নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশার ফলে সমাজে যেসব বিপর্যয় সৃষ্টি হয়, তার রাস্তা বন্ধ করে দিয়ে উভয় লিঙ্গের নৈতিকতা ও পবিত্রতা রক্ষা করা হিজাবের উদ্দেশ্য। ইসলামই সত্যিকার অর্থে নারীদের শোষণের হাত থেকে রক্ষা করে; কিন্তু পশ্চিমারা দাবি করে তারাই নারীদের প্রকৃত স্বাধীনতা দিয়েছে। কিন্তু পশ্চিমা সমাজের চিত্র ভিন্ন কথা বলে। পশ্চিমে নারীর শোষণ নজিরবিহীন। যৌনস্বাধীনতা ও যৌনবিপ্লব নারীদের কোমলতা ও কমনীয়তা বিনষ্ট করেছে, পরিবার ধ্বংস করেছে, তাদের কর্পোরেট দাসীতে পরিণত করেছে। লজ্জাশীলতা ও শালীনতা বিলুপ্তির নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে তাদের সমাজে। যার মধ্যে রয়েছে নৈতিক অবক্ষয়, বিয়ের হার হ্রাস, বিয়ে বিচ্ছেদের উচ্চহার, পরিবারব্যবস্থা ভেঙে পড়া এবং যৌনবাহিত রোগের বিস্তার। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে স্কুলপড়ুয়া মেয়েদের মধ্যে গর্ভধারণের ক্রমবর্ধমান হারের পরিসংখ্যানও উদ্বেগজনক।
এ ক্ষেত্রে প্রশ্ন এসেই যায়, মুক্তির নামে পশ্চিমা সমাজে নারীদের যা বোঝানো হচ্ছে, সেটা কি লিবারেশন অর্থাৎ মুক্তি না লিবার্টিনিজম? লিবার্টিনিজম বলতে বোঝায় একটি জীবনধারা বা আচরণের একটি ধরণ, যা অত্যন্ত আত্মকেন্দ্রিক এবং সেখানে আত্মনিয়ন্ত্রণের অভাব থাকে। বিশেষ করে অবাধ যৌনাচার এবং ধর্মীয় বা অন্যান্য নৈতিক কর্তৃত্ব প্রত্যাখ্যানের ক্ষেত্রে। লিবার্টিনিজমে আক্রান্ত নারীরা নিজেদের খেয়ালখুশিমতো চলাফেরা করে, সমাজের রক্ষণশীলতার মানদণ্ডকে পাত্তা দেয় না, ধর্মীয় বিধিনিষেধ মানতেও অনীহা দেখা যায়; অনেক সময় বিরোধিতাও করে বসে। বিলবোর্ড, চকচকে ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদ, বিজ্ঞাপন, টিভি-শো এবং চলচ্চিত্রগুলোতে প্রদর্শিত অশ্লীল নারীরা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় পশ্চিমা সমাজে নারীদের দুর্দশার বিবরণ। প্রতি ইঞ্চি জায়গা যখন নারীদেহের নির্লজ্জ প্রদর্শনীতে পূর্ণ থাকে, তখন সেটাকে আর নারী-মুক্তি বলা যায় না। এটা অতি-যৌনতাবাদ, যা নিয়ে আমরা এ অধ্যায়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।
স্বাধীন নারীরা আধুনিক যুগে যেসব সমস্যায় ভোগে
অতীতেও যেমন নারীরা শোষণের শিকার হতো, আজও হয়। কিন্তু বর্তমানের শোষণ অতীতের মতো নয়; বরং নতুন মোড়কে এসেছে। যত ধর্ষণ হয়, তন্মধ্যে ৭৫ শতাংশ ধর্ষণ সে-সকল পুরুষের দ্বারা সংঘটিত হয়, যারা ব্যক্তিগতভাবে ভিকটিমকে চেনে। কর্মক্ষেত্রে পুরুষেরা তাদের পদ-পদবি ব্যবহার করে নারীদের শোষণ করে। এ ছাড়া ডিভোর্সের অন্যতম প্রধান কারণ পরকীয়া, যা বিপরীত লিঙ্গের সঙ্গে অবাধ মেলামেশার ফল। অল্পবয়সে গর্ভধারণ ও তরুণীদের কুমারিত্ব হারানোর প্রধান কারণ সহশিক্ষাব্যবস্থা। ফলে পশ্চিমাবিশ্বে গর্ভপাতের হার মানবেতিহাসে নজিরবিহীন।
ইতিহাসে কখনো নারী-পুরুষ এত খোলামেলা ছিল না। পরিণতিতে আজ শিল্পরূপে পর্নোগ্রাফির ব্যাপক বিস্তার ঘটেছে। প্রতিটি মিডিয়ায় আজ এর অবস্থান। এই ‘আলোকায়নের যুগে (Age of Enlightenment)’ নারীদেহকে এমনভাবে শোষণ (নাকি ‘যৌনশোষণ’) ও প্রদর্শন করা হচ্ছে যে, মানুষের জন্য তার নজরের পবিত্রতা রক্ষা করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আধুনিক যুগে আমাদের স্বাধীন নারীদের জন্য ডিভোর্স সম্ভবত সবচেয়ে ছোট সমস্যা। আধুনিক নারীরা অ্যানোরেক্সিয়ায় (খাদ্যাভ্যাসজনিত একপ্রকার মানসিক রোগ) ভুগছে, বয়ফ্রেন্ডের সাথে ঘুরতে গিয়ে তাদের হাতে ধর্ষণের শিকার হচ্ছে, তরুণীরা গর্ভবতী হচ্ছে; অন্যদিকে অবিবাহিত ‘স্বাধীন’ নারীরা চল্লিশোর্ধ্ব বয়সে একটি সন্তানের জন্য হাহাকার করছে—এই সমাজকে কোনোভাবেই নারীবান্ধব বলা যায় না।
জার্মেইন গ্রিয়ার (Germaine Greer) সারা জীবন ক্যারিয়ারের সামনে বিয়ে ও মাতৃত্বকে অবজ্ঞা করেছেন। ৪০ পেরোনোর পর ব্রিটিশ ম্যাগাজিন Aura-এর মে ২০০০ সংখ্যায় তিনি একটি প্রবন্ধ লেখেন, যার শিরোনাম ছিল ‘My Battle for a Baby’। তাতে তিনি লেখেন, ‘আমি একটি সন্তানের জন্য পাগল ছিলাম, এর প্রমাণ হিসেবে হাসপাতালের বিলের কাগজও দেখাতে পারব। আমি এখনো গর্ভধারণের স্বপ্ন দেখি। অপেক্ষায় আছি এমন এক স্বপ্নের, যা কখনো বাস্তবে ঘটবে না।’
এটা ঠিক সেই সময়ে ঘটছে, যখন দাবি করা হচ্ছে যে, আধুনিক নারী কেবল তার ঘর থেকে নয়, তার পরিবার এবং স্বামীর হাত থেকেও মুক্তি পেয়েছে। আধুনিক ও মুক্তিকামী নারীরা এতটাই দুর্দশাগ্রস্ত যে, অনেক কট্টর নারীবাদী বুদ্ধিজীবী স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন, আধুনিক নারীরা আগের চেয়ে অনেক বেশি নিগৃহীত।
মেরি পাইফার (Mary Pipher) আমেরিকান একজন মনোবিজ্ঞানী ও নারীবাদী। তার কিশোরী ক্লায়েন্টদের কাছ থেকে শত শত গল্প ও আত্মবিচ্ছেদের ঘটনা শোনার পর তিনি এই উপসংহারে পৌঁছেছেন, ‘৩০ বছর আগে আমি যখন কিশোরী ছিলাম, তখন মেয়েরা যতটা সমস্যায় ভুগত, এখন তার চেয়েও বেশি সমস্যায় ভোগে। এক দশক আগেও মেয়েদের অবস্থা ভিন্ন ছিল। মেয়েরা এখন অনেক বেশি নির্যাতিত। সামনে আরও বিপজ্জনক, যৌনতাপূর্ণ ও মিডিয়া-নিয়ন্ত্রিত সময় আসছে। যেহেতু আগামী বিশ্ব আরও বিপজ্জনক, তাই মেয়েরা আরও নিরাপত্তাহীন হবে।’
এর কারণ হলো, আধুনিক সমাজ নারীর শালীনতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল নয়। শরিফা কার্লোর (Shariffa Carlo) ভাষায়, ‘সমাজ এবং নিজেকে রক্ষা করা নিপীড়ন নয়; বরং নোংরা পানি দেখেও সেখানে ঝাঁপিয়ে পড়াটাই নিপীড়ন। নারীরা নারীবাদের অতল গহ্বরে ঝাঁপ দিয়ে নিজেই নিজেকে ধ্বংসের সাগরে নিক্ষিপ্ত করছে।
আল-মাগরিব ইনস্টিটিউটের কানাডিয়ান প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মাদ আল শরিফ যুগের আধুনিকমনা চিন্তাবিদদের যথার্থই প্রশ্ন করেছেন,
- কেন তারা কেবল সুন্দরী তরুণীদের মুক্ত করতে চায়?
- কেন তারা মাঝবয়সি বা বয়স্ক নারীদের মুক্ত করে না?
- কেন তারা আদিবাসীদের মুক্ত করে না?
- কেন তারা বন্দিদের মুক্ত করে না?
- কেন তাদের একমাত্র টার্গেট ১৩ থেকে ২৮ বছর বয়সি লম্বা, সুন্দরী তরুণী?
- তাদের কাছে এটাই কি সৌন্দর্যের সংজ্ঞা?
- কেনই-বা তারা আপনাকে হিজাব খুলতে বলছে?
এর কারণ কি এটাই যে, আমরা এক কৃত্রিম সমাজ গড়তে চাচ্ছি, যেখানে নারী-পুরুষের আপন কর্তব্যের সীমারেখা মলিন হয়ে যাবে? এটা কি সেই সমাজ, যেখানে নারীরা মাতৃত্ব গ্রহণ করবে না; পুরুষেরা পুরুষ হবে না, রিজিকের খুঁজে বের হবে না?
আধুনিক বিজ্ঞান বলছে, নারী-পুরুষ মানসিক ও জীবগতভাবে জন্মলগ্ন থেকেই ভিন্ন এবং এটি বাকি জীবনেও বদলায় না। এ বিষয়টি সামনের কয়েকটি অধ্যায়ে দেখানো হবে।
নারী–স্বাধীনতা না অধঃপতন
যাকে ‘নারী-মুক্তি’ বলা হচ্ছে তা মুক্তি নয়; বরং অবক্ষয়—যেখানে নারীকে মিডিয়া যৌনশোষণ করে। ‘প্রাচীন যুগে’ নারীরা নির্যাতিত হতো; কিন্তু আধুনিক যুগের ‘আধুনিক নারী’ কি সেই নিপীড়ন কাটিয়ে উঠতে পেরেছে? ‘মুক্তি’র মাধ্যমে অন্যায় থেকে সত্যিকারার্থে নিষ্কৃতি পাওয়া গেছে? বাস্তবতা হলো নারীনির্যাতন আজও পূর্ণমাত্রায় বিদ্যমান। তবে আজকের নারীনির্যাতন নতুন ছদ্মবেশে হাজির হয়েছে, যা মিডিয়া এবং নারী-মুক্তি ও নারীবাদের আকর্ষণীয় স্লোগান দ্বারা সমর্থিত।
আজকাল জন্মের সময় নিষ্পাপ মেয়েদের হত্যার পরিবর্তে শিশুকে গর্ভপাত করতে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়। সন্তানবতী মহিলারা আজও অপাঙ্ক্তেয়, যেমনটা আগের শতাব্দীতেও দেখা যেত; কিন্তু এখন এ ঘটনাকে আকর্ষণীয় মোড়কে বলা হয়—‘একক পিতা বা মাতার পরিবার’। আধুনিক যুগে নারীরা ক্রীতদাসী হিসেবে বাজারে বিক্রি হয় না বটে, তবে মডেল, গায়িকা আর অভিনেত্রীর ছদ্মবেশে তাদের দেহ পুঁজিপতি ও গণমাধ্যমের কাছে বিক্রি করে। যেকোনো সমাজে সেখানকার মানুষেরা যেসব শব্দ ব্যবহার করে, সেগুলো তাদের ওপর নৈতিক প্রভাব সৃষ্টি করে। এসব শব্দ ব্যক্তির ভেতর লজ্জা বা অপরাধবোধের অনুভূতি জাগ্রত করতে পারে। আধুনিক সেকুলার ও নায়েলিস্টিক কালচার এ বিষয়ে অবগত। পশ্চিমা সমাজেও এমন শব্দ ও পরিভাষা অনুরূপ লজ্জা বা অপরাধবোধ সৃষ্টি করে। তাই তারা কৌশলে শব্দগুলো সরিয়ে এমন শব্দ দিয়ে প্রতিস্থাপন করেছে, যা শুনতে ভালো লাগে। মনে হয় না তাতে নৈতিকতাবিরোধী কিছু আছে।
স্বাধীনতার আড়ালে নারীর অবক্ষয়ের সবচেয়ে বড় ও প্রভাবশালী ক্ষেত্র পর্নোগ্রাফি। নারীদেরকে তাদের শরীর নিয়ে যা খুশি তা-ই করতে উৎসাহিত করা হয়। অধিকাংশ নারীবাদী পর্নোগ্রাফি ইন্ডাস্ট্রির বিরোধিতা করে। কারণ, এখানে নারীকে বস্তু হিসেবে দেখানো হয়। তারা এটাকে নারীদের জন্য অমানবিক হিসেবে গণ্য করে। এতকিছুর পরও এই ইন্ডাস্ট্রির কিছুই হয়নি। গ্রিয়ার স্বীকার করেছেন, ‘…নারীবাদের ৩০ বছর পার হয়ে গেছে কিন্তু পর্নোগ্রাফি আরও বেড়েছে; বরং আগের চেয়ে আরও ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে।’
গ্রিয়ার ও অন্যান্য নারীবাদী চিন্তাবিদরা ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিকে নারীদের সামসময়িক দাসত্বের একটা প্রধান উপাদান হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। যদিও দাবি করা হয় ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি নারীদের পরিতৃপ্তি দেওয়ার জন্যই। তবে বাস্তবতা হচ্ছে—গ্রিয়ার যথার্থভাবে যা উল্লেখ করেছেন—ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি পুরুষের দ্বারা ব্যাপকভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়। পুরুষেরা নারীদের নিজেদের সাজানোর জন্য প্ররোচিত করে, যেন তারা তাদের দেখে চোখের লালসা মেটাতে পারে।
নারীর ওপর এই নতুন চাপের পরিণতি মানবেতিহাসে আগে দেখা যায়নি। আগের যুগের নারীবাদীরা হয়তো বলবে, বর্তমানের মুক্তিপ্রাপ্ত নারীরা আরও সমৃদ্ধ জীবনযাপন করে; কিন্তু আধুনিক নারীবাদীরাও এই সত্যটি স্বীকার করে যে, আজকের নারীরা আগের তুলনায় অনেক বেশি চাপের মধ্যে থাকে এবং বিষণ্ন জীবন কাটায়। গ্রিয়ার বিষয়টি ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে, ‘1955 খ্রিষ্টাব্দ থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিষণ্নতাজনিত অসুস্থতা পাঁচ গুণ বেড়েছে। স্পষ্টভাবেই নারীরা পুরুষের তুলনায় বিষণ্নতায় বেশি ভোগেন। উদাহরণস্বরূপ 17 শতাংশ ব্রিটিশ নারী বয়স ২৫ হওয়ার আগেই আত্মহত্যার চেষ্টা করেন।’
বিষণ্নতা ও বিমর্ষভাব থেকে বাঁচতে আধুনিক নারী অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট গ্রহণ করে, যা আবার পুঁজিপতিদের পক্ষেই যায়। কারণ, তাদের হাতেই ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলো। নারীদের আরও ব্যাপকভাবে প্রোজ্যাক খেতে দেওয়া হচ্ছে; অথচ একই অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট চিড়িয়াখানার প্রাণীদের দেওয়া হয়, যেন তারা বন্দিত্বের চিন্তা থেকে মুক্তি পায়। ফলে এখন প্রশ্ন দাঁড়াচ্ছে—এটা নারীর স্বাধীনতা না বন্দিত্ব?
[Based on Dr. Gohar Mushtaq’s “Hijab: Liberation or Oppression]