আমরা সবাই প্রোডাক্টিভ হতে চাই। অলসতার জগত থেকে বেরিয়ে আসতে চাই। নিজের জীবনে কিছু অর্জন করতে চাই। প্রোডাক্টিভ হওয়ার অর্থ কি? কম সময়ে অনেক বেশী অর্জন করাই প্রোডাক্টিভিটি। যেন অল্প সময়ে বেশী কাজ শেষ করে প্রিয় কাজগুলোতে সময় ব্যয় করতে পারেন। যদি অফিসের কাজ তাড়াতাড়ি শেষ করতে পারেন তাহলে প্রিয়তমা স্ত্রীকে বেশী সময় দিতে পারবেন, বা বাবা-মার খেদমত করতে পারবেন, বাসাবাড়ির কাজ করতে পারবেন। তাহলে কীভাবে হবেন প্রোডাক্টিভ? আসুন জেনে নিই কিছু প্রোডাক্টিভিটি টিপস।
#১ লক্ষ্যের বদলে সিস্টেমে ফোকাস করুন
ছোটবেলা থেকেই আমাদের বিভিন্ন লক্ষ্য অর্জনের কথা বলা হয়, লক্ষ্য অর্জন করতে সেখানো হয়। যেমন, পরীক্ষায় ভালো করতে হবে, স্কুলের ভালো দলে খেলতে হবে, অন্যদের চেয়ে এগিয়ে থাকতে হবে, চাকুরিতে প্রমোশন পেতে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। আপনি অনেক পরিশ্রম করেন যেন আপনি নিজের লক্ষ্য অর্জন করতে পারেন।
কিন্তু অধিকাংশ লক্ষ্যই আসলে আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকে। লক্ষ্য অর্জনের ব্যাপারে আমাদের সীমিত নিয়ন্ত্রণ আছে। ভবিষ্যত, অন্য মানুষের ক্রিয়াকলাপ, অর্থনীতি, পরিবেশ বা অন্যান্য পরিবর্তনশীল জিনিসগুলোর ওপর আমাদের নিয়ন্ত্রণ নেই। এবং ঠিক এই কারণেই আমাদের ফোকাস লক্ষ্যের পরিবর্তে সিস্টেমের দিকে হওয়া উচিত। সিস্টেমে আপনি কেবল সেসব বিষয়ের ওপর ফোকাস করেন যা আপনার নিয়ন্ত্রণে থাকে।
সিস্টেম দ্বারা মূলত একই প্রক্রিয়া বারবার করার (পুনরাবৃত্তিমূলক প্রক্রিয়া) কথা বোঝাচ্ছি। ব্লগে ৫০০ জন সাবস্ক্রাইবার পাওয়া একটা লক্ষ্য, কিন্তু দৈনিক ৫০০ শব্দ লেখা মূলত পুনরাবৃত্তিমূলক প্রক্রিয়া। ম্যারাথন দৌড়ানো লক্ষ্য, কিন্তু সপ্তাহে চার দিন ৩০ মিনিট করে দৌড়ানো পুনরাবৃত্তিমূলক প্রক্রিয়া। ১০ কেজি ওজন কমানো একটা লক্ষ্য। কিন্তু নিজের ডায়েট পরিবর্তন করে আরো স্বাস্থ্যকর খাবার দিয়ে বানানো ডায়েট চার্ট অনুসরণ করা হচ্ছে সিস্টেম।
লক্ষ্য অর্জনের বদলে মনোযোগ দিন প্রচেষ্টার ওপর। সামান্য অর্জনই দিন দিন বড় হতে হতে বড় আকার ধারণ করবে। আর এখান থেকেই এসেছে কমপাউন্ড ইফেক্টের আইডিয়া।
#২ কম্পাউন্ড ইফেক্টের সদ্ব্যবহার করুন
কমপাউন্ড ইফেক্ট হচ্ছে ছোট ছোট কাজ করা যা সময়ের পরিক্রমায় বড় ধরণের পরিবর্তন আনতে পারে। বলা হয়ে থাকে ছোট ছোট বালুকণা, বিন্দু বিন্দু জল, গড়ে তোলে মহাদেশ সাগর অতল। কমপাউন্ড ইফেক্টও অনেকটা যেন এমনই। মনে করুন, আপনার একটা মাটির ব্যাংক আছে। আপনি সেখানে প্রতিদিন ১০ টাকা করে রাখেন। প্রথমে এই ১০ টাকা তেমন মনে না হলেও এই ব্যাংকের টাকা কিন্তু বাড়তে থাকবে। আস্তে আস্তে একদিন এই ব্যাংকটা টাকায় ভরে যাবে। এটাই কমপাউণ্ড ইফেক্ট। এখান থেকে বোঝা যায়, ছোট ছোট কাজ যদি নিয়মিত করা হয় তাহলে অনেক বড় ফলাফল পাওয়া যায়।
কমপাউন্ড ইফেক্টের বৃদ্ধির হার সূচকীয়। এটা বোঝার জন্য একটা উদাহরণ দেখা যায়।
আপনি যদি দৈনিক কয়েক পৃষ্ঠা করে পড়েন, তাহলে বই ও বইয়ের শিক্ষার মধ্যে কানেকশন তৈরী করতে শুরু করবেন।
ওয়ারেন বাফেট বলেন, দৈনিক ৫০০ পৃষ্ঠা বই পড়ুন। জ্ঞান এভাবেই কাজ করে। জ্ঞান বাড়তে থাকে, কমপাউন্ড ইন্টারেস্টের মতো।”
আপনি প্রতি সপ্তাহে দুই তিনটা করে আর্টিকেল প্রকাশ করলে কিছুদিনের ভেতরেই আপনার আর্টিকেলের ক্যাটালগ দাঁড়িয়ে যাবে। আপনার পাঠক পড়ার মতো অনেকগুলো আর্টিকেল পাবে। ফলে আপনার ওয়েবসাইটে সময় কাটানোর মতো উপায়ও বাড়তে থাকবে।
আপনি যদি চাকুরিক্ষেত্রে দৈনিক অন্তত একটা কাজ অটোমেশন করেন বা অন্যকে দিয়ে করিয়ে নেন, তাহলে অন্যান্য কাজে ফোকাস করার মতো ফ্রি টাইম পাবেন আপনি। আপনি এভাবে কাজ করতে থাকলে দিনদিন আপনার প্রোডাক্টিভিটি বাড়তে থাকবে। আপনি আরো দ্রুততার সাথে কাজ করতে পারবেন। এতে আপনি নতুন সমস্যা সমাধানে পূর্বেকার জ্ঞান ও সমাধান ব্যবহার করতে পারবেন।
আপনি যত বেশী সুবিধা সৃষ্টি করবেন, এই সুবিধাগুলো আপনার তত কাজে দিতে। দৈনিক নিজের ১ শতাংশ উন্নতি করলে বছর শেষে নিজের উন্নতির হার হবে ৩৮ গুণ।
#৩ কতখানি আউটপুট পাচ্ছেন সেটার দিকে মনোযোগ দিন
প্রোডাক্টিক হওয়ার তিন নম্বর গোল্ডেন রুল হচ্ছে, ইনপুটের বদলে আউটপুটে ফোকাস করা। এক নাম্বার গোল্ডেন রুলে আমি আলোচনা করেছি যে, অগ্রগতির জন্য সিস্টেমের অনুসরণই সেরা উপায় কারণ এখানে প্রচেষ্টাকে গুরত্ব দেওয়া হয় এবং সবকিছু নিজেদের নিয়ন্ত্রণে থাকে। তবে এসব কাজ বা প্রচেষ্টা কোন উদ্দেশ্যে হচ্ছে সে ব্যাপারে ধারণা থাকা চাই। জানা থাকা দরকার, কি অর্জনের চেষ্টা করছি আমি।
আপনি দৈনিক লেখালেখি করেন, কিন্তু আপনার কোনো উদ্দেশ্য নেই। তাহলে এটা শুধুই প্র্যাকটিস। আপনি কিছু অর্জন করতে চাইলে একটা নির্দিষ্ট আউটপুটের দিকে মনো্যোগী হতে হবে আপনাকে। যেমন, নিজের ব্লগে প্রতি সপ্তাহে একটা করে পোস্ট করা। সুতরাং বলা যায়, আপনি কীভাবে আউটপুট অর্জন করবেন সিস্টেম তার একটি মাধ্যম।
আপনি আউটপুটকে “ফিনিশড প্রোডাক্ট” হিসেবে চিন্তা করতে পারেন। এভাবেই আউটপুট সিস্টেমের সাথে সম্পর্কিত। দৈনিক লেখার কাজটা হচ্ছে সিস্টেম, আর আর্টিকেল বা প্রকাশিত বই হচ্ছে আউটপুট।
মনে রাখবেন যে আউটপুট আর লক্ষ্য এক নয় কারণ আউটপুটে সমস্ত ভেরিয়েবল আমাদের নিয়ন্ত্রণে থাকে। আপনার ব্লগের লক্ষ্য হতে পারে এক মাসে 500 জন সাবস্ক্রাইবার পাওয়া। কিন্তু আপনার ব্লগে কে কে সাইন আপ করবে তা আপনার নিয়ন্ত্রণে নেই। শুধুমাত্র নতুন নতুন পোস্ট করার বিষয়টি আপনার নিয়ন্ত্রণে।
চাকরিতে পদোন্নতি পাওয়া একটি লক্ষ্য। এটা কোনো আউটপুট না। কারণ বসকে নিয়ন্ত্রণ করেন না আপনি। বস প্রমোশন দিলেই আপনি প্রমোশন পাবেন। তবে আপনি নিজেকে এমন অবস্থায় নিয়ে যান যেন আপনাকে কোনোমতেই উপেক্ষা না করা যায়। যেমন, আপনি টার্গেট নিতে পারেন যে আগামী তিন মাসে ১০টা প্রোজেক্ট শেষ করবেন আপনি। এবার সব ভেরিয়েবল আপনার নিয়ন্ত্রণে।
আউটপুট এবং লক্ষ্যের মধ্যে পার্থক্য জানা বাস্তবসম্মত এবং অর্জনযোগ্য লক্ষ্য নির্ধারণের চাবিকাঠি। এর বিনিময়ে আপনি অনেক লক্ষ্য অর্জন করবেন প্রচেষ্টা না চালিয়েই।
কিন্তু কীভাবে কাজ করতে হয় শুধু এটা জানলেই প্রোডাক্টিভ হওয়া যাবে না। আপনার জানতে হবে আপনার এনার্জি কাজে লাগাবেন কোথায়।
#৪ মেনে চলুন ৮০/২০ রুল
প্যারেটোর প্রিন্সিপাল বা প্যারেটোর মূলনীতি পরিচিত ৮০/২০ রুল হিসেবে। এটা একটা দারুণ মেন্টাল মডেল যা আপনি প্রায় দৈনিক কাজে লাগাতে পারবেন। এতে বলা হয়:
“২০ শতাংশ ইনপুট বা কাজ থেকে ৮০ শতাংশ আউটপুট বা ফলাফল পাওয়া যায়।” ছোটখাটো কাজগুলো থেকেই ফলাফল পাওয়া যায় অনেক বেশী।
উদাহরণ দেওয়া যাক একটা। মনে করুন সামনে আপনার টার্ম ফাইনাল পরীক্ষা। সবগুলো বিষয়ে সমান সময় দেওয়ার বদলে আপনি ৮০/২০ নিয়ম ব্যবহার করুন। পরীক্ষায় আসলে পারে এমন কিছু টপিক আপনি বাছাই করুন এবং সেগুলোর ওপর বেশী ফোকাস করুন। যেহেতু সেসব জায়গা থেকেই বেশী প্রশ্ন আসবে তাই ধরা যাক প্রশ্ন আসতে পারে সিলেবাসের ২০ শতাংশ জায়গা থেকে। কিন্তু এই ২০ শতাংশ জায়গা থেকেই ৮০ শতাংশ মার্কসের প্রশ্ন হবে। আর বাকি ৮০ শতাংশ জায়গা থেকে প্রশ্ন হবে মাত্র ২০ শতাংশ মার্কসের। এভাবে অল্প পড়েও আপনি পরীক্ষায় অনেক ভালো করতে পারবেন ইনশাআল্লাহ।
আপনি কি সঠিক জায়গায় আপনার মেধা ও এনার্জি ব্যবহার করছেন কী না তা চেক করার জন্য ৮০/২০ রুল ব্যবহার করুন। নিজেকে প্রশ্ন করুনঃ
- আপনি কি এমন কাজগুলোতে ফোকাস করছেন যা আপনার জন্য সবচেয়ে বেশি আউটপুট নিয়ে আসবে?
- আপনি কি সমস্ত ক্লায়েন্টকে সমান সময় দেন নাকি বেশিরভাগ সময় দেন এমন ক্লায়েন্টকে যাদের থেকে আপনার লাভ হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশী?
- আপনি যে কাজে মনোযোগ দিতে পারছেন না এর পেছনে কে কে দায়ী? ফোন না সোশ্যাল মিডিয়া?
সংশয়ে পড়লেই ৮০/২০ রুল ব্যবহার করবেন। কোন জিনিসগুলো আপনার জন্য বেশী গুরত্বপূর্ণ সে বিষয়ে সুস্পষ্ট ধারণা পাবেন আপনি। নতুন নতুন জিনিসও শিখতে পারবেন।
#৫ যেসব কাজে মনোযোগ লাগে সকালেই করে ফেলুন
প্রোডাক্টিভ হওয়ার ঠিক বিপরীতটাই হচ্ছে ডিস্ট্র্যাক্টেড বা মনোযোগ বিক্ষিপ্ত থাকা। আপনি ডিস্ট্র্যাকশন জীবন থেকে যত দূর করতে পারবেন তাহলে নিজের কাজে এবং আপনি যা করতে চান সেগুলোতে বেশি ফোকাস করতে পারবেন। ছোট ছোট জিনিসগুলোকে জীবন থেকে যত সরিয়ে দেবেন ততি ভালো।
ডিসট্র্যাকশন বা বিক্ষিপ্ততাকে তিনটি প্রধান শ্রেণীতে ভাগ করা যেতে পারে: ভৌত ডিসট্র্যাকশন (অর্থাৎ সম্পদের চিন্তা), ধরা যায় না এমন (যেমন সোশ্যাল মিডিয়া) এবং মানুষ। একটি কলম এবং কাগজ নিন। প্রতিটি ক্ষেত্রে কি কি ডিসট্র্যাকশন আপনার জীবনে আছে তা তালিকাভুক্ত করুন।