বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম।
মুমিন তার জীবনে ইসলাম নিয়ে বিভিন্নভাবে সংশয়ের সম্মুখীন হবে। এসব সংশয়ের নানা রকম উৎস থাকতে পারে। কিছু সংশয় আসতে পারে শয়তানের ওয়াসওয়াসা থেকে অথবা ইসলামের শত্রুদের আক্রমণের দ্বারা। এসব সংশয়ের প্রকৃতি বুঝতে পারা মুসলিমদের জন্য জরুরী। পাশাপাশি জানতে হবে তারা কিভাবে নিজেদের এবং পরিবারকে শিরক ও কুফরের হাত থেকে বাঁচাতে পারে তা–ও।
ইসলামের ব্যাপারে সন্দেহ ও সংশয় সৃষ্টি হওয়াকে আলিমরা অন্তরের রোগ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। একটি নির্দিষ্ট জ্ঞানের মাধ্যমেই দূর করা যায় একে। একজন মুমিন জীবনের কোনো না কোনো সময়ে দীন নিয়ে সংশয়ে পতিত হবেনই। কারণ এমনকি নবীগণও সময়ে সময়ে সংশয়ের শিকার হয়েছেন।
আবু হুরাইরা রা. হতে বর্ণিত যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
نَحْنُ أَحَقُّ بِالشَّكِّ مِنْ إِبْرَاهِيمَ إِذْ قَالَ رَبِّ أَرِنِي كَيْفَ تُحْيِي الْمَوْتَى قَالَ أَوَلَمْ تُؤْمِنْ قَالَ بَلَى وَلَكِنْ لِيَطْمَئِنَّ قَلْبِي
ইবরাহীম আ. যখন বললেন, হে আমার প্রতিপালক! তুমি আমাকে দেখাও কেমন করে তুমি মৃতকে জীবিত কর? তখন ইবরাহীম আ.-এর তুলনায় সন্দেহ করার ব্যাপারে আমিই অগ্রসর ছিলাম। [সহিহ বুখারি : ৪৫৩৭]
আবু হুরাইরাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ইবরাহীম (আঃ) তাঁর অন্তরের প্রশান্তির জন্য মৃতকে কিভাবে জীবিত করা হবে, এ সম্পর্কে আল্লাহর নিকট জিজ্ঞেস করেছিলেন, (সন্দেহবশত নয়) যদি ’সন্দেহ’ বলে অভিহিত করা হয় তবে এরূপ ’সন্দেহ’ এর ব্যাপারে আমরা ইবরাহীম (আঃ)-এর চেয়ে অধিক উপযোগী। যখন ইবরাহীম (আঃ) বলেছিলেন, হে আমার প্রতিপালক! আমাকে দেখিয়ে দিন, আপনি কিভাবে মৃতকে জীবিত করেন। আল্লাহ বললেন, তুমি কি বিশ্বাস কর না? তিনি বললেন, হ্যাঁ। তা সত্ত্বেও যাতে আমার অন্তর প্রশান্তি লাভ করে (আল–বাকারাহঃ ২৬০)। অতঃপর (নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম লূত (আঃ) এর ঘটনা উল্লেখ করে বললেন) আল্লাহ লূত (আঃ)-এর প্রতি রহম করুন। তিনি একটি সুদৃঢ় খুঁটির আশ্রয় চেয়েছিলেন। আর আমি যদি কারাগারে এত দীর্ঘ সময় থাকতাম যত দীর্ঘ সময় ইউসুফ (আঃ) কারাগারে ছিলেন তবে তার (বাদশাহর) ডাকে সাড়া দিতাম। [সহিহ বুখারিঃ ৩৩৭২]
ইবরাহিম আ. আল্লাহর মৃতকে পুনরুজ্জীবিত করার ক্ষমতা কিংবা ইমানের কোনো বিষয় নিয়ে সংশয়ে ছিলেন না। তিনি তার ইমানে দৃঢ় ছিলেন। কিন্তু তিনি আল্লাহর ক্ষমতার ব্যাপারে আরো জানতে চেয়েছিলেন, যেন তার হৃদয় স্থিরতা লাভ করে। এটা এক সাধারণ সংশয়, জ্ঞানীদের জিজ্ঞেস করার দ্বারাই যা দূর করা যায়।
ইমাম কুরতুবি রাহ. এই আয়াতের তাফসিরে বলেন,
فَقَالَ الْجُمْهُورُ لَمْ يَكُنْ إِبْرَاهِيمُ عَلَيْهِ السَّلَامُ شَاكًّا فِي إِحْيَاءِ اللَّهِ الْمَوْتَى قَطُّ وَإِنَّمَا طَلَبَ الْمُعَايَنَةَ وَذَلِكَ أَنَّ النفوس مستشرقة إِلَى رُؤْيَةِ مَا أُخْبِرَتْ بِهِ
অধিকাংশের মত হচ্ছে যে, আল্লাহ মৃতকে পুনরুজ্জীবিত করতে পারবেন কী না এটা নিয়ে ইবরাহিম আলায়হিস সালাম সংশয়ে ভোগেননি কখনোই। বরং তিনি কেবল এটা নিজের চোখে দেখতে চেয়েছেন। কারণ, মানুষকে যা বলা হয় আত্মা তা দেখার ইচ্ছা পোষণ করে। [তাফসিরে কুরতুবিঃ ৩/২৯৭]
যে বিষয়গুলো ঐশ্বরিক বার্তার প্রমাণকে আরো জোরদার করে মানুষ প্রকৃতিগতভাবেই সেগুলো দেখতে আগ্রহী হয়। এসব সংশয় দূর করার জন্য ইসলামের ব্যাপারে আরো জানতে হবে এবং আল্লাহর বিভিন্ন নিদর্শন দেখতে হবে। এ ধরণের সংশয়ের শিকার হলে তাকে দোষারোপ করা যাবে না। তবে অহংকার বা অগ্রাহ্যতার কারণে যেসব সংশয়ের সৃষ্টি হয় এগুলো গুরুতর মাত্রার সংশয়, যা ব্যক্তিকে কুফরের দিকে নিয়ে যেতে পারে।
তাই, মুমিনের কর্তব্য হচ্ছে সংশয় সৃষ্টি করতে পারে এমন বিষয় সমূহ থেকে নিজেকে দূরে রাখা এবং নিজের ইমানকে যথাসম্ভব সুরক্ষা করা, যেন এটি এক মূল্যবান সম্পদ যাকে রক্ষা করা হবে সকল চোর–ডাকাতের হাত থেকে। আমাদেরকে নিজেদের ইমানের চারদিকে সুদৃঢ় দেয়াল গেঁথে ফেলতে হবে এবং দুর্গের মতো নিশ্ছিত্র করতে হবে যেন সকল বাহ্যিক হুমকির হাত থেকে ইমানের মতো সবচেয়ে মূল্যবান জিনিসকে রক্ষা করা যায়। ইমানের দুর্গ গড়ে ওঠে দুটি উপায়েঃ আল্লাহর কিতাবে নিদর্শনগুলো পর্যবেক্ষণ করা এবং আল্লাহর সৃষ্টির মধ্যে স্রষ্টার নিদর্শন পর্যবেক্ষণ করা।
শায়খ ইবনু উসাইমিন লেখেন,
ويتعرف العبد على ربه بالنظر في الآيات الشرعية في كتاب الله عز وجل وسنة رسوله صلى الله عليه وسلم والنظر في الآيات الكونية التي هي المخلوقات فإن الإنسان كلما نظر في تلك الآيات ازداد علماً بخالقه ومعبودة
মহান আল্লাহর কিতাব এবং তার রাসুল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের সুন্নাহর দিকে তাকানোর দ্বারা বান্দা তার রবের ব্যাপারে ইলম অর্জন করতে সক্ষম হয়। এ ছাড়া সৃষ্টির ভেতর যে নিদর্শন আছে সেখানে তাকিয়েও সে রবকে খুঁজে পায়। মানুষ যখন এসব নিদর্শনের দিকে তাকায় তখন রবের ব্যাপারে তার জ্ঞান বৃদ্ধি পায় এবং একমাত্র আল্লাহই যে ইবাদতের যোগ্য এটা সে বুঝতে পারে। [শরহ সালাসাতুল উসুল ১/১৯]
কুরআন ও সুন্নাহয় অসংখ্য নিদর্শন রয়েছে যা নির্দেশ করে যে এই দুটি জিনিস মহান রবের পক্ষ থেকেই এসেছে। দৈনন্দিনের আদব থেকে শুরু করে সামাজিক সংগঠন, আইন, বিশ্বাস এবং ইসলামের নৈতিকতা সবকিছুই মানুষের জন্য নির্ধারিত করা হয়েছে তার কল্যাণের স্বার্থে। এ কল্যাণ কেবল দুনিয়াবি জীবনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং আখিরাতেও তা পরিব্যাপ্ত।
তাই, মুমিনের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সে নিয়মিত কুরআন তিলাওয়াত ও পাঠের দ্বারা সে নিজের ইমানকে শক্তিশালী করবে।
মহান আল্লাহ বলেন,
اِنَّمَا الۡمُؤۡمِنُوۡنَ الَّذِیۡنَ اِذَا ذُکِرَ اللّٰهُ وَجِلَتۡ قُلُوۡبُهُمۡ وَ اِذَا تُلِیَتۡ عَلَیۡهِمۡ اٰیٰتُهٗ زَادَتۡهُمۡ اِیۡمَانًا وَّ عَلٰی رَبِّهِمۡ یَتَوَکَّلُوۡنَ ۚ﴿ۖ۲﴾
আবু শুরাইহ আল–খুজায়ি বর্ণনা করেন মুমিন তো তারা, যাদের অন্তরসমূহ কেঁপে উঠে যখন আল্লাহকে স্মরণ করা হয়। আর যখন তাদের উপর তাঁর আয়াতসমূহ পাঠ করা হয় তখন তা তাদের ঈমান বৃদ্ধি করে এবং যারা তাদের রবের উপরই ভরসা করে। [সুরা আনফালঃ ২]
যে রাসুলুল্লাহ সালাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
فَإِنَّ هَذَا الْقُرْآنَ سَبَبٌ طَرَفُهُ بِيَدِ اللَّهِ وَطَرَفُهُ بِأَيْدِيكُمْ فَتَمَسَّكُوا بِهِ فَإِنَّكُمْ لَنْ تَضِلُّوا وَلَنْ تَهْلِكُوا بَعْدَهُ أَبَدًا
নিশ্চয়ই এই কুরআন দড়ির মতো। দড়ির এক প্রান্ত আল্লাহর হাতে এবং অপর প্রান্ত তোমাদের হাতে। একে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরো। তাহলে তুমি কখনোই বিপথগামী বা ধ্বংসমুখ হবে না। [সহিহ ইবনু হিব্বানঃ ১২২]
মুমিনকে অবশ্যই কুরআনের সাথে নৈকট্যশীল সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। এ সম্পর্ক গড়তে হলে বেশি বেশি কুরআন মুখস্থ করতে হবে এবং এর ভাষা, অর্থ, ভাবানুবাদ ও ফিকহ বুঝতে হবে। কুরআনের ব্যাপারে ইলম অর্জন করলে তা বান্দার সালাতের ব্যাপক উন্নতি করে। আর ইমান ধরে রাখায় নিয়মিত সালাত আদায়ের তো কোনো বিকল্প নেই।
এ ছাড়া, মুমিনদের রাসুল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের সাথেও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। রাসুলের সহিহ সুন্নাহ এবং তার সিরাহের ব্যাপারে জ্ঞানার্জন করতে হবে। তার জীবন ও শিক্ষা নিদর্শন ও বিস্ময় দ্বারা পরিপূর্ণ। তিনি প্রমাণ করেছেন যে তিনি প্রকৃতপক্ষেই আল্লাহর রাসুল, যিনি আমাদেরকে সারাজীবন এক রবের ইবাদত করার আহবান করেছেন এবং জান্নাত–জাহান্নামের চিরস্থায়ী জীবনে বিশ্বাস স্থাপন করার কথা বলেছেন।
ইবনু হাজম বলেন,
فَلَو لم تكن لَهُ معْجزَة غير سيرته صلى الله عَلَيْهِ وَسلم لكفى
যদি তার সিরাত ব্যতীত তার আর কোনো অলৌকিক বিষয় না–ও থাকত, সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম, তাহলে সেটাই যথেষ্ট হত। [আল–ফিসাল আল–মিলাল ওয়াল–আহওয়া ওয়াল–নিহাল ২/৭৩]
কুরআন ও সুন্নাহর মতো মৌলিক বিষয়ে জ্ঞান থাকা প্রত্যেক মুসলিমের জন্য ফরজ। যারা কেবল সামাজিক রীতি হিসেবে ধর্মকে গ্রহণ করে, কেবল চারপাশে থাকা মানুষের মতো নিজের জীবন কাটায়, নিজেরা চিন্তাভাবনা করে না, তাদের সংশয়, পরীক্ষা বা বিপদে পড়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি।
মানুষ আসমানি কিতাব থেকে ইসলামের ব্যাপারে যে নিশ্চয়তা লাভ করে তা বৃদ্ধি পায় সৃষ্টির মধ্যে আল্লাহর নিদর্শন পর্যবেক্ষণের দ্বরা। আল্লাহর সৃষ্টি, প্রজ্ঞা ও শক্তিকে নির্দেশ করে এমন অসংখ্য নিদর্শন আছে। মুমিনের স্বভাব হচ্ছে সে এসব নিদর্শন নিয়ে চিন্তাভাবনা করে এবং এগুলোকে আসমানি কিতাবের নিদর্শনের সাথে সরাসরি সম্পর্কিত করে।