আল্লাহ এই বিশ্ব জাহানের স্রষ্টা, প্রতিপালক এবং মালিক । তিনি অমর, অজয়, অক্ষয়। তিনি রিযিক দেন, নেন। না। সমগ্ৰ বিশ্ব জাহানের ওপর তাঁর নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত। তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ। তিনি “আস-সামাদ।” অর্থাৎ তিনিই একমাত্র সত্তা যিনি অমুখাপেক্ষিতার গুণাবলীর সাথে পুরোপুরি সংযুক্ত। আবার যেহেতু তিনি “আস-সামাদ” তাই তার একাকী ও স্বজনবিহীন হওয়া অপরিহার্য। কারণ এ ধরনের সত্তা একজনই হতে পারেন, যিনি কারো কাছে নিজের অভাব পূরণের জন্য হাত পাতেন না, বরং সবাই নিজেদের অভাব পূরণের জন্য তাঁর মুখাপেক্ষী হয়। আসমান-জমিন তথা সৃষ্টিলোক তিনি এককভাবে পরিচালনা করেন। চন্দ্র-সূর্য, গ্রহ-নক্ষত্র থেকে শুরু করে বিশ্ব প্রকৃতির সর্বত্র যে এক সুনিয়ম সুশৃঙ্খল পরিবেশ বিদ্যমান এর মূল রহস্য এখানেই। সৃষ্টিজগতের সবকিছুই মহান স্রষ্টার নির্ধারিত বিধান মেনে চলছে । সবকিছুই মহান আল্লাহর পবিত্রতা, শ্রেষ্ঠত্ব ও সার্বভৌমত্বের ঘোষণা দিয়ে যাচ্ছে । মানুষ ছাড়া সৃষ্টিজগতের সবাই এমনকি ফেরেশতাগণও এভাবে সদা সর্বক্ষণ আল্লাহর হুকুম তথা নির্ধারিত নিয়ম অনুসরণ করে চলতে বাধ্য। মানুষের দৈহিক অবয়ব, দেহের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, প্রতিটি কোষ আল্লাহর নির্ধারিত নিয়মের অধীন। ব্যতিক্রম হলেই অশান্তি দেখা দেয়। মহান আল্লাহর পরিচয় সবচেয়ে সুন্দরভাবে উঠে এসেছে সুরা ইখলাসে।
قُلۡ هُوَ اللّٰهُ اَحَدٌ ۚ﴿اَللّٰهُ الصَّمَدُ ۚ﴿۲﴾لَمۡ یَلِدۡ ۬ۙ وَ لَمۡ یُوۡلَدۡ ۙ﴿۳﴾وَ لَمۡ یَکُنۡ لَّهٗ کُفُوًا اَحَدٌ ﴿۴﴾۱﴾
বল, তিনিই আল্লাহ, এক-অদ্বিতীয়। আল্লাহ কারো মুখাপেক্ষী নন, সকলেই তাঁর মুখাপেক্ষী। তিনি কাউকে জন্ম দেননি এবং তাঁকেও জন্ম দেয়া হয়নি। আর তাঁর কোন সমকক্ষও নেই। [সুরা ইখলাসঃ ১-৪]
বিভিন্ন বর্ণনায় এসেছে যে, মুশরিকরা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আল্লাহ তাআলার বংশপরিচয় জিজ্ঞেস করেছিল, যার জওয়াবে মহান আল্লাহ সুরা ইখলাস নাজিল করেন। কোন কোন বর্ণনায় এসেছে, মুশরিকরা আরও প্রশ্ন করেছিল- আল্লাহ তাআলা কিসের তৈরী, স্বর্ণরৌপ্য অথবা অন্য কিছুর? এর জওয়াবেও সূরাটি অবতীর্ণ হয়েছে।
তিনি কাউকেও জন্ম দেননি এবং তাকেও জন্ম দেয়া হয়নি – এখানে যারা আল্লাহর বংশ পরিচয় জিজ্ঞেস করেছিল, এটা তাদের জওয়াব। সন্তান প্ৰজনন সৃষ্টির বৈশিষ্ট্য- স্রষ্টার নয়। অতএব, তিনি কারও সন্তান নন এবং তাঁর কোন সন্তান নেই। আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, মহান আল্লাহ বলেন, “আদম সন্তান আমার উপর মিথ্যারোপ করে অথচ এটা তার জন্য উচিত নয়। আর আমাকে গালি দেয়, এটাও তার জন্য উচিত নয়। তার মিথ্যারোপ হচ্ছে, সে বলে আমাকে যেভাবে প্রথমবার সৃষ্টি করেছেন সেভাবে তিনি কখনও আমাকে পুনরায় সৃষ্টি করবেন না। অথচ দ্বিতীয় সৃষ্টি প্রথম সৃষ্টির চেয়ে কোনভাবেই কঠিন নয়। আর আমাকে গালি দেয়ার ব্যাপারটি হলো, সে বলে আল্লাহ সন্তান গ্ৰহণ করেছেন। অথচ আমি একক, সামাদ, জন্মগ্রহণ করিনি এবং কাউকে জন্মও দেইনি। আর কেউই আমার সমকক্ষ নেই।” [বুখারী: ৪৯৭৪]
আল্লাহর দুনিয়া পরিচালনার প্রাকৃতিক নিয়ম কেবল মানব-সত্তার জন্য কার্যকর নয়। গোটা সৃষ্টিলোকের জন্য আল্লাহর নির্ধারিত প্রাকৃতিক বিধান স্বয়ং আল্লাহ কার্যকর করছেন। সৃষ্টিজগতের ছোট বড় কোন সৃষ্টির পক্ষেই তা লঙ্ঘন করার সুযোগ নেই, অবকাশ নেই । কিন্তু মানব-সত্তার জন্য আল্লাহ তায়ালা যে বিধান দিয়েছেন, সে বিধান মানা না মানার ব্যাপারে তাকে স্বাধীনতা বা স্বায়ত্তশাসন দেয়া হয়েছে। মানুষের ফ্রি-উইল বা ইচ্ছা-স্বাধীনতা আছে। তাই মানব সমাজের শান্তি-শৃঙ্খলার জন্য খোদা প্রদত্ত সে বিধান মানুষের সমাজে কার্যকর করার দায়িত্বও মানুষের উপরই অর্পিত হয়েছে। মানুষকে আল্লাহ দুনিয়ায় তার খলিফা হিসেবে প্রেরণ করেছেন। তাই মানুষকেও আল্লাহর খলিফার ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হবে। তাকে যে স্বাধীনতা ও স্বায়ত্তশাসন ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে এটার অপব্যবহার না করে আল্লাহর বিধান মানা ও কার্যকর করার প্রচেষ্টার মাধ্যমেই মানুষ আল্লাহর খলিফার মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হয়, প্রতিষ্ঠিত হয়। সে আশরাফুল মাখলুকাতের সম্মানজনক আসনে। কিন্তু মানুষ পক্ষান্তরে আল্লাহ প্রদত্ত স্বাধীনতা স্বরূপ আমানতের খেয়ানত করে সে যদি তার মনগড়া বা তার মতই অন্য কোন মানুষের মনগড়া নিয়মনীতি আদর্শ বা মতবাদের অনুসরণ করে তাহলে সে স্বীয় কৃতকর্মের কারণে নিক্ষিপ্ত হয় ধ্বংসের অতল তলে । সৃষ্টির সেরা মানুষ নেমে যায় পশুত্বের কাতারে । এখানেই শেষ নয়। সে নেমে যায় পশুর চেয়েও নিকৃষ্ট স্তরে ।
এভাবে মানুষের অবস্থা বিচার করলে দেখা যায়, মাটির এ পৃথিবীতে মানু অসহায়, বড় বিপজ্জনক অবস্থায় প্রেরিত হয়েছে। মানুষের স্রষ্টা তাকে বড় পরীক্ষায়, কঠিন পরীক্ষায় ফেলেছেন। কঠিন এই অবস্থা, এই কঠিন পরীক্ষা অতিক্রম করেই তো সে নিজকে এই দুনিয়ায় আল্লাহর খলিফারূপে প্রতিষ্ঠিত করবে । মহান আল্লাহ নিজেই মানুষের অসহায় অবস্থার একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক তুলে ধরেছেন মানুষের এ পৃথিবীতে পাঠাবার মুহূর্তে ।
“যাও তোমরা পরস্পরে একে অপরের শত্রুরূপে, এই পৃথিবীতে তোমরা কিছুদিন বসবাস করবে, আর কিছু দ্রব্যসামগ্রীও ভোগ করবে।” ছোট্ট এই কথা ক’টির মধ্যে সূক্ষ্ম অথচ সুস্পষ্ট ইঙ্গিত আছে।
১. মাটির এ পৃথিবীতে মানুষের জীবনটা চিরস্থায়ী নয় বরং ক্ষণস্থায়ী, ক্ষণস্থায়ীও নয় এটা একটা অন্তর্বর্তীকালীন অবস্থা মাত্র। এরপর মহান স্রষ্টার কাছেই ফিরে যেতে হবে।
এই ক্ষণস্থায়ী জীবনে মানুষের ভোগ দখলে যা কিছু বিষয় সম্পদ থাকবে তাও ক্ষণস্থায়ী এবং নগণ্য মাত্র। আল্লাহর দেয়া স্বাধীন ইচ্ছা-শক্তির অপব্যবহারের ফলে এই ক্ষণস্থায়ী জীবনের ক্ষণস্থায়ী স্বার্থ নিয়ে পরস্পরের মধ্যে শত্রুতার জন্ম নিবে, মানুষের ব্যক্তি-সমাজ জীবনের শান্তি বিনষ্ট হবে। প্রকৃতপক্ষে এটাই মানুষের জন্য চরম অসহায় অবস্থা ।
মানুষের স্রষ্টা আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাকে এ অবস্থা থেকে রক্ষা করে চিত্র শাস্তি ও কল্যাণের পথে পরিচালিত করবার জন্য তার নিজস্ব পরিকল্পনার একটা ব্যবস্থা করেছেন । মানুষকে দুনিয়ায় পাঠাবার মুহূর্তে সেই ব্যবস্থার কথাও তাকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে:
تلْنَا اهْبِطُوا مِنْهَا جَمِيعًا، فَإِمَّا يَأْتِيَنَّكُمْ مِنِي هُدًى فَمَنْ تَبِعَ هُدَايَ فَلَا خَوْفٌ
“অতঃপর আমার পক্ষ থেকে তোমাদের প্রতি হেদায়েত পৌঁছাবে, যারা সেই হেদায়েতের অনুসরণ করবে তাদের ভয়ের কোন কারণ নেই, কারণ নেই দুশ্চিন্তারও।” (বাকারা : ৩৮)
মানুষকে অসহায় অবস্থা থেকে বাঁচাবার জন্য, আল্লাহ প্রদত্ত শ্রেষ্ঠ মর্যাদায় তাকে প্রতিষ্ঠিত করার বা প্রতিষ্ঠিত রাখার জন্য এই হেদায়েত আল্লাহ তায়ালা পাঠিয়েছেন যুগে যুগে তার কিছু প্রিয় বান্দার মাধ্যমে, ইসলামের ইতিহাসে নবী এবং রসূল নামে পরিচিত। আর উক্ত নবী-রসূলদের কাছে যে হেদায়েত, এসেছে কিতাব বা সহিফা আকারে, নবী বা রসূলগণ আনীত সেই সব কিতাব বা সহিফাসমূহের উদ্দেশ্য ছিল মানুষের সমাজে আল্লাহ প্রদত্ত দীন বা বিধান প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শাস্তি, কল্যাণ, ন্যায় ও ইনসাফ কায়েম করা। আল্লাহর ভাষায়-
لَقَدْ أَرْسَلْنَا رُسُلَنَا بِالْبَيني وَأَنزَلْنَا معمر الكتب وَالْمِيزَانَ ليقوم النَّاسُ
“আমরা যুগে যুগে নবী এবং রসূল পাঠিয়েছি এবং নাজিল করেছি কিতাব ও মীযান, মানুষের সমাজে ইনসাফ কায়েমের জন্য।” (হাদীদ : ২৫)
এ উদ্দেশ্যে মানুষের প্রতি প্রেরিত আল্লাহ তায়ালার সর্বশেষ নবী হলেন মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ সা. এবং সর্বশেষ কিতাব হলো আল-কোরআন। আল্লাহ তায়ালা বিভিন্ন যুগে নবী-রসূল ও কিতাব পাঠাবার যে উদ্দেশ্য ব্যক্ত করেছেন সর্বশেষ নবী এবং সর্বশেষ কিতাব তা থেকে ব্যতিক্রম বা বিচ্ছিন্ন কিছু নয় বরং যেহেতু এরপর আর কোন নবী আসবে না, আর কোন কিতাবও আসবে না, সুতরাং মানুষের সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা, মুক্তি ও কল্যাণ তথা ন্যায়-ইনসাফ প্রতিষ্ঠার ব্যাপক হেদায়েত আল-কোরআনে থাকা আরো বেশি যুক্তিসঙ্গত। মহান আল্লাহর পবিত্র কিতাব সর্বশেষ গ্রন্থ আল-কোরআনের যথার্থ পরিচয় জানা আল্লাহর বান্দাদের পরিচিত করবার একটি ক্ষুদ্র প্রয়াস মাত্র। আল্লাহ আমাদের তাঁর কিতাবের যথার্থ পরিচয় জানার তৌফিক দিন, তৌফিক দিন উক্ত কিতাবের যথার্থ সমঝ বুঝ লাভ করে সে অনুযায়ী আমল করার।