মানুষ কেবল অভ্যাসের দাস নয়। তাদের মধ্যে আছে নিজেদের বদলানোর, সমৃদ্ধ করার এবং নিজেদের নেতিবাচক আচরণকে অতিক্রম করার সক্ষমতা। এই চমৎকার ও অনুপ্রেরণাদায়ক ধারণাটির সমর্থন পাওয়া যায় কুরআন, হাদিস এবং সালাফদের কথামালায়।
পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ তাআলা মানুষের নিজেদের বদলানোর এবং উন্নত করতে পারার সক্ষমতার কথা উল্লেখ করেছেন।
لَهٗ مُعَقِّبٰتٌ مِّنۡۢ بَیۡنِ یَدَیۡهِ وَ مِنۡ خَلۡفِهٖ یَحۡفَظُوۡنَهٗ مِنۡ اَمۡرِ اللّٰهِ ؕ اِنَّ اللّٰهَ لَا یُغَیِّرُ مَا بِقَوۡمٍ حَتّٰی یُغَیِّرُوۡا مَا بِاَنۡفُسِهِمۡ ؕ وَ اِذَاۤ اَرَادَ اللّٰهُ بِقَوۡمٍ سُوۡٓءًا فَلَا مَرَدَّ لَهٗ ۚ وَ مَا لَهُمۡ مِّنۡ دُوۡنِهٖ مِنۡ وَّالٍ ﴿۱۱﴾
মানুষের জন্য রয়েছে, সামনে ও পেছনে, একের পর এক আগমনকারী প্রহরী, যারা আল্লাহর নির্দেশে তাকে হেফাযত করে। নিশ্চয় আল্লাহ কোন কওমের অবস্থা ততক্ষণ পরিবর্তন করেন না, যতক্ষণ না তারা নিজেদের অবস্থা পরিবর্তন করে। আর যখন আল্লাহ কোন জাতির মন্দ চান, তখন তা প্রতিহত করা যায় না এবং তাদের জন্য তিনি ছাড়া কোন অভিভাবক নেই। [সুরা রাদঃ ১১]
অর্থাৎ “আল্লাহ্ তা’আলা কোন সম্প্রদায়ের অবস্থার পরিবর্তন করেন না, যতক্ষণ স্বয়ং তারাই নিজেদের অবস্থা ও কাজকর্ম মন্দ ও অশান্তিতে পরিবর্তন করে না নেয়।” [বাগভী] তারা যখন নিজেদের অবস্থা অবাধ্যতা ও নাফরমানীতে পরিবর্তিত করে নেয়, তখন আল্লাহ্ তা’আলাও স্বীয় কর্মপন্থা পরিবর্তন করে দেন। এ পরিবর্তন হয় তারা নিজেরা করে, অথবা তাদের উপর যারা কর্তৃত্বশীল তারা করে, নতুবা তাদেরই মধ্যকার অন্যদের কারণে সেটা সংঘটিত হয়। যেমন উহুদের মাঠে তীরন্দাযদের স্থান পরিবর্তনের কারণে মুসলিমদের উপর বিপদ এসে পড়েছিল। ইসলামী শরীআতে এরকম আরও বহু উদাহরণ রয়েছে। তবে আয়াতের অর্থ এ নয় যে, তিনি কারও কোন গুনাহ ব্যতীত তাদের উপর বিপর্যয় দেন না। বরং কখন কখনও অপরের গুনাহের কারণে বিপর্যয় নেমে আসে। যেমন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে প্রশ্ন করা হয়েছিল যে, আমাদের মধ্যে নেককাররা থাকা অবস্থায় কি আমাদের ধ্বংস করা হবে? তিনি বলেছিলেন, ‘হ্যাঁ, যখন অন্যায় অপরাধ ও পঙ্কিলতা বৃদ্ধি পায়। [বুখারী ৩৩৪৬; মুসলিম: ২৮৮০]
সারকথা এই যে, মানুষের হেফাযতের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে ফিরিশতাদের পাহারা নিয়োজিত থাকে; কিন্তু সম্প্রদায় যখন আল্লাহর নেয়ামতের কৃতজ্ঞতা ও তার আনুগত্য ত্যাগ করে পাপাচার, ভ্রষ্টতা ও অবাধ্যতার পথ বেছে নেয়, তখন আল্লাহর গযব ও আযাব তাদের উপর নেমে আসে। এ আযাব থেকে আত্মরক্ষার কোন উপায় থাকে না। অন্য আয়াতে আল্লাহ্ তা’আলা বলেন, “এটা এজন্যে যে, যদি কোন সম্প্রদায় নিজের অবস্থার পরিবর্তন না করে তবে আল্লাহ এমন নন যে, তিনি ওদেরকে যে সম্পদ দান করেছেন, তাতে পরিবর্তন আনবেন: [সূরা আল আনফালঃ ৫৩]
এই আয়াতটিতে যে মূলনীতিটি উঠে এসেছে তা হল, পরিবর্তন আসলে শুরু হয় নিজের মধ্য থেকে। আর যে ব্যক্তি নিজের চিন্তাভাবনা, কাজ ও অভ্যাসকে বদলানোর সক্রিয় প্রচেষ্টা চায় তাদের ভেতর নিজেদের অবস্থাকে বদলে ফেলার দুর্দান্ত শক্তি থাকে।
হাদিসশাস্ত্রেও আলোকপাত করা হয়েছে যে মানুষ কেবল অভ্যাসের দাস নয়।
আমীরুল মুমিনীন আবু হাফস উমার ইবনুল খাত্তাব রা. হতে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেছেন—
سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّم يَقُولُ:
” إنَّمَا الْأَعْمَالُ بِالنِّيَّاتِ، وَإِنَّمَا لِكُلِّ امْرِئٍ مَا نَوَى، فَمَنْ كَانَتْ هِجْرَتُهُ إلَى اللَّهِ وَرَسُولِهِ فَهِجْرَتُهُ إلَى اللَّهِ وَرَسُولِهِ، وَمَنْ كَانَتْ هِجْرَتُهُ لِدُنْيَا يُصِيبُهَا أَوْ امْرَأَةٍ يَنْكِحُهَا فَهِجْرَتُهُ إلَى مَا هَاجَرَ إلَيْهِ”
আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি— “সমস্ত কাজের ফলাফল নির্ভর করে নিয়্যতের উপর, আর প্রত্যেক ব্যক্তি যা নিয়্যত করেছে, তাই পাবে। সুতরাং যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের জন্য হিজরত করেছে, তার হিজরত আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের দিকে হয়েছে, আর যার হিজরত দুনিয়া (পার্থিব বস্তু) আহরণ করার জন্য অথবা মহিলাকে বিয়ে করার জন্য তার হিজরত সে জন্য বিবেচিত হবে যে জন্য সে হিজরত করেছে।” [সহিহ বুখারিঃ ১]
সহিহ বুখারিতে বর্ণিত এই হাদিসটি নিয়ত এবং ইচ্ছাশক্তির গুরত্ব জানান দিচ্ছে, কারণ এগুলোর ওপরই কর্মের পরিণতি নির্ভর করে। এটি বোঝায় যে, মানব আচরণের পেছনে কেবল অভ্যাসই কাজ করে না, বরং এর পেছনে কাজ করার পেছনে নিয়তও ভূমিকা রাখে। এটি বুঝতে পারলে একজন ব্যক্তি তার নিয়তের ওপর নিয়ন্ত্রণ আনতে পারবে। নিয়ত তারা প্রভাবিত হবে তার আচরণও।
আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন,
الأَصَمِّ عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم “ إِنَّ اللَّهَ لاَ يَنْظُرُ إِلَى صُوَرِكُمْ وَأَمْوَالِكُمْ وَلَكِنْ يَنْظُرُ إِلَى قُلُوبِكُمْ وَأَعْمَالِكُمْ ”
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের বাহ্যিক চাল-চলন ও বিত্ত-বৈভবের প্রতি দৃষ্টিপাত করেন না; বরং তিনি দৃষ্টি দিয়ে থাকেন তোমাদের অন্তর ও আমলের প্রতি। [সহিহ মুসলিমঃ ২৫৬৪]
এই হাদিসে বলা হয়েছে যে, মহান আল্লাহ বাহ্যিক কারণ নয় বরং নিয়্যতের ওপর ভিত্তি করে ব্যক্তির বিচার করেন। এখান থেকে বোঝা যায়, কেবল স্বভাব বা বাহ্যিক উপস্থাপনার চেয়ে নিজেদের অন্তরের নিয়্যত অনেক বেশি গুরত্বপূর্ণ।
আবদুল্লাহ ইবনু আমর রা. হতে বর্ণিত। তিনি বলেন,
لَمْ يَكُنْ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم فَاحِشًا وَلَا مُتَفَحِّشًا وَكَانَ يَقُوْلُ إِنَّ مِنْ خِيَارِكُمْ أَحْسَنَكُمْ أَخْلَاقًا
নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অশ্লীল ভাষী ও অসদাচরণের অধিকারী ছিলেন না। তিনি বলতেন, তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তিই সর্বোত্তম যে নৈতিকতায় সর্বোত্তম। [সহিহ বুখারিঃ ৩৫৫৯]
এ ছাড়া সালাফদের শিক্ষাতেও এই বিষয়টির দেখা পাওয়া যায়। সালাফ কারা? আমাদের অতীতের পুণ্যবান প্রজন্ম। তারাও আত্ম-শৃঙ্খলা এবং নেতিবাচক স্বভাবকে অতিক্রম করার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। তারা সর্বদা নিজেদের আত্ম-সমালোচনা করতেন, ইলম অর্জন করতেন এবং সর্বদা নিজেদের নফসকে ইসলাহের পেছনে শ্রম দিতেন। তারা তাওবার শক্তিতে বিশ্বাস করতেন। তারা জানতেন, একজন ব্যক্তি আল্লাহর হিদায়াত ও সহায়তায় নিজেদের বদলে ফেলতে পারে।
বর্ণিত আছে যে, ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা উমর রা. বলেছেন, “তোমাদের হিসাব নেওয়ার আগেই তোমরা নিজেদের হিসাব নাও। নিজের আমল পরিমাপ করো কিয়ামতের দিবসে তোমাদের আমলের পরিমাপ নেওয়ার আগেই।” এই বক্তব্যটি প্রত্যেক ব্যক্তিকে তাদের কাজ, স্বভাব ও চরিত্রের দিকে প্রতিফলন করার ব্যাপারে উৎসাহিত করে এসবের প্রতিফল ভোগ করার পূর্বেই। এটা বোঝায় যে, মানুষের ভেতর আত্ম-নিয়ন্ত্রণ চর্চার সক্ষমতা আছে। তারা নিজেদের উন্নয়ন করার ব্যাপারে উপযুক্ত সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম।
সুতরাং কুরআন, হাদিস ও সালাফের বাণীর আলোকে বলা যায় যে মানুষ কেবল তার অভ্যাসের দাস নয়। বরং তারা উপযুক্ত প্রচেষ্টা চালানোর দ্বারা নিজেদের বদলানোর, উন্নত করার এবং নেতিবাচক স্বভাবকে ডিঙ্গানোর সহজাত ক্ষমতা রাখে। এর পেছনে জ্বালানি হিসেবে কাজ করে নিয়ত এবং আল্লাহর প্রতি অবিচল আস্থা। আত্মোন্নয়নের সম্ভাবনা চিহ্নিত করার দ্বারা একজন ব্যক্তি নেতিবাচক স্বভাবের শেকল থেকে বের হতে পারে, ইতিবাচক স্বভাব গড়তে পারে এবং ইমান ও তাকওয়ার পথে আরো একধাপ এগিয়ে যেতে পারে।