কবরের আজাব, কবরের ফিতনা বড়ই কঠিন এক বিষয়। সত্যিই অনেক কঠিন এক বিষয়। মানুষ নানা কারণে কবরে মারাত্মক আজাবের সম্মুখীন হবে। এমনকি মানবিক দৃষ্টিতে ছোট কারণেও কঠোর আজাবের সম্মুখীন হওয়া লাগতে পারে।
আবু বাকারহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন,
مَرَّ النَّبِيُّ ـ صلى الله عليه وسلم ـ بِقَبْرَيْنِ فَقَالَ “ إِنَّهُمَا لَيُعَذَّبَانِ وَمَا يُعَذَّبَانِ فِي كَبِيرٍ أَمَّا أَحَدُهُمَا فَيُعَذَّبُ فِي الْبَوْلِ وَأَمَّا الآخَرُ فَيُعَذَّبُ فِي الْغِيبَةِ ”
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুটি কবর অতিক্রম করার সময় বলেনঃ নিশ্চয় এই দুই কবরবাসীকে শাস্তি দেয়া হচ্ছে এবং তাদেরকে কোন কঠিন অপরাধের জন্য শাস্তি দেয়া হচ্ছে না। এদের একজনকে পেশাবের (অসতর্কতার) কারণে শাস্তি দেয়া হচ্ছে এবং অপরজনকে গীবত করার কারণে শাস্তি দেয়া হচ্ছে। [সুনানু ইবনু মাজাহঃ ৩৪৯]
ইবনু আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেন,
أَنَّ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم مَرَّ عَلَى قَبْرَيْنِ فَقَالَ “ إِنَّهُمَا يُعَذَّبَانِ وَمَا يُعَذَّبَانِ فِي كَبِيرٍ أَمَّا هَذَا فَكَانَ لاَ يَسْتَتِرُ مِنْ بَوْلِهِ وَأَمَّا هَذَا فَكَانَ يَمْشِي بِالنَّمِيمَةِ ”
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একবার দু’টি কবরের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তখন তিনি বললেন, এই দু’টি কবরে আযাব হচ্ছে। আর তা বিরাট কোন কিছুর জন্য নয়। এই জন তো পেশাব থেকে নিজেকে বাঁচাত না আর ঐ জন চোগলখুরী করে বেড়াত। [সুনানু তিরমিজিঃ ৭০]
মহান আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম আমাদেরকে কবরের আজাব থেকে আশ্রয় চাইতে বলেছেন।
জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রাঃ) বর্ণনা করেন,
عَنْ جَابِرِ بْنِ عَبْدِ اللهِ قَالَ دَخَلَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَوْمًا نَخْلًا لِبَنِي النَّجَّارِ فَسَمِعَ أَصْوَاتَ رِجَالٍ مِنْ بَنِي النَّجَّارِ مَاتُوا فِي الْجَاهِلِيَّةِ يُعَذَّبُونَ فِي قُبُورِهِمْ فَخَرَجَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَزِعًا فَأَمَرَ أَصْحَابَهُ أَنْ يَتَعَوَّذُوا مِنْ عَذَابِ الْقَبْرِ
14152 مسند أحمد بن حنبل
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম একদিন আল-নাজ্জার গোত্রের একটি খেজুর বাগানে প্রবেশ করলেন এবং তিনি গোত্রের লোকদের কবর থেকে তাদের গলার আওয়াজ শুনতে পেলেন যারা জাহেলী যুগে মারা গিয়েছিল। তাদের শাস্তি দেওয়ার আওয়াজ শুনতে পেলেন তিনি। নবীজি সালাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম চমকে বেরিয়ে গেলেন এবং সাহাবীদেরকে নির্দেশ দিয়ে বললেন, “তোমরা কবরের আযাব থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাও।” [মুসনাদু আহমাদঃ ১৪১৫২]
ইয়ালা ইবনে সিয়াবাহ বর্ণনা করেছেন:
তিনি নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর যুগে বসবাস করতেন [অর্থাৎ তিনি সাহাবি ছিলেন]। তারা এমন একটি কবরের কাছে এলেন যার কবরবাসীকে শাস্তি দেওয়া হচ্ছিল। রাসুল সালাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘নিশ্চয়ই এই ব্যক্তি মানুষের গোশত খেত [অর্থাৎ লোকটি মানুষের গিবত করত]।” [আল মুজামুল আওসাতঃ ২৪৩৪]।
আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত,
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ كُنَّا نَمْشِي مَعَ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَمَرَرْنَا عَلَى قَبْرَيْنِ فَقَامَ فَقُمْنَا مَعَهُ فَجَعَلَ لَوْنُهُ يَتَغَيَّرُ حَتَّى رَعَدَ كُمُّ قَمِيصِهِ فَقُلْنَا مَا لَكَ يَا نَبِيَّ اللَّهِ قَالَ مَا تَسْمَعُونَ مَا أَسْمَعُ قُلْنَا وَمَا ذَاكَ يَا نَبِيَّ اللَّهِ قَالَ هَذَانِ رَجُلانِ يُعَذَّبَانِ فِي قُبُورِهِمَا عَذَابًا شَدِيدًا فِي ذَنْبٍ هَيِّنٍ قُلْنَا مِمَّ ذَلِكَ يَا نَبِيَّ اللَّهِ قَالَ كَانَ أَحَدُهُمَا لا يَسْتَنْزِهُ مِنَ الْبَوْلِ وَكَانَ الآخَرُ يُؤْذِي النَّاسَ بِلِسَانِهِ وَيَمْشِي بَيْنَهُمْ بِالنَّمِيمَةِ
831 صحيح ابن حبان
আমরা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে হাঁটছিলাম, এমন সময় আমরা দুটি কবরের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের কবরের পাশে দাঁড়ালেন এবং আমরাও তাঁর সাথে দাঁড়ালাম। তার মুখের রঙ ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হল। একপর্যায়ে সেটা তার কাপড়ের হাতার মত সাদা হয়ে গেল। আমরা বললাম, হে আল্লাহর রাসুল, কী হয়েছে?
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, “আমি যা শুনছি তা তোমরা শুনতে পাচ্ছ না।”
আমরা বললাম, “আপনি কি শুনছেন, হে আল্লাহর নবী?”
নবীজি বললেন, “এই দুই ব্যক্তিকে একটি তুচ্ছ বিষয়ের জন্য তাদের কবরে কঠোর শাস্তি দেওয়া হচ্ছে।”
আমরা বললাম, “সেটা কি, ইয়া রাসুলুল্লাহ?”
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বললেন, “তাদের মধ্যে একজন তার জামাকাপড় প্রস্রাব থেকে পবিত্র রাখার ব্যাপারে যত্নশীল ছিল না। অন্যজন তার জিহ্বা দিয়ে লোকদের ক্ষতি করত, তাদের মধ্যে গিবত করত।” [সহিহ ইবনু হিব্বানঃ ৮৩১]
আল্লাহর জমিনে এমন কিছু বান্দা রয়েছেন যাদেরকে আল্লাহ তাআলা কবরের এই কঠিন ফিতনা থেকে হেফাজত করবেন। আজ আমরা সহিহ হাদিসের আলোকে এমন কতিপয় মুমিন এবং তাদের মহান আমলের কথা আলোচনা করব। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমাদের ওই সব সৌভাগ্যবান’ বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত করুন যারা কবরের আজাব থেকে নাজাত পাবেন।
এক. শহীদ
আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের যেসব মহান বান্দা কবরের আজাব ও ফিতনা থেকে মুক্তি পাবেন তাদের অন্যতম হলেন সহীদ। সুনানুত তিরমিজিতে বর্ণিত একটি সহিহ হাদীসে এসেছে।
মিকদাম ইবনু মাদিকারিব রা. হতে বর্ণিত আছে। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
لِلشَّهِيدِ عِنْدَ اللَّهِ سِتُّ خِصَالٍ يُغْفَرُ لَهُ فِي أَوَّلِ دَفْعَةٍ وَيَرَى مَقْعَدَهُ مِنَ الْجَنَّةِ وَيُجَارُ مِنْ عَذَابِ الْقَبْرِ وَيَأْمَنُ مِنَ الْفَزَعِ الأَكْبَرِ وَيُوضَعُ عَلَى رَأْسِهِ تَاجُ الْوَقَارِ الْيَاقُوتَةُ مِنْهَا خَيْرٌ مِنَ الدُّنْيَا وَمَا فِيهَا وَيُزَوَّجُ اثْنَتَيْنِ وَسَبْعِينَ زَوْجَةً مِنَ الْحُورِ الْعِينِ وَيُشَفَّعُ فِي سَبْعِينَ مِنْ أَقَارِبِهِ
শহীদের জন্য আল্লাহ তাআলার নিকট ছয়টি পুরস্কার বা সুযোগ আছে। তার প্রথম রক্তবিন্দু পড়ার সাথে সাথে তাকে ক্ষমা করা হয়, তাকে তার জান্নাতের বাসস্থান দেখানো হয়, কবরের আযাব হতে তাকে মুক্তি দেওয়া হয়, সে কঠিন ভীতি হতে নিরাপদ থাকবে, তার মাথায় মর্মর পাথর খচিত মর্যাদার টুপি পরিয়ে দেওয়া হবে। এর এক একটি পাথর দুনিয়া ও তার মধ্যকার সবকিছু হতে উত্তম। তার সাথে টানা টানা আয়তলোচনা বাহাত্তরজন জান্নাতী হুরকে বিয়ে দেওয়া হবে এবং তার সত্তরজন নিকটাত্মীয়ের জন্য তার সুপারিশ কুবুল করা হবে। [সুনানু তিরমিজি” ১৬৬৩]
সুবহানাল্লাহ। শহিদের এত বেশী, এত বেশি ফজিলত। শাহাদাত আসলেই একটি ইর্ষণীয় সাফল্য, মুমিনের জন্য এক সুমহান মর্যাদা। মুমিন জীবনের মহা গৌরব এটি। মহান আল্লাহ সবাইকে এই মহান মর্যাদা অর্জন করার তাওফিক দিন।
দুই. মুরাবিত (আল্লাহর রাস্তার পাহারাদার)
কবরের আজাব থেকে নাজাত লাভকারী আরো একজন সৌভাগ্যবান মুমিন হলেন সেই ব্যক্তি যিনি মুরাবিত যিনি আল্লাহর রাস্তায় লড়াইরত অবস্থায় মারা যান। সুনানুত তিরমিজি ও মুসনাদু আহমাদসহ আরও অনেক হাদীস গ্রন্থে সহিহ সনদে বর্ণিত হয়েছে।
ফাযালা ইবনু উবাইদ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
كُلُّ مَيِّتٍ يُخْتَمُ عَلَى عَمَلِهِ إِلاَّ الَّذِي مَاتَ مُرَابِطًا فِي سَبِيلِ اللَّهِ فَإِنَّهُ يُنْمَى لَهُ عَمَلُهُ إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ وَيَأْمَنُ مِنْ فِتْنَةِ الْقَبْرِ ” . وَسَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم يَقُولُ ” الْمُجَاهِدُ مَنْ جَاهَدَ نَفْسَهُ ”
প্রত্যেক মৃত ব্যক্তির সকল প্রকার কাজের উপর সীলমোহর করে দেওয়া হয় (কাজের পরিসমাপ্তি ঘটে)। কিন্তু আল্লাহ তাআলার রাস্তায় পাহারাদানরত অবস্থায় যে লোক মৃত্যুবরণ করে কিয়ামত পর্যন্ত তার কর্মের সাওয়াব বাড়ানো হতে থাকে এবং তিনি কবরের সকল ফিতনা হতে নিরাপদে থাকেন। আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছিঃ যে লোক নিজের প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে জিহাদ করে সে-ই আসল মুজাহিদ। [সুনানুত তিরমিজিঃ ১৬২১]
তিন. জুমাবারে মৃত্যুবরণকারী
যে ব্যক্তি জুমাবারে মৃত্যুবরণ করে তার কবরের আজাব মাফ হওয়ার সুসংবাদ হাদিসে এসেছে।
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,
যে মুসলিম জুমাবার দিনে বা রাতে মৃত্যুবরণ করে, সে কবরের ফিতনা থেকে নাজাত পায়। [আল-মুজামুল কাবির লিত তাবারানিঃ ১৪২৫১; হাদিসটি তার অন্যান্য তুরুক সহ সহিহ; অন্তত হাসান]
চার. পেটের অসুখে মৃত্যুবরণকারী
যে ব্যক্তি পেটের অসুখে মৃত্যুবরণ করে তাকেও আল্লাহ তাআলা দয়া করে কবরের আজাব থেকে মুক্তি দেন। সুনানুন নাসায়িতে একটা সহিহ হাদিসে এসেছে, রাসুল সাল্লাল্লাহু ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন,
যে ব্যক্তি পেটের অসুখে মারা যায় তাকে কবরে আযাব দেয়া হবে না। [সুনানুন নাসায়িঃ ২০৫২]
আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমাদের সবাইকে কবরের আজাব থেকে নিরাপদ রাখুন, আমাদের শাহাদাতের মর্যাদা দান করুন, আল্লাহ রাস্তায় পাহাড়াদার হওয়ার তাওফীক দিন, আমাদের জুমাবারে মৃত্যু নসিব করুন। আর আল্লাহ না করুন, কখনো যদি পেটের অসুখ হয় তবে সবর করার তাওফিক দিন, আমিন।