অধিকাংশ প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির রাতে সাত থেকে নয় ঘন্টা ঘুমের দরকার হয়। তাহলে আরো এক বা দুই ঘন্টা বেশি ঘুমালে সমস্যা কোথায়? ৯ ঘন্টার বেশী ঘুমালে তো তেমন সমস্যা হওয়ার কথা না, তাই না? উঁহু, ভুল করছেন। বড় সড় ভুল। বেশী ঘুমানো সিরিয়াস সমস্যার লক্ষণ হতে পারে। তাহলে ঠিক কতখানি ঘুমালে বলা যাবে যে আপনি অনেক বেশী ঘুমিয়েছেন?
একজন ব্যক্তির ঠিক কত ঘন্টা ঘুমানো দরকার এটা ব্যক্তিভেদে ভিন্ন হবে। তবে কোনো প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির দিনে নয় ঘন্টার বেশী ঘুমানো উচিত নয়। এর বেশী ঘুমানো হলে সেটাকে অতিরিক্ত ঘুমানো বলা হবে। অতিরিক্ত ঘুমানোর পেছনে কিছু কারণ থাকতে পারে। আমরা নিচে অতিরিক্ত ঘুমানোর সম্ভাব্য ১০ কারণ তুলে ধরছিঃ
আপনি কি কখনও নিজেকে জিজ্ঞাসা করেছেন “কেন আমি এত ঘুমাচ্ছি?” বা “কেন আমার সবসময় ক্লান্ত-ক্লান্ত লাগে?” অথবা আপনি কি এমন কাউকে চেনেন যিনি অতিরিক্ত ঘুম ঘুম অনুভব করেন এবং সারাদিন ঘুম ঘুম করে কাটিয়ে দেন বা রাতে অনেক সময় নিয়ে ঘুমান? তাহলে এই লেখাটি পড়া চালিয়ে যান। শীঘ্রই পেয়ে যাবেন আপনার উত্তর, ইনশাআল্লাহ।
অতিরিক্ত ঘুমানো কি সাধারণ বিষয়?
যদি আপনার মনে হয়, আপনি অনেক বেশী ঘুমান, তাহলে জেনে রাখুন এটা বেশ সাধারণ একটা বিষয়। আপনিই একমাত্র এই সমস্যায় ভুগছেন না। অতিরিক্ত ঘুমানো বেশ সাধারণ। এমনকি দেখা গেছে যে প্রায় ৪০ শতাংশ মানুষই কখনো কখনো হাইপারসমনিয়ার লক্ষণ প্রকাশ করে।
হাইপারসমনিয়া হচ্ছে অতিরিক্ত ঘুম ঘুম লাগা বা অতিরিক্ত ঘুমানোর মেডিকেল পরিভাষা। এর লক্ষণ হচ্ছে, দিনের বেলা অত্যন্ত ঘুম ঘুম লাগা অথবা রাতের বেলা গড় সময় অর্থাৎ সাত থেকে নয় ঘন্টার বেশী ঘুমানো। যারা হাইপারসমনিয়ার রোগী তারা যে কোনো জায়গায় যে কোন সময়ে ঘুমিয়ে পড়তে পারে। এমনকি কাজের মধ্যেও তারা ঘুমিয়ে পড়ে। কেউ কেউ তো ড্রাইভিং করতে চেয়েও ঘুমিয়ে যায়, যা বেশ ঝুঁকিপূর্ণ বটে।
অতিরিক্ত ঘুম পেলে কি আমার উদ্বিগ্ন হওয়া উচিত?
আপনি কি জানেন, রাতে ভাল ঘুম হওয়া স্বাস্থ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ও অপরিহার্য। তবুও অত্যধিক ঘুমানো মানেই সেটা উদ্বেগের কারণ নয়। মাঝে মাঝে ক্লান্তির কারণে এক বা দুই রাত অতিরিক্ত ঘুম হতে পারে। তবুও ক্লান্তির অনুভূতি যদি আপনার জীবনকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে, তাহলে আপনার লাইফস্টাইলে নির্দিষ্ট পরিবর্তন আনা উচিত অথবা নির্দিষ্ট ঘুমের ব্যাধিগুলো পরীক্ষা করা উচিত।
কারণ ঘুমের রোগগুলো হাইপারসোমনিয়ার একটি সম্ভাব্য কারণ হতে পারে। এবং এসব আপনার ঘুমকে প্রভাবিত করবে। আপনার সামগ্রিক স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা ও জীবনমানকে প্রভাবিত করবে। অল্প ঘুমের সাথে ঘুমের রোগের সম্পর্ক রয়েছে। তবুও স্লিপ অ্যাপনিয়া এবং নারকোলেপসির পেছনে হাইপারসোমনিয়া বা অতিরিক্ত ক্লান্তি দায়ী হতে পারে। হাইপারসোমনিয়া গুরুতর স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরি করে এবং এটি ডায়াবেটিস, হৃদরোগ এবং মৃত্যুর মতো বিভিন্ন সমস্যা তৈরী করতে পারে।
আপনার যদি অতিরিক্ত ঘুম পায়, তাহলে নিচের কারণগুলো পড়ে দেখুন। হয়তো এই কারণগুলো আপনার অতিরিক্ত ঘুমের জন্য অবদান রাখতে পারে। সব কারণই উদ্বেগের কারণ নয়। আবার কিছু কারণ গুরুতরও হতে পারে।
অতিরিক্ত ঘুম এবং ক্লান্তির কারণ
হাইপারসোমনিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তিরা দিনে চরম তন্দ্রাচ্ছন্নতায় ভোগেন এবং রাতে অস্বাভাবিক দীর্ঘ সময় ধরে ঘুমান। অতিরিক্ত ঘুমের পেছনে বিভিন্ন কারণ থাকতে পারে। আপনি কেন অনেক বেশি ঘুমান তার দশটি কারণ হচ্ছে:
১. ঘুমের রোগ
আপনি হয়তো নারকোলেপসি বা স্লিপ অ্যাপনিয়ায় ভুগছেন। স্লিপ অ্যাপনিয়া (ওএসএ) বেশ কমন একটি রোগ। এটি শনাক্ত না করা হলে রাতের বেলা আপনার শ্বাসনালী বন্ধ হয়ে যাবে বা আপনি সেখানে বাধা অনুভব করবেন। এর ফলে সারা রাত আপনার ঘুমে ব্যাঘাত ঘটবে। এসব ব্যাঘাতের কারণে ঘুম ভাঙ্গার কথা হয়তো আপনার মনে থাকবে না। কিন্তু আপনি অধিকাংশ সকালেই জেগে উঠবেন খিটখিটে মন-মেজাজ আর ক্লান্তি নিয়ে। সারাদিন আপনি উদ্বিগ্ন থাকবেন।
২. অটোনোমিক ডিসফাংশন
হয়তো আপনার অটোনোমিক নার্ভাস সিস্টেম বা স্বয়ংক্রিয় স্নায়ুতন্ত্রে কোন সমস্যা রয়েছে। কিছু ঘুমের রোগ আছে যেমন অবস্ট্রাকটিভ স্লিপ অ্যাপনিয়া এবং হাইপোভেন্টিলেশন সিনড্রোম ইত্যাদি কার্ডিওভাসকুলার এবং শ্বাসনালির নিয়ন্ত্রণসংক্রান্ত সমস্যার সাথে জড়িত।
৩. মাদক ও অ্যালকোহলের অপব্যবহার
অ্যালকোহল পান করলে REM sleep অর্থাৎ গভীর ঘুম বাধাগ্রস্ত হয়। এই সময়টাতেই আপনার দেহ নিজেকে চাঙ্গা অবস্থায় নিয়ে যায়। কিন্তু আপনার দেহ এই পর্যায় অতিক্রম করতে না পারলে এটি ক্লান্ত থাকে। এটা চলতে থাকলে ঘুমের কোয়ালিটি অনেক কমে যায়। পাশাপাশি আরো অনেক স্বাস্থ্যগত প্রতিক্রিয়া দেখা যায়।
৪. অপর্যাপ্ত ঘুম
কাজের রুটিনে পরিবর্তন হলে, স্কুল শেষে নতুন কোনো দায়িত্ব যোগ হলে অথবা সম্পর্ক নিয়ে টানাপোড়েন বা সমস্যার তৈরী হলে অনেকেরই ঘুম চলে যায় বা ঘুমের কোয়ালিটি কমে যায়।
৫. শারীরিক আঘাত বা সমস্যা
শারীরিক সমস্যা যেমন টিউমার, মাথায় আঘাত, বা কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের আঘাত। যাদের মস্তিষ্কে আঘাতজনিত সমস্যা রয়েছে ৩০-৭০% ক্ষেত্রে তাদের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটতে পারে। মাথায় আঘাত লাগার পরে অনিদ্রা, ক্লান্তি এবং তন্দ্রা তন্দ্রা লাগার অভিযোগ পাওয়া যায়।
৬. মানসিক অবস্থা
হতাশা, উদ্বেগ এবং মানসিক অবস্থার কারণে একজন ব্যক্তি রাতে জাগ্রত থাকতে পারে। এতে সে দিনের বেলায় ঘুমপ্রবণ হতে পারে।
৭. মেডিকেল কন্ডিশন
হাঁপানি, দীর্ঘস্থায়ী ব্যথা, এসিড রিফ্লাক্স, মানসিক অসুস্থতা এবং অন্যান্য যন্ত্রণাদায়ক অবস্থা ঘুমকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করতে পারে।
৮. ওষুধ
ক্যাফেইন, ঘুমের বড়ি এবং অ্যান্টিহিস্টামিন ঘুমকে ব্যাহত করতে পারে। ক্যাফেইন মস্তিষ্কের রিসেপ্টরকে অ্যাডেনোসিন শোষণ করতে বাধা দেয়। অ্যাডিনোসিনের কারণে ঘুম ভালো হয়। ক্যাফেইনের হাফ লাইফ বা অর্ধায়ু তিন থেকে পাঁচ ঘণ্টা। তবুও এটা আপনার সিস্টেমে দীর্ঘ সময় থাকতে পারে।
৯. টাইম জোন বা সময় অঞ্চল
জেট ল্যাগ হল সার্কাডিয়ান রিদম স্লিপ ডিসঅর্ডারের একটি উদাহরণ। টাইম জোন বা সময় অঞ্চল পরিবর্তন হলে আমাদের দেহ নতুন পরিবেশের 24-ঘন্টা আলো এবং অন্ধকার চক্রের সাথে সাথে সাথে মানিয়ে নিতে পারে না। এমনকি কয়েক ঘন্টার পার্থক্যও এই সমস্যা তৈরী করতে পারে।
১০. পরিবেশগত কারণ
অস্বস্তিকর ম্যাট্রেস, অতিরিক্ত তাপ বা ঠান্ডা বা বিরক্তিকর শব্দের কারণে আপনার ঠিকমতো ঘুম হয় না। আপনি বিছানায় যাওয়ার সময় আপনার শরীর উষ্ণতা ছড়িয়ে দেয় এবং ঘুমের সময় শরীর ঠান্ডা হয়ে যায়। ঘরের যে তাপমাত্রা শারীরিক আরাম বা শরীরের ঠাণ্ডা হওয়ার ক্ষমতাকে ব্যাহত করে তা ঘুমে হস্তক্ষেপ করে।
এগুলো দিনের বেলা অতিরিক্ত ঘুমের কয়েকটি কারণ, তবে তালিকাটি আসলে আরও বড়। আপনি হয়তো অতিরিক্ত ঘুমের এসব প্রভাব অনুভব করছিলেন, কিন্তু সঠিক কারণ আপনার জানা ছিল না। অত্যধিক ঘুমের কারণ শনাক্ত করার জন্য জীবনযাত্রার অভ্যাস, শারীরিক স্বাস্থ্য, মানসিক এবং/অথবা মানসিক অবস্থা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে।
আপনি ঘুমের একটা জার্নাল রাখুন। এটা আপনি ডাক্তারের সাথে শেয়ার করতে পারেন। এতে সঠিক চিকিৎসা পেতে আপনার সুবিধা হবে। জার্নালে আপনি যেসব বিষয় লিখবেন তা হলঃ
- আপনি কখন ঘুমে যান
- ঘুমাতে কতক্ষণ লাগে আপনার
- ঘুমের মধ্যে আপনি কয়বার জেগে ওঠেন
- আপনার ঘুমের গুণগত মান
- ঘুম থেকে ওঠার পর আপনার কেমন লাগে
- সারাদিন আপনার কেমন লাগছে
এসব তথ্য আপনি ডাক্তারকে দিলে আপনার অবস্থা সংশোধন ও শনাক্ত করা তার জন্য সহজ হবে। এতে আপনার সুস্বাস্ট্য অর্জন করা সহজ হবে। আপনিও ফিরে পাবেন আগের সেই এনার্জি।