মানুষের তার রবের ইবাদতে তৃপ্তি খুঁজে পাওয়া, তার দাসত্বে আনন্দ খুঁজে পাওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। বান্দা যদি সত্যিকার অর্থে এই তৃপ্তির স্বাদ পায়, সে বাকি সব ভোগ বিলাস ভুলে যাবে। আল্লাহ যদি তার বান্দাকে পূর্ণাঙ্গ দাসত্বের পথ প্রদর্শন করেন, পরিপূর্ণ নম্রতা ও ভক্তি সহকারে নিজেকে সঁপে দেওয়ার পথ দেখিয়ে দেন, তবে সেটা সকল নেয়ামতের চেয়ে উত্তম নেয়ামত। একজন দাসের জন্য এর চেয়ে মূল্যবান উপহার আর হতে পারে না।
মুআয রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বলেছেন,
يَا مُعَاذ، واللهِ، إِنِّي لَأُحِبُّكَ، ثُمَّ أُوصِيكَ يَا مُعَاذُ، لاَ تَدَعَنَّ فِي دُبُرِ كُلِّ صَلاَة تَقُول: اللَّهُمَّ أَعِنِّي عَلَى ذِكْرِكَ، وَشُكْرِكَ، وَحُسْنِ عِبَادَتِكَ
“হে মুআয! আল্লাহর শপথ! আমি অবশ্যই তোমাকে ভালবাসি। অতঃপর হে মুআয আমি তোমাকে উপদেশ দিচ্ছি যে, তুমি প্রত্যেক সালাতের শেষে: (অর্থ) “হে আল্লাহ! তুমি আমাকে তোমার যিকির, শুকরিয়া (কৃতজ্ঞতা) এবং সুন্দর ইবাদত করতে সাহায্য কর।” দোআটি পড়া অবশ্যই ত্যাগ করবে না”। [সুনানু নাসায়ি]
আমাদের উম্মতের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর কসম খেয়ে বললেন যে, তিনি একজনকে ভালোবাসেন এবং তিনি শুধুমাত্র আল্লাহর ওয়াস্তে তাঁকে ভালোবাসেন। এরপর তিনি তাকে একটি উপহার দিলেন।
একজন ভালোবেসে ভালোবাসার মানুষকে উপহার দিচ্ছেন। কত চমৎকার সেই হাবিব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আর কতইনা চমৎকার সেই সাহাবী রাদিয়াল্লাহু আনহু।
তিনি তাকে বললেন, তুমি কখনোই প্রতিটি সালাতের পর এই দোয়াটি করতে ভুলবেনা। দোয়াটি কি?
اَللّٰهُمَّ اَعِنِّيْ عَلٰى ذِكْرِكَ وَشُكْرِكَ وَحُسْنِ عِبَادَتِكَ.
অর্থ: হে আল্লাহ! আমাকে সাহায্য করুন আপনাকে স্মরণ করতে আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ হতে এবং সুন্দরভাবে আপনার ইবাদত করতে। (সুনানে আবু দাউদ, হাদীস: ১৫২২)
বান্দাকে যদি হুসনু ইবাদাহ অর্থাৎ সুন্দর ইবাদতের রিযিক দেয়া হয়, তার অন্তর খুলে যাবে, তার হৃদয় প্রশান্তি পাবে এবং সে সেই ইবাদতে বরকত লাভ করবে।
একজন বান্দার উপর নানা ধরনের বালা মুসিবত আসতে পারে যদি সে ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহর হক আদায় না করতে পারে।
ইবাদতে অটুট থাকা মানে দুনিয়া এবং আখিরাতের সব বিষয়ে সাফল্য পাওয়া। কিন্তু এর জন্য দৃঢ় প্রচেষ্টা করতে হবে, ধৈর্য ধারণ করতে হবে, হেদায়েতের আলোর পথ অনুসরণ করতে হবে। শুধুমাত্র ইচ্ছে পোষণ করে বসে থাকলে চলবে না বরং নিজের সামনে এক নূর রাখতে হবে। যে নূর আল্লাহ সপ্তম আসমানের ওপর থেকে নাযিল করেছেন। এই নূর ব্যতীত আর কোন নূর নেই। এটাই একমাত্র নূর যার কাছে যেতে হবে। এভাবেই ইবাদতে এহসান বা শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করতে হবে।
তখনই আপনি মুখ এবং হৃদয় দিয়ে আল্লাহু আকবার বলতে পারবেন। সালাতে প্রবেশ করে আপনি এমন এক অবিশ্বাস্য আনন্দ অনুভব করবেন যা জীবনের সকল তৃপ্তিকে ছাড়িয়ে যাবে। এমনও হয়ে থাকে যে সালাত শেষ করার পর মানুষ ভুলেই যায় যে, সে সালাতের আগে কী করছিল!
কাউকে যদি আল্লাহর ইবাদতে পরিপূর্ণতা দান করা হয়, সে বাকি সব কিছু ফেলে শুধুমাত্র ইবাদতেই মশগুল থাকবে। আল্লাহ আমাদেরকে সব বাদ দিয়ে শুধু আপনাতেই মশগুল রাখুন যেন আমরা আর কোন কিছুর উপর নির্ভরশীল না হই এবং আমাদের সব বিষয়ে আপনি খুশি হয়ে যান। আল্লাহ আমাদের এই দোয়াটি কবুল করুন।
তিনি যদি আপনাকে শুধুমাত্র তাঁকেই নিয়ে মশগুল থাকার তাওফিক দান করেন তবে আপনার সব ব্যাপারে তিনি যথেষ্ট হবেন। যখন বান্দা কেবলামুখী হয়ে “আল্লাহু আকবার” বলে, সে যেন এক অন্য জগতে প্রবেশ করে। গোটা দুনিয়া তার ধন-সম্পদ, তার সন্তান-সন্ততি, তার শত্রু, তার বন্ধুবান্ধব, তার সুখ-দুঃখ, সবকিছু বিলীন হয়ে যায়, যখন সে বলে “আল্লাহু আকবার”।
নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “হে বেলাল! সালাত দ্বারা আমাদের প্রশান্তি দাও। সালাতকে আমার চক্ষু শীতলকারী বানানো হয়েছে।”
আল্লাহর কসম এমন একটা দিনও পার হবেনা যে, আপনি সেদিনের ফরজ সালাতগুলো আদায় করেছেন আর দিন শেষে আপনি কল্যাণ বা বরকত অনুভব করছেন না। নিজের মাঝে পরিবার পরিজনের মাঝে, সম্পদের মাঝে, সন্তান-সন্ততির মাঝে এমনভাবে এ বরকত আসবে যা আপনি কোনদিন কল্পনাও করেননি। কিন্তু বেশিরভাগ মানুষই এটা উপলব্ধি করে না।
প্রথমত, হুসনুল ইবাদাহ বা সুন্দর ইবাদত করা সম্ভব হবে না যদি না আপনি যার ইবাদত করছেন তাকে ভালোভাবে জানেন।
ইবাদত হল আল্লাহ কে তা উপলব্ধি করা, তার মাহাত্ম্য উপলব্ধি করা, তার সুন্দর নামসমূহ জানা, যার সবটাই তার মহান কিতাবের মাঝে রয়েছে। তবে আপনাকে মন দিয়ে পড়তে হবে। আপনাকে তাদাব্বুর ও তাফাক্কুর সহকারে পড়তে হবে অর্থাৎ গভীর ভাবে চিন্তা করে পড়তে হবে।
আজ থেকেই মনস্থির করুন, আল্লাহর কোন সিফাত বা বৈশিষ্ট্য পেলেই সে সম্পর্কে জেনে নিবেন। আল্লাহর কোনো সিফাত উল্লেখ হলেই নিজেকে এর সত্যিকারের অর্থ ও তাৎপর্য সম্পর্কে প্রশ্ন করুন। এবং আপনি আল্লাহর আসমা ওয়াস সিফাত সম্বন্ধে যত জ্ঞানই অর্জন করেন না কেন তা এক প্রকাণ্ড মহাসাগরের মাঝে একটি ফোঁটা মাত্র।
আমরা অবহেলায় ডুবে আছি। বান্দা কখনোই ইবাদতে সৌন্দর্য অর্জন করতে পারবে না যতক্ষণ না সে সত্যিকার অর্থে জানে সে কার ইবাদত করছে। এ কারণেই আল্লাহকে যারা সব চেয়ে ভালো জানেন তারা হলেন নবী-রাসুলগণ এবং তারাই হলেন আল্লাহর সবচেয়ে পরিপূর্ণ ইবাদতকারী।
দ্বিতীয় যে বিষয়টি আল্লাহর ইবাদতে সাহায্য করে তা হলো, এটা অনুভব করা যে প্রতিটি ইবাদতের পিছনে আল্লাহর গভীর প্রজ্ঞা ও জ্ঞান রয়েছে।
আল্লাহ তাঁর পবিত্র কিতাব ও নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সুন্নাতের মাধ্যমে তাঁকে ইবাদত করার পথ দেখিয়ে দিয়েছেন। যখন আপনি প্রতিটি ইবাদতের পিছনের বিরাট হিকমত উপলব্ধি করতে পারবেন, এর পেছনের পরিপূর্ণ অন্তর্দৃষ্টি উপলব্ধি করতে পারবেন, আপনি ভালোবেসে সেই ইবাদতটি করতে পারবেন। কারণ আল্লাহর বিধানের চেয়ে নিখুঁত আর কিছুই নেই।
ইবাদতের পিছনে, জিকির আজকারের পিছনে, শারীরিক ইবাদতের পিছনে চূড়ান্ত হিকমত রয়েছে। এই ইবাদতগুলোর বিধান প্রতিষ্ঠা করেছেন অসীম ইলম ও সমগ্র দুনিয়ার মালিক মহান আল্লাহ। যিনি আল হাকিম, যিনি আল আলিম, আল খবির, আল বাসির।
এই উপলব্ধি আপনাকে আপনার ইবাদত সুন্দর করার চেষ্টা করতে উদ্বুদ্ধ করবে, তার আনুগত্যে একনিষ্ঠ হতে সাহায্য করবে।
তৃতীয় যে জিনিসটি আল্লাহর ইবাদতে সাহায্য করে তা হল, ভাল মানুষদের সঙ্গ, সলেহীনদের সঙ্গ; যারা আল্লাহকে ভয় করে। যারা যখন আপনাকে ভাল কাজ করতে দেখে তখন আপনাকে সাহায্য করে।
তাদের নিকটে থাকার চেষ্টা করুন। আল্লাহর হুকুমের পর তারাই আল্লাহর ইবাদতে আপনাকে সাহায্য করার শ্রেষ্ঠ মাধ্যম।
চতুর্থ যে জিনিসটি বান্দাকে সাহায্য করে তা হলো, কখনোই নিজের ইবাদতের অবস্থান নিয়ে সন্তুষ্ট হয়ে না যাওয়া।
বান্দাকে সালাতে খুশু প্রদান করা হলে সে আরো বেশি খুশু চাইবে, আরো বেশি সওয়াব চাইবে। সে যেন ছোট ছোট প্রচেষ্টায় সন্তুষ্ট না হয়ে যায় বরং তার উচিত আল্লাহর দৃষ্টিতে উচ্চ অবস্থানের দিকে ধাবিত হওয়া।
সে কখনো কোনো ইবাদত সম্পর্কে জানতে পারলে সেটা সুন্দরভাবে সম্পন্ন করার চেষ্টা করে এবং আল্লাহর অসীম বরকত উপলব্ধি করে এবং এরপর সে আল্লাহর কাছে আরও বেশি চায়। যে বান্দাকে আল্লাহর ইবাদতের পরিপূর্ণতা দান করা হয়েছে, সে তার ইবাদতের বিষয়ে থেমে থাকে না বরং আল্লাহর কাছে আরো বেশি পাওয়ার আশায় চাইতে থাকে। এজন্যই তো মহান আল্লাহ বলেন, “এবং আল্লাহর কাছে তার মেহেরবানী চাইতে থাকো।”
অবশেষে আল্লাহর ইবাদতে যে বিষয়টি সাহায্য করে তা হল, সেসব কিছু থেকে দূরে থাকা যা আপনাকে আল্লাহর থেকে দূরে সরিয়ে নেয়।
আপনি কখনোই আল্লাহকে অমান্য করা অবস্থায় তার ইবাদত করতে পারবেন না। আপনি সুন্দরভাবে আল্লাহর ইবাদত করতে পারবেন না যদি আপনার বাবা-মায়ের অবাধ্যতা করেন, অথবা আত্মীয়তার সম্পর্ক বিনষ্ট করেন, বা মুসলিম ভাই বোনদের ব্যাপারে গীবত করেন, নামীমাহ করেন, অন্যের হক নষ্ট করেন।
অতএব যা কিছু আল্লাহ অপছন্দ করেন তা থেকে দূরে থাকতে হবে। যদি কলব সালিম অর্থাৎ পরিশুদ্ধ অন্তর এবং সুন্দর চরিত্র সহকারে আল্লাহর সাথে সাক্ষাত করতে চান। যেন আপনার এবং আপনার রবের রহমতের মাঝে অন্য কিছু এসে না দাঁড়ায়। মানুষের ক্ষতি করা, তাদের হক নষ্ট করা হলো আল্লাহর রহমত পাওয়ার সবচেয়ে বড় বাধাগুলোর একটি।
হে আল্লাহ! আমাদের বৃদ্ধি করে দিন হ্রাস করে দিবেন না। নিয়ামত দান করুন, বঞ্চিত করবেন না।
اَللّٰهُمَّ اَعِنِّيْ عَلٰى ذِكْرِكَ وَشُكْرِكَ وَحُسْنِ عِبَادَتِكَ.
অর্থ: হে আল্লাহ! আমাকে সাহায্য করুন আপনাকে স্মরণ করতে আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ হতে এবং সুন্দরভাবে আপনার ইবাদত করতে।
اَلْحَمْدُ لِلّٰهِ رَبِّ الْعَالَمِيْنَ. وَالصَّلَاةُ وَالسَّلَامُ عَلٰى سَيِّدِ الْمُرْسَلِيْنَ وَعَلٰى اٰلِه وَصَحْبِه اَجْمَعِيْنَ
অর্থ: সকল প্রশংসা আল্লাহ পাকের জন্য, যিনি জগতসমূহের প্রতিপালক এবং রহমত ও শান্তি বর্ষিত হোক রাসূলগণের সর্দারের উপর এবং তাঁর পরিবারবর্গ ও সকল সাথীগণের উপর।
[জবাবটি শায়খ উসাইমিনের কাছ থেকে নেওয়া হয়েছে]