পশ্চিমা মিডিয়া পর্দার বিরুদ্ধে ক্রমাগত আক্রমণের পরও প্রতিটি সমাজ ও গোত্রের মুসলিম নারীরা ধনী-গরিব নির্বিশেষে হিজাব আঁকড়ে ধরতে শুরু করেছেন। শতাব্দী আগেও মনে হচ্ছিল, হিজাব বোধহয় মুসলিমবিশ্ব থেকে পুরোপুরি বিদায় নিতে যাচ্ছে; কিন্তু স্রোতের গতিপথ পালটে গেছে। পূর্ণ হিজাব আবৃত নারীদের সংখ্যা প্রতিদিন বাড়ছে। মজার ব্যাপার হলো, ইসলামের এ পুনর্জাগরণে নেতৃত্ব দিচ্ছে তরুণ প্রজন্ম। প্যারাডক্স হচ্ছে, যেসব মুসলিম দেশকে জোরজবরদস্তি করে পশ্চিমা সংস্কৃতিতে বদলানোর চেষ্টা করা হচ্ছিল, সেসব দেশের তরুণ প্রজন্মকেই এ আন্দোলনে সবচেয়ে সক্রিয় দেখা গেছে।
অধ্যাপক জন এসপোসিতো (John Esposito) বিষয়টি চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন এভাবে, ‘ইসলামের আধুনিক ইতিহাস নানা পূর্ব-ধারণা ও প্রত্যাশাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছে। কেননা, আধুনিকতাকে জড়িয়ে ধরতে দরকার ছিল ব্যক্তিজীবন থেকে ধর্মকে বিতাড়িত করা এবং সেকুলার হয়ে যাওয়া; কিন্তু ইসলামের উত্থান এতে বাধা দিয়েছে এবং এমন পরিবর্তনকে নাকচ করেছে। যেসব জায়গায় মডার্নিজম শক্তিশালী ছিল, সেখানে ইসলামের পুনরুত্থানও আরও শক্তিশালীভাবে দেখা গেছে। ইসলামের বিশ্বাস ও চর্চাকে দমাতে প্রযুক্তি ও আধুনিক শিক্ষাকে ব্যবহারের বদলে বরং এগুলোকেই ইসলামের জাগরণের পক্ষে ব্যবহার করা হয়েছে।
বেপর্দা জীবন ছেড়ে হিজাবকে আঁকড়ে ধরা এক অনুপ্রেরণাদায়ক নারী হলেন সারা বেকার।
সারা বেকার ছিলেন প্রাক্তন অভিনেত্রী, মডেল ও ফিটনেস প্রশিক্ষক। তিনি খ্রিষ্টান হিসেবে বেড়ে ওঠেন। বর্তমানে ‘দ্য মার্চ ফর জাস্টিস’-এর কমিউনিকেশন ডিরেক্টর এবং ‘দ্য গ্লোবাল সিস্টার্স নেটওয়ার্ক’-এর সহ-প্রতিষ্ঠাতাদের একজন। নাইন ইলেভেনের ঘটনার পর যখন তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন, তখন তাঁর অনেক ভক্ত হতবাক হয়ে যায়।
সারা বেকার বিকিনি থেকে নিকাব পর্যন্ত তার যাত্রা বর্ণনা করেছেন এভাবে, ‘আমেরিকার হার্টল্যান্ডে আমার জন্ম। বেড়ে ওঠার সময় অন্যান্য মেয়ের মতো আমিও বড় বড় শহরের গ্ল্যামারময় জীবনযাত্রার প্রতি আকৃষ্ট ছিলাম। এরপর প্রথমে ফ্লোরিডা, পরে মিয়ামির সাউথ বিচে চলে আসি। যারা গ্ল্যামারাস জীবন খোঁজে, তাদের জন্য এ জায়গাটি আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে। কিন্তু এমন জীবনযাপনে আমি যত অভ্যস্ত হচ্ছিলাম, আমার ভেতর থেকে আত্মপ্রশান্তি ততই হারিয়ে যাচ্ছিল। ফলে ভেতরের শূন্যতা পূরণ ও জীবনের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে হারিয়ে যাই অ্যালকোহল, পার্টি আর মেডিটেশনে। কিন্তু আফসোস, এই জীবনযাত্রা দুঃখের যে উপত্যকা সৃষ্টি করেছিল, তার সংকোচন করতে পারেনি এসব; বরং মনে হয়েছিল আমি যা যা করছি, এগুলো আমার সমস্যার কোনো আরোগ্য নয়, স্রেফ ব্যথা চাপা দিয়ে রাখার প্রচেষ্টামাত্র।
১১ সেপ্টেম্বর ২০০১। ইসলাম ও মুসলিমদের জন্য তখন বেশ কঠিন সময়। ইসলাম, ইসলামি সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের ওপর ক্রমাগত বাধা আরোপ করা হচ্ছে এবং ইসলামের বিরুদ্ধে নব্য ক্রুসেডের মতো ন্যাক্কারজনক ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। আর ঠিক ওই সময় থেকেই আমি ইসলামের সঙ্গে পরিচিত হতে শুরু করি। এর আগে আমি ভাবতাম, ইসলাম মানেই তাঁবু-আচ্ছাদিত নারী, স্ত্রী-পেটানো স্বামী, হেরেম আর সন্ত্রাসের জগত।
একদিন আমি এমন এক গ্রন্থের সন্ধান পাই, যাকে পশ্চিমে নেতিবাচকভাবে স্ট্রেরিওটাইপ করা হয়েছে। গ্রন্থটির নাম আল কুরআন। কুরআন পড়ার সময় মনে হচ্ছিল, এটি সরাসরি আমার অন্তর ও আত্মার সঙ্গে কথা বলছে। প্রয়োজন হচ্ছে না কোনো ধর্মীয় পণ্ডিত বা দোভাষীর।
অবশেষে সত্য আমার অন্তরে রেখাপাত করে। এবার ইসলাম নামক বিশ্বাস গ্রহণ করতে হবে আমাকে, যেখানে আমি একজন কার্যকারী মুসলিম হিসেবে শান্তিতে বসবাস করতে পারব।
এ সময় আমি একটি লম্বা গাউন ও হিজাব কিনলাম। যে রাস্তা দিয়ে আমি কয়েকদিন আগে স্কার্ট, বিকিনি বা স্বল্পবসনা পশ্চিমা পোশাক পরে হেঁটেছিলাম, সেদিন সেখান দিয়ে হাঁটছিলাম আমি মুসলিম নারীর পোশাকে। চারপাশের মানুষ, চেহারা, দোকান সবই এক ছিল। তবে একটি পার্থক্য স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান হলো–এই প্রথমবারের মতো আমি নারী হিসেবে মানসিক শান্তি পাচ্ছি। নিজেকে তখন অন্যরকমভাবে আবিষ্কার করি। মনে হচ্ছিল যেন শেকল ভেঙে বেরিয়ে এসে জীবনে প্রথমবারের মতো মুক্ত বাতাসে শ্বাস নিচ্ছি। আমার দিকে মানুষের বিস্ময়ভরা দৃষ্টি দেখে উৎফুল্ল হয়ে উঠলাম। এর আগে হায়েনারা যে দৃষ্টিতে শিকার খোঁজে, পুরুষেরাও আমার দিকে সেভাবেই তাকাত। আমার কাঁধ থেকে যেন একটা ভারী বোঝা নেমে গেল। আমাকে আর নিত্যনতুন কাপড় কিনতে হবে না, মেকআপ করতে হবে না, পার্লারে যেয়ে চুলের পেছনে হাজার ডলার খরচ করতে হবে না, জিমে যেতে হবে না। অবশেষে আমি মুক্তি পেলাম।
হিজাব নিয়ে সন্তুষ্ট থাকলেও অনেক মুসলিম নারীকে নিকাব পরতে দেখে এটা নিয়েও আমি উৎসাহী হয়ে উঠি। আমি আমার মুসলিম স্বামীকে জিজ্ঞেস করি, ‘আমি এখন থেকে নিকাব পরব, নাকি যে হিজাব পরছি সেটাই পরতে থাকব?’ আমি তাঁকে বিয়ে করেছিলাম ইসলামে ফেরার পর। তিনি আমাকে শুধু এটাই বললেন যে, তিনি বিশ্বাস করেন হিজাব পরা ইসলামে ফরজ; তবে নিকাব নয়। কেননা, তখন হিজাব বলতে আমি একটা কাপড় দিয়ে আমার মাথা ঢেকে রাখতাম, তবে চেহারা খোলা থাকত। এ ছাড়া একটি আবায়া পরতাম, যা গলা থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত ঢেকে রাখত।
এভাবে দেড় বছর পার হয়ে গেলে আমি আমার স্বামীকে বললাম, ‘এখন থেকে নিকাব পরতে চাই।’ এবার আমার যুক্তি ছিল, নিকাব পরলে আল্লাহ অধিক খুশি হবেন। এ ছাড়া নিকাবের মাধ্যমে অধিক শালীনতা অর্জনের মাধ্যমে আমি আল্লাহর আরও নৈকট্য অর্জন করতে পারব। মানসিকভাবে আরও প্রশান্ত হব। তিনি আমার সিদ্ধান্তকে সমর্থন জানিয়ে আমাকে ‘ইসদাল’ কিনতে নিয়ে যান। এ ছাড়া একটি নিকাবও কিনি, যা আমার দুটি চোখ ছাড়া পুরো মাথা ও চেহারা ঢেকে রাখে।
তখন রাজনীতিবিদ, ভ্যাটিকান ধর্মযাজক, স্বাধীনতাবাদী, তথাকথিত মানবাধিকার ও স্বাধীনতাকর্মীরা হিজাবের নিন্দা করতে শুরু করে এবং অন্যদের কাছে নিকাবকে নারীর প্রতি নিপীড়ক, সামাজিক সংহতির বাধা হিসেবে প্রচার করে। এ ছাড়া মিসরের এক মন্ত্রী তখন নিকাবকে পশ্চাৎপদতার কারণ বলতেও দ্বিধা করেননি।
কোনো সরকার নারীদের ওপর একটি নির্দিষ্ট ড্রেসকোড যেমন—হিজাব-নিকাব চাপিয়ে দিলে পশ্চিমা সরকার ও তথাকথিত মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলো নারীঅধিকার রক্ষায় আধাজল খেয়ে মাঠে নামে। বস্তুত এসব নির্লজ্জ ভণ্ডামি ছাড়া কিছু নয়। অপরদিকে এই হিজাব-নিকাব পরার কারণে যখন মুসলিম নারীদের অধিকার, শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়, তখন এসব মানবাধিকার কর্মীকে খুঁজে পাওয়া যায় না। বর্তমানে হিজাব বা নিকাব পরা নারীরা কেবল তিউনিসিয়া, মরক্কো ও মিসরের মতো সর্বগ্রাসী শাসনের অধীনেই নয়; বরং ফ্রান্স, হল্যান্ড আর ব্রিটেনের মতো লিবারেল দেশেও কাজ ও শিক্ষার সুযোগ থেকে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
একজন মুসলিমা হিসেবে আমি মুসলিম নারীদের বলব, তাঁরা যেন তাঁদের স্বামীকে একজন উত্তম মুসলিম হতে সাহায্য করেন। সন্তানদের দীনদার ও মুত্তাকি হিসেবে গড়ে তুলতে হবে, যাতে তারা মানবজাতির জন্য আলোকবর্তিকা হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে। তারা সৎকাজের আদেশ দেবে, অসৎকাজে বাধা দেবে। দীন ও তাকওয়ার কথা বলবে। সমূহ অন্যায়ের বিরুদ্ধে কড়া জবাব দেবে। আমাদের হিজাব বা নিকাব পরার অধিকারের জন্য লড়াই করবে। স্রষ্টাকে সন্তুষ্ট করতে সচেষ্ট থাকবে। তা ছাড়া আমাদের জন্য করণীয় হচ্ছে, যেসব নারী কখনো হিজাব বা নিকাব পরার অভিজ্ঞতা লাভ করেননি এবং হিজাব বা নিকাবের গুরুত্ব বোঝারও সুযোগ হয়নি, তাঁদের কাছে এই দাওয়াত নিয়ে আমাদের যেতে হবে।
আমি যেসব নিকাবি বোনকে চিনি, তাঁদের অধিকাংশই পশ্চিমা নওমুসলিম, তাঁদের অনেকে অবিবাহিতও। কেউ কেউ নিকাব পরলেও পরিবার বা সমাজের পূর্ণ সমর্থন বা সহায়তা পান না। তবে আমাদের সবার মধ্যে একটি মিল হচ্ছে, আমরা সবাই হিজাব-নিকাবকে সম্পূর্ণ স্বেচ্ছায় রবের আদেশ পালনের উদ্দেশ্যে গ্রহণ করেছি। আর আমরা কেউই এটাকে পরিত্যাগ করব না।
সাউথ বিচে আমি আমার বিকিনি ও গ্ল্যামারাস পশ্চিমা লাইফস্টাইলকে ফেলে এসেছি। এর বদলে আঁকড়ে ধরেছি আমার রবকে, পেয়েছি অন্তরের প্রশান্তি। একটা মানুষ হিসেবে আমি সমাজে বাঁচতে পারছি। এ জন্য আমি নিকাবকে বেছে নিয়েছি। নিকাব পরার অধিকার রক্ষায় আমি লড়তে রাজি, মরতে রাজি। আজ নিকাবই নারী স্বাধীনতার নতুন প্রতীক।
যেসব নারী পশ্চিমা মিডিয়ার প্রচারিত হিজাব-নিকাববিরোধী নেতিবাচক প্রচারণার কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন, তাঁদের বলতে চাই—আপনি কী হারাচ্ছেন, সেটা নিজেও জানেন না।’