শতকের পর শতক ধরেই ধর্মীয় গ্রন্থ, কবিতার পাশাপাশি ব্যক্তিগত ক্ষেত্রে চিকিৎসক ও দার্শনিকরা হৃৎপিণ্ডকে আমাদের ব্যক্তিত্বের কেন্দ্রবিন্দু হওয়ার ব্যাপারে বিতর্ক করেছেন। তারা একে প্রজ্ঞা ও অনুভূতির উৎস হিসেবে বিবেচনা করেছেন। পৃথিবীর প্রতিটি ভাষা ও সংস্কৃতিতে মানুষ এমন শব্দ ব্যবহার করে, যার সঙ্গে হৃদয় (হৃৎপিণ্ড) সম্পর্কযুক্ত। যেমন : মানুষ ভালোবাসা উপভোগের সময় নিজেদের অনুভূতি প্রকাশের জন্য বলে, ‘মেয়েটি আমার হৃদয় ছিনিয়ে নিয়েছে’ অথবা ‘তুমি রয়েছ আমার হৃদয়ের গহিনে’। কেউ পূর্ণ উদ্যমে কাজ করলে আমরা বলি, ‘সে পূর্ণ মনোযোগের সঙ্গে কাজ করছে’। কারও ব্যাপারে নিরাশা প্রকাশের জন্য বলি, ‘সে হৃদয়হীন হয়ে গেছে’। কারো প্রতি অসন্তোষ প্রকাশে বলি লোকটি ‘কঠোর-হৃদয়’-এর ব্যক্তি। নির্বিকার আচরণকারী কাউকে আমরা ‘ঠান্ডা-হৃদয়’-এর ব্যক্তি বলি। মানুষকে নিজেদের দিকে আঙুল দিয়ে দেখাতে বললে তারা সাধারণত হৃৎপিণ্ডের দিকে অঙ্গুলি-নির্দেশ করে।
কুরআনের আলোকে মানুষের হৃৎপিণ্ড
কুরআন অন্তর বা হৃদয়ের (কালব বা ফুআদ) উল্লেখ কয়েক জায়গায় করেছে। আরবিতে ‘কালাবা’ ক্রিয়ার অর্থ ঘোরানো, ঘুরপাক খাওয়া, উলটো দিকে ঘোরা ইত্যাদি। আরবি ‘ফুআদ’ শব্দের অর্থ ‘উপকার লাভের স্থান’। কুরআন স্পষ্টভাবেই মানবহৃদয়কে বুদ্ধি ও চিন্তার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে উল্লেখ করেছে। কুরআনে মহান আল্লাহ বলেছেন,
﴿لَهُمْ قُلُوْبٌ لَّا یَفْقَهُوْنَ بِهَا﴾
তাদের রয়েছে অন্তর, তা দ্বারা তারা বোঝে না। [সুরা আরাফ : ১৭৯]
সুরা হজে আল্লাহ বলেন,
﴿اَفَلَمۡ یَسِیۡرُوۡا فِی الۡاَرۡضِ فَتَکُوۡنَ لَہُمۡ قُلُوۡبٌ یَّعۡقِلُوۡنَ بِہَاۤ اَوۡ اٰذَانٌ یَّسۡمَعُوۡنَ بِہَا ۚ فَاِنَّہَا لَا تَعۡمَی الۡاَبۡصَارُ وَ لٰکِنۡ تَعۡمَی الۡقُلُوۡبُ الَّتِیۡ فِی الصُّدُوۡرِ﴾
তারা কি জমিনে ভ্রমণ করেনি? তাহলে তাদের হতো এমন হৃদয়, যা দ্বারা তারা উপলব্ধি করতে পারত এবং এমন কান, যা দ্বারা তারা শুনতে পারত। বস্তুত চোখ তো অন্ধ হয় না; বরং অন্ধ হয় বক্ষস্থিত হৃদয়। [সুরা হজ : ৪৬]
অন্য সুরায় আল্লাহ বলেছেন,
﴿ اِنَّ فِیْ ذٰلِكَ لَذِكْرٰی لِمَنْ کَانَ لَهٗ قَلْبٌ اَوْ اَلْقَی السَّمْعَ وَ هُوَ شَهِیْدٌ﴾
এতে অবশ্যই উপদেশ রয়েছে তার জন্য, যার আছে (বোধশক্তিসম্পন্ন) অন্তর কিংবা যে খুব মন দিয়ে কথা শোনে। [সুরা কাফ : ৩৭]
একইভাবে কুরআনের অন্য জায়গায় কাফিরদের অন্তরে সীলমোহর মেরে দেওয়ার ব্যাপারে আলোচনা করা হয়েছে (যেমন ২ : ৬-৭, ৭ : ১০১, ৪ : ১৫৫, ৬৩ : ৩ এবং ১৬ : ১০৬-১০৮)। তাই কুরআন হৃদয়কে বুদ্ধিমান একটি অঙ্গ হিসেবে উল্লেখ করেছে এবং হৃদয়ের অবস্থান হিসেবে বলা হয়েছে বুকের প্রকোষ্ঠের অভ্যন্তরকে। কুরআন ‘কালব’-এর উল্লেখের সময় ভৌত হৃৎপিণ্ডের চেয়েও বাড়তি কিছুর কথা বলছে। ভৌত হৃদয়ের পাশাপাশি আত্মিক যে হৃদয় রয়েছে, সে ব্যাপারটিও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। সুতরাং ভৌত হৃৎপিণ্ডকে মানবদেহ ও আধ্যাত্মিক কলবের মধ্যকার মিথস্ক্রিয়ার কেন্দ্রবিন্দু বলা যেতে পারে, যা দুটিকেই সংযুক্ত করে। ভৌত হৃৎপিণ্ড আত্মার কাছে পৌঁছার প্রবেশপথ হিসেবে কাজ করে। এর অর্থ, ভৌত হৃৎপিণ্ড কেবল পাম্পিং অঙ্গ নয়; এর মধ্যে অবশ্যই বুদ্ধিমত্তার চিহ্ন থাকতে হবে, যা কুরআনের আয়াতগুলোতে বর্ণিত হয়েছে। বুদ্ধিমত্তার ইংরেজি প্রতিশব্দ ‘ইনটেলেক্ট’ (Intellect) এসেছে ল্যাটিন শব্দ ‘ইনটেলেক্টাস’ (Intellectus) থেকে, যা এমন মাধ্যমকে বোঝায়, যার অনুভূতি বোঝার ক্ষমতা রয়েছে।
সুরা আরাফের ১৭৯ নম্বর আয়াতকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সামসময়িক মুসলিম সাইকোলজিস্ট ও দর্শনবিদ আবসার আহমাদ (ড. ইসরার আহমেদের ভাই) বলেছেন,
কুরআনে… ‘কালব’-এর ওপর জোর দিয়ে একে আধ্যাত্মিক সত্য চেনার অতীব সংবেদী অঙ্গ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, যাকে কুরআনের পরিভাষা অনুসারে ‘তাফাক্কুহ’ বলা হয়। ‘কালব’ হৃদয়ের আরবি শব্দ, যা বুদ্ধিমত্তাকেন্দ্রিক বিষয়গুলো অনুধাবন এবং এর পাশাপাশি আবেগ ও অনুভূতি প্রকাশের মাধ্যম; উভয় আসনই দখল করে রেখেছে।
সুন্নাহর আলোকে মানুষের হৃৎপিণ্ড
উপরে বর্ণিত বক্তব্যটি রাসুল সাঃ-এর হাদিসের মাধ্যমে আরও পরিষ্কার হয়ে যায়,
أَلَا وَإِنَّ فِي الْجَسَدِ مُضْغَةً إِذَا صَلَحَتْ صَلَحَ الْجَسَدُ كُلُّهُ وَإِذَا فَسَدَتْ فَسَدَ الْجَسَدُ كُلُّهُ أَلَا وَهِيَ الْقَلْبُ
…জেনে রেখো, শরীরে এমন একটি গোশতের টুকরো আছে, তা যখন ঠিক হয়ে যায়, গোটা শরীরই ঠিক হয়ে যায়। আর তা খারাপ হলে গোটা শরীরই খারাপ হয়ে যায়। জেনে রেখো, সেটি হলো কালব।
এই হাদিসে নিশ্চিতভাবেই হৃৎপিণ্ডের কথা বলা হচ্ছে। এটি দীর্ঘ একটি হাদিসের অংশ। হাদিসটিকে আলিমরা অত্যন্ত গুরুত্বের চোখে দেখেন। কিছু আলিমের মতে, এই হাদিসকে ইসলামের একটি খুঁটি হিসেবেও বিবেচনা করা হয়। হাদিসটির ব্যাখ্যায় ইবনু রজব হাম্বলি রাহ. বলেন, আমরা হৃৎপিণ্ডকে সমস্ত অঙ্গের শাসক হিসেবে ধরতে পারি এবং দেহের অন্য অঙ্গই এর অনুগত সেনা। রাজা পুণ্যবান হলে অন্য সেনাও পুণ্যবান হবে। আর রাজার মধ্যে বিচ্যুতি প্রবেশ করলে সকল সেনা বিচ্যুত হয়ে পড়বে। রোগাক্রান্ত হৃদয়ের কারণে দেহের বিচ্যুতি দ্বারা যেমন শারীরিক রোগ বোঝানো হয়, তেমনি আত্মিক রোগও এর সঙ্গে চলে আসে, যা এই গ্রন্থের পরবর্তী অংশে দেখানো হবে।
একইভাবে কুরআনে আল্লাহ মানুষের চোখ ও কানের সৃষ্টির পাশাপাশি হৃৎপিণ্ড সৃষ্টির বর্ণনা দিয়েছেন,
﴿وَ هُوَ الَّذِیْۤ اَنْشَاَ لَكُمُ السَّمْعَ وَ الْاَبْصَارَ وَ الْاَفْـِٕدَةَ ؕ قَلِیْلًا مَّا تَشْكُرُوْنَ﴾
আর তিনিই তোমাদের জন্য কান, চোখ ও অন্তর সৃষ্টি করেছেন; তোমরা কমই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো। [সুরা মুমিনুন : ৭৮]
﴿الَّذِیۡۤ اَحۡسَنَ کُلَّ شَیۡءٍ خَلَقَہٗ وَ بَدَاَ خَلۡقَ الۡاِنۡسَانِ مِنۡ طِیۡنٍ ۚ ثُمَّ جَعَلَ نَسۡلَہٗ مِنۡ سُلٰلَۃٍ مِّنۡ مَّآءٍ مَّہِیۡنٍ ثُمَّ سَوّٰىہُ وَ نَفَخَ فِیۡہِ مِنۡ رُّوۡحِہٖ وَ جَعَلَ لَکُمُ السَّمۡعَ وَ الۡاَبۡصَارَ وَ الۡاَفۡـِٕدَۃَ ؕ قَلِیۡلًا مَّا تَشۡکُرُوۡنَ﴾
যিনি তাঁর প্রতিটি সৃষ্টিকে সুন্দর করে সৃষ্টি করেছেন এবং কাদামাটি থেকে মানুষ সৃষ্টির সূচনা করেছেন। তারপর তিনি তার বংশধর সৃষ্টি করেন তুচ্ছ তরল পদার্থের নির্যাস থেকে। এরপর তাকে সুঠাম করেছেন এবং তাতে নিজের রুহ থেকে ফুঁকে দিয়েছেন। আর তিনি তোমাদের কান, চোখ ও অন্তর সৃষ্টি করেছেন। তোমরা খুব সামান্যই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো। [সুরা সাজদাহ : ৭-৯]
কুরআনের এসব আয়াতে শ্রবণের ইন্দ্রিয়গত বিষয়টি বর্ণিত হয়েছে এবং যে অঙ্গ এর জন্য দায়ী, তা হলো কান। এর পরে দর্শনের ইন্দ্রিয়গত বিষয়টি বর্ণিত হয়েছে এবং যে অঙ্গ এর জন্য দায়ী, তা হলো চোখ। এর পর হৃৎপিন্ডের কথা বর্ণিত হয়েছে, যা বুদ্ধিমত্তা ও বোধগম্যতার অঙ্গ। শ্রবণ ও দর্শন অঙ্গের মাধ্যমে যে তথ্য প্রবেশ করে, হৃৎপিণ্ড সেটা গ্রহণ ও প্রক্রিয়া করে এবং এরপর সেই তথ্য কাজে লাগিয়ে সত্য-মিথ্যার প্রভেদ নির্ণয় করে।
কুরআনে মানুষের হৃৎপিণ্ডকে আখ্যায়িত করতে ব্যবহৃত একটি শব্দ হচ্ছে ‘কালব’। আরবিভাষায় কালব শব্দের অর্থ ঘোরানো; পরিবর্তন করা; উপুড় করা ইত্যাদি। একটি হাদিসে বর্ণিত; রাসুল সাঃ নিম্নোক্ত দুআ করতেন,
হে অন্তরের পরিবর্তনকারী, আমাদের অন্তরকে আপনার দীনের ওপর সুদৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করুন।
অন্য একটি হাদিসে বর্ণিত রয়েছে; রাসুল সাঃ বলতেন,
অন্তর হলো পালকতুল্য, উন্মুক্ত মাঠে বাতাস তাকে যেদিকে ইচ্ছা উলটাতে-পালটাতে থাকে।
কয়েক দশক আগে ডাক্তাররা বিশ্বাস করতেন, আমাদের হৃৎস্পন্দনের হার অপরিবর্তনশীল (সর্বদা মিনিটে ৭২টি স্পন্দন)। কিন্তু বিজ্ঞান গত ২০ বছরের গবেষণায় আবিষ্কার করেছে, ব্যক্তির মধ্যে হৃৎস্পন্দনের হারের পরিবর্তন নিয়মিতভাবে দেখা যায়। হৃৎস্পন্দনের হারের পরিবর্তন বলতে হৃৎপিণ্ডে প্রতি স্পন্দনের মাধ্যমে পরিবর্তনের পরিমাপকে বোঝানো হয়। হৃৎপিণ্ডকে রিদম মনিটরের সঙ্গে সংযুক্ত করলে দেখা যায়, কেবল বসে থেকে কোনো কাজ না করলেও হৃৎপিণ্ডের স্পন্দনে পরিবর্তন আসে। গবেষণা থেকে দেখা গেছে, কারও হৃৎস্পন্দনের পরিবর্তনের হারে যদি কিছুটা বিঘ্ন আসে, তাহলে সেটা কোনো রোগের নিদর্শন হতে পারে; অথবা এটা ইঙ্গিত করতে পারে যে, ভবিষ্যতে এই ব্যক্তির স্বাস্থ্যগত সমস্যা হবে। এ ছাড়া হার্টম্যাথ ইনস্টিটিউটের গবেষকরা আবিষ্কার করেছেন, হৃৎস্পন্দনের অবিরত পরিবর্তনের মাধ্যমে হৃৎপিণ্ড মস্তিষ্কের সঙ্গে ভিন্ন ভিন্ন পরিস্থিতি বা অভিজ্ঞতার ক্ষেত্রে প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে যোগাযোগ রক্ষা করে চলে। বিখ্যাত আলিম আবদুল্লাহ ইবনু মুবারাক রাহ., যার হৃদয় পূর্ণ ছিল ইলম ও প্রজ্ঞার আলোয়—তিনি হৃৎস্পন্দনের পরিবর্তনের ব্যাপারে ১২০০ বছর আগেই বলেছিলেন,
আল্লাহর বন্ধুদের অন্তর নিস্পন্দ ও স্থির হওয়া অনুমোদিত নয়।