে নিকাবকে আমন্ত্রণ জানানো হবে না, এই হচ্ছে তাদের দেয়া স্বাধীনতা। তাদের দেশের নারীদের নগ্ন বুকে জনসাধারণের মধ্যে চলার স্বাধীনতা আছে, কিন্তু একজন শালীন ও সম্মানিত নারী হিজাব পরে চলতে পারেন না। তারা এই স্বাধীনতার কথা বলে, এই হচ্ছে গণতন্ত্র, এই জাহিলিয়াতের বিষফল। এসব মানুষ সম্পর্কে আল্লাহ বলেন,
وَ لَقَدۡ ذَرَاۡنَا لِجَهَنَّمَ کَثِیۡرًا مِّنَ الۡجِنِّ وَ الۡاِنۡسِ ۫ۖ لَهُمۡ قُلُوۡبٌ لَّا یَفۡقَهُوۡنَ بِهَا ۫ وَ لَهُمۡ اَعۡیُنٌ لَّا یُبۡصِرُوۡنَ بِهَا ۫ وَ لَهُمۡ اٰذَانٌ لَّا یَسۡمَعُوۡنَ بِهَا ؕ اُولٰٓئِکَ کَالۡاَنۡعَامِ بَلۡ هُمۡ اَضَلُّ ؕ اُولٰٓئِکَ هُمُ الۡغٰفِلُوۡنَ ﴿۱۷۹﴾
আর অবশ্যই আমি সৃষ্টি করেছি জাহান্নামের জন্য বহু জিন ও মানুষকে। তাদের রয়েছে অন্তর, তা দ্বারা তারা বুঝে না; তাদের রয়েছে চোখ, তা দ্বারা তারা দেখে না এবং তাদের রয়েছে কান, তা দ্বারা তারা শুনে না। তারা চতুষ্পদ জন্তুর মত; বরং তারা অধিক পথভ্রষ্ট। তারাই হচ্ছে গাফেল। (সূরা আল-আ’রাফ ৭:১৭৯)
কুফর কতটা নোংরা হতে পারে। আমাদের বোনদের পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নির্যাতন করা হয়, আদালতে নেয়া কারণ তারা উম্মে সালামাহ এবং আইশা (রা.) কে নিজেদের আইডল মনে করেছিল। তারা তাদের হেনস্থা করে কেবল এই কারণে যে, নিকাব নাকি সম্মান ও স্বাধীনতাকে বিনষ্ট করে, অথচ তাদের মধ্যে বিন্দুমাত্র সম্মান অথবা স্বাধীনতা নেই।
আমাদের বোনেরা এসব কিছুকেই মুখ বুঁজে সহ্য করেন। কিন্তু এরচেয়েও বড় সমস্যা হচ্ছে কিছু মানুষ উপহাস করার মত কিছু না পেয়ে তারা পুতঃপবিত্র, কষ্টসহ্যকারী এবং সম্মানিত নারীদের উপহাস করে। আপনি কখনো কল্পনা করেছেন একজন নিকাবি দৈনিক কি পরিমাণ সমস্যার মধ্য দিয়ে যায়?
একজন নারী আমেরিকায় নিকাব পরে যদি এত সমস্যার ভেতর দিয়ে যায় তাহলে সেসব এলাকার কি হবে যেখানে কেবল নিকাব পরাই জেলে যাবার কারণ? মানুষের তার উপর কুদৃষ্টি, তার প্রতি ছুঁড়ে দেয়া নিকৃষ্ট বাক্যবাণ, চোখ টিপা এবং ইশারা-ইঙ্গিত তাকে দেখতে হয়, তাকে শুনতে হয় এবং কখনো তো শারীরিক ভাবেও লাঞ্চিত করা হয়। তার ডান দিক থেকে হাসাহাসি ভেসে আসছে, তার বাম দিকে মানুষ বাজেভাবে তাকাচ্ছে, অসম্মানিত করছে। আর এরপর, কিছু নামধারী মুসলিম যে নিজেকে আল্লাহর ভয়ে ভীত বলে নিজেকে দাবি করে সেই আবার এসব নিকাবি বোনদের নিয়ে মজা করে অথবা এমন ভাইকে নিয়ে যে তার দাড়ি ছেড়ে দিয়েছে।
যারা হিজাব বা নিকাব পরেন, তাদের দাড়ি ছেড়ে দেন অথবা টাখনুর উপরে কাপড় পরেন তাদের যদি আপনি সাপোর্ট নাও করেন, মুখটা কি অন্তত তাদের ব্যাপারে চুপ রাখতে পারেন না? অনেক যুবক এ ধরণের হিজাব বা নিক্বাবকে উপহাস করার জোকগুলি নিজেদের মাথায় রাখেন। তারপর যারা এসব ফলো করে তাদেরকে সময় সুযোগমত সেসব জোক দিয়ে উপহাস করে। আপনি যদি নিকাবের সবচেয়ে দুর্বল মতটাকেও (বিচ্ছিন্ন মত) গ্রহণ করেন যা বলে যে মুখ ঢাকা ফরজ নয়, এরপরেও তো আপনি তা নিয়ে ঠাট্টা করতে পারেন না।
যেসব লোক এসব বিষয় নিয়ে মজা করে কেউ যদি তাদের মাকে নিয়ে মজা করত তাহলে সে কি বলত? সে আপনাকে থামিয়ে দিত, বলত মাকে নিয়া মজা করাটা ঠিক নয়। কিন্তু আমাদের সম্মানিত বোনেরা তো উম্মুল মু’মিনীন ও রাসূল (সা্.) এর কন্যাদের অনুসরণ করছেন হিজাব ও নিকাব পরিধানের মাধ্যমে।
یٰۤاَیُّهَا النَّبِیُّ قُلۡ لِّاَزۡوَاجِکَ وَ بَنٰتِکَ وَ نِسَآءِ الۡمُؤۡمِنِیۡنَ یُدۡنِیۡنَ عَلَیۡهِنَّ مِنۡ جَلَابِیۡبِهِنَّ ؕ ذٰلِکَ اَدۡنٰۤی اَنۡ یُّعۡرَفۡنَ فَلَا یُؤۡذَیۡنَ ؕ وَ کَانَ اللّٰهُ غَفُوۡرًا رَّحِیۡمًا ﴿۵۹﴾
আপনি আপনার পত্নীগণ ও কন্যাগণকে এবং মুমিনদের স্ত্রীগণকে বলুন, তারা যেন তাদের চাদরের কিয়দংশ নিজেদের উপর টেনে নেয়। (সূরা আল-আহযাবঃ ৫৯)
একই ব্যাপার দাড়িওয়ালা ভাইদের ব্যাপারে এবং যারা টাখনুর উপরে কাপড় পরেন। এজন্যই কিছু আলেম বলেন ইসলামের কোন বিষয় নিয়ে ঠাট্টা কথা অথবা সরাসরি আল্লাহ এবং তার রাসূল (সা.) এবং কুরআনের আয়াতকে উপহাস করা একই ব্যাপার।
যে নিজের দাড়ি বড় করছে সে নিজেকে কার মত দেখাতে চায়? মুসা, ঈসা, হারুন (আ.)-এর মতো।
তিনি বললেন, ‘হে আমার জননী-তনয়, আমার দাড়ি অথবা মাথার চুল ধরে টেনো না। (সূরা ত্বাহা ২০:৯৪)
ফরজ কোন বিষয় যেমন হিজাব না পরা, নিক্বাব না পরা, দাড়ি বড় না করা ইত্যাদি পালন না করাটাই তো পাপ। কখনো বড়, কখনো ছোট পাপ করলেও সে যদি নিজে মুসলিম হয় এবং সালাত আদায় করে তাহলে ইনশা আল্লাহ সে কোন না কোন পর্যায়ে জান্নাতে যাবে। আল্লাহর ক্ষমাশীলতা তাকে জড়িয়ে ধরবে সবদিক থেকে, রাসূলেরা তার ব্যাপারে শাফায়াত করবেন এবং মুমিন ব্যক্তিরাও তার ব্যাপারে হয়ত সাক্ষী দেবেন। সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতি ঘটলে সে কিছু সময়ের জন্য জাহান্নামে যাবে তার পাপের জন্য এবং তা মওকুফ হলে সে জান্নাতে যাবে। আল্লাহ আমাদের জাহান্নাম থেকে রক্ষা করুন।
যে হিজাব পরিধানকারীকে নিয়ে মজা করে সে এই ক্যাটাগরিতে পড়ে। যারা এই ধরণের উপহাস করেছে তারা মূলত কুফরিই করেছে। তাকফিরের নিয়মের ভেতরেই এটা পড়ে, খুবই স্পর্শকাতর বিষয় এটি, এ ব্যাপারে অনেক প্রতিষ্ঠিত উলামাই বক্তব্য দিয়েছেন।
একটি ঘটনার প্রেক্ষাপট বলা যাক। রাসূল (সা.) তাবুক যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়েছিলেন এবং যাত্রাপথেই তাঁবু গেড়েছেন। একটা গ্রুপ রাসূল (সা.) এর সাথেই ক্যাম্পিং করল আর অন্য গ্রুপ কিছুটা দূরে।
আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) বলেন, “তাবুকের যুদ্ধের সময়, এক লোক জমায়েতের ভিতরে বসে ছিল এবং বলল, ‘আমি আমাদের তিলাওয়াতকারীদের মত আর কাউকে কখনো দেখিনি! তারা সবচেয়ে পেটুক, সবচেয়ে বেশী মিথ্যা বলে আর তারা ময়দানে কাপুরুষের মত আচরণ করে।’
মসজিদে এক লোক বলে উঠল, ‘তুমি মিথ্যাবাদী। তুমি মুনাফিক, আর আমি নিশ্চয়ই আল্লাহর রাসূল (সা.) কে এটা জানাব।’
লোকটার কথা রাসূল (সা.) কে জানানো হল এবং এ ব্যাপারে কুরআনেও আয়াত নাযিল হল।
আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) বলেন, “আমি এর পরে লোকটাকে রাসূল (সা.) এর উটের কাঁধকে আঁকড়ে ধরে রাখতে দেখেছি এবং তার উপর পাথর বর্ষিত হচ্ছিল, সে বলছিল, ‘হে আল্লাহর রাসূল! আমরা তো কেবলই কথার কথা বলছিলাম এবং কৌতুক করছিলাম।’ এবং তখন আল্লাহর রাসূল তিলাওয়াত করতে থাকেন, ‘তোমরা কি আল্লাহর সাথে, তার হুকুম আহকামের সাথে এবং তাঁর রাসূলের সাথে ঠাট্টা করছিলে? (সূরা আত তাওবাহ ৯:৬৫)
তারা ঈমান আনার পরেও অবিশ্বাস করেছে। আল্লাহ তাদের ব্যাপারে কুরআনে বলেনঃ
আর যদি তুমি তাদের জিজ্ঞেস কর, তবে তারা বলবে, ‘আমরা তো কথার কথা বলছিলাম এবং কৌতুক করছিলাম।’ (সূরা আত তাওবাহ :৬৫)
আল্লাহ বলছেন, তোমরা কি আমার আয়াত, আমার কিতাব এবং আমার রাসূলদের নিয়ে হাসি ঠাট্টা করত? দেখুন, এই লোকগুলো কি সরাসরি আল্লাহকে উপহাস করেছে? না। তারা কি সরাসরি কুরআন বা কুরআনের আয়াতকে উপহাস করেছে? না। তারা কুরআন তিলাওয়াতকারীকে নিয়ে মজা করেছে। তাহলে আল্লাহ কেন তাদের নিন্দা করলেন? কেন বললেন তোমরা আমার আয়াত এবং রাসূলদের নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করছ? কেন আল্লাহ কেবল তিলাওয়াতকারীদের কথাই বললেন না। তারা শুধু তিলাওয়াতকারীদের উপহাস করেছিল আর ফলস্বরুপ আল্লাহ বললেন তারা আল্লাহ, তার আয়াত এবং রাসূলদের নিয়ে উপহাস করে। তারা কুরআনের তিলাওয়াতকারীদের নিয়ে মজা করেছে, কিন্তু কুরআনের গুরত্ব এতটাই বেশী যে তারা যেন আল্লাহ, তার কিতাব এবং তার রাসূলকে নিয়েই মজা করেছে। এই বিষয়টিই আল্লাহ আমাদের বোঝাতে চেয়েছেন।
দেখেছেন বিষয়গুলি কতটা ভয়ংকর? এটা কোন খেলনা বিষয় নয়। তারা কুরআনের তিলাওয়াতকারীতে উপহাস করল, আল্লাহ জবাব দিলেন তুমি আল্লাহ, তার রাসূল ও আয়াতকে নিয়ে মজা করছ? আপনি যখন দাড়ির জন্য কাউকে উপহাস করবেন তখন আপনি স্বয়ং আল্লাহ, তার রাসূল ও তার কিতাবকে নিয়েই যেন উপহাস করছেন। আপনি যখন কোন নিকাবীকে নিয়ে উপহাস করবেন তখন আমরা বলব আপনি আল্লাহ, তার কিতাব ও রাসূলকে উপহাস করেছেন।
আল্লাহ বলেনঃ
ছলনা কর না, তোমরা যে কাফের হয়ে গেছ ঈমান প্রকাশ করার পর। (সূরা আত-তাওবাহঃ ৬৬)
ক্ষমা চাওয়ার কথাও চিন্তা করবেন না, কোন অজুহাত দেখাবেন না, আপনারা মুমিন হবার পরে আবার কুফরি করেছেন।
আল্লাহ যাদেরকে মুনাফিক বললেন তারা কিন্তু এই ঘটনার আগে মুনাফিক ছিল না। এই মুনাফিকরা যুদ্ধ করেছে, রাসূল (সা.) এর সাথে থেকেছে যেমন আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই যে মুনাফিক হিসেবে সবার কাছে পরিচিত। তারা বিভিন্ন বিষয়ে উপহাস ও অন্যান্য কারণে মুনাফিক এবং কাফিরে পরিণত হয়েছে। অনেক উলামা বলেন, তারা উপহাসের আগেও মুনাফিকই ছিল কিন্তু এরপরেও তারা রাসূল (সা.) এর সাথেই ছিল। তারা রাসূল (সা.) এর সাথে থেকে যুদ্ধের ময়দানে নিজেদর জীবন ঝুঁকিতে ফেলছিল অথচ সামান্য উপহাসও তাদেরকে অবিশ্বাসীতে পরিণত করেছে। তাহলে তাদের ব্যাপারে কি হবে যারা আল্লাহর পথে এক ফোঁটা ঘামও ঝরায়নি অথচ তারা সুন্নাহ ও ফরজ বিধান নিয়ে উপহাস করে?
এধরণের উপহাসকারীদের সম্পর্কে উলামারা বলেন, তারা শুরুতেই মুনাফিক ছিল না, বরং ইসলামের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে হাসিঠাট্টা তাদের মুনাফিক বানিয়েছে। তারা বিশ্বাস করার পর অবিশ্বাসীতে পরিণত হয়েছে। কেউ কেউ বলেন, তারা মুখের দ্বারা ছিল মুমিন কিন্তু অন্তরের দ্বারা কাফির, অর্থাৎ তাদের সত্ত্বাই মুনাফিক। বাস্তবতা হচ্ছে, এসব লোকেদের মুনাফিক হবার কারণ তাদের হাসিঠাট্টা নয়, তারা আগে থেকেই মুনাফিক, তাদের অন্তর কুফরিতে পূর্ণ যদিও মুখ স্বাক্ষ্য দেয় ঈমানের ।