ফাতিমা আয-যাহরা (রা.)। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর প্রিয় মেয়ে, তাঁর অন্তর প্রশান্তকারিনী। তাঁর হাতই রুক্ষ, খসখসে হয়ে গিয়েছিল কারণ তিনি নিজ হাতে ময়দা পিষতেন, কাপড় ধৌত করতেন, বাড়ির যত্ন নিতেন। তাই তিনি একদিন তাঁর স্বামী আলি (রা.) কে বললেন, ‘আপনি রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর সাথে দেখা করে তাঁর সাথে কথা বলুন। আমরা মাত্রই যুদ্ধলব্ধ গণিমত লাভ করেছি যাদের মধ্যে দাসও রয়েছে। আপনি তাকে আমাদের বাড়িতে দাস প্রেরণ করার জন্য অনুরোধ করুন।’
আলি (রা.) রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর কাছে গিয়ে তাঁর প্রয়োজনের ব্যাপারটি জানালেন। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তার কথা শুনলেন এবং বিকেলে তাদের বাসায় দেখা করতে গেলেন। তাদের অত্যন্ত নিকটে গিয়ে বসলেন। তারা রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর উষ্ণতা অনুভব করতে পারছিলেন। তাঁর প্রতি তীব্র শ্রদ্ধার কারণে তারা উঠে দাঁড়াতে চাইছিলেন। তিনি তাদেরকে পূর্বের জায়গাতেই থাকতে বললেন।
তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, ‘তোমরা ভাববেনা যে আমি তোমাদের প্রয়োজনের ব্যাপারে অনবগত।’ তিনি তাদেরকে যত ইচ্ছা ততজন দাসই দিতে পারতেন। তিনি তাদের বললেন, ‘দাসের চেয়ে তোমাদের জন্য উত্তম প্রতি রাতে ৩৩ বার সুবহানআল্লাহ, ৩৩ বার আলহামদুলিল্লাহ এবং ৩৪ বার আল্লাহু আকবার বলা। তোমাদের দুনিয়াবি সামগ্রী প্রয়োজন নেই।’ আলি (রা.) বলেন, ‘আমি এই আমল জীবনে কখনো ছেড়ে দেই নি। যুদ্ধ, ঝঞ্ছা, বিপদ যাই থাকুক না কেন আমি সুবহানআল্লাহ ৩৩ বার, আলহামদুলিল্লাহ ৩৩ বার এবং আল্লাহু আকবর ৩৪ বার পাঠ করেই ঘুমোতে গিয়েছি।’ কেবলমাত্র আল্লাহর স্মরণেই তো আত্মা প্রশান্তি লাভ করে এবং শান্তি খুঁজে পায়।
রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর মেয়েকে এতটাই ভালোবাসতেন যে ফাতিমা (রা.) তাঁর কাছে এলেই তিনি তাকে দেখে উঠে দাঁড়াতেন এবং তাঁর কপালে চুমু খেতেন এবং তাকে নিজের জায়গায় বসতে দিতেন। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কোন ভ্রমণ বা অভিযান থেকে ফিরে এলে তিনি প্রথমে মসজিদে যেয়ে দুই রাক’আত সালাত আদায় করতেন এবং এরপরে ফাতিমা (রা.) এর বাসায় গিয়ে তাকে অভ্যর্থনা জানাতেন। তারপরে তিনি স্ত্রীদের বাড়িতে দেখা করতে যেতেন।
সকল জান্নাতী নারীর নেতৃত্ব দেবার পাশাপাশি তিনি জান্নাতের সবচেয়ে সম্মানিত মানুষদেরকেও জন্ম দিয়েছেন। তাদের নাম আল-হাসান এবং আল-হুসাইন (রা.)।
ইসলাম প্রচারের শুরুর দিকে একদিন রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কাবার সামনে ইবাদত করছিলেন। আবু জাহেল, উক্ববা ইবনে আবি মু’আইত আর শাইবা সেখানে ছিল। আবু জাহেল একটি প্রস্তাব দিল। সে বললঃ ‘কে উটের বর্জ্য তুলে নিয়ে তা মুহাম্মদের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পিঠে ফেলে আসতে পারবে তাঁর ইবাদত রত সময়ে যেন সে অপমানিত হয়?’ এই আবু জাহেলই রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর সালাত আদায়ের সময় তাঁর ঘাড়ে তাঁর পা তুলে দিয়েছিল, সেই রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর দিকে উদ্দেশ্য করে আবর্জনা ছুঁড়ে মারত। কিন্তু সে এবার তাকে আরো বেশি নিচে নামাতে চাইল। আর এই হীন কাজের দায়িত্ব উক্ববা ইবনে আবি মু’আইত নিজে তুলে নিল। সে উঠে গেল এবং উটের সকল বর্জ্য ধরে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর সিজদাবনত অবস্থায় তাঁর পিঠে ফেলে দিল। বর্জ্যটা অত্যন্ত ভারী ছিল। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উঠতে পারছিলেন না। ফাতিমা (রা.) এর বয়স তখন অনেক কম ছিল, তিনি কিশোরীতেই পরিণত হন নি। তিনি তাঁর পিতাকে এই অবস্থায় দেখলেন, দেখলেন কিছু মানুষরূপী পশু তাঁর পিতাকে গালি দিচ্ছে, তাকে নিয়ে হাসি ঠাট্টা করছে, তাকে উপহাস করছে। এই অবস্থাতেই তিনি ছুটে আসলেন, এসে তাঁর পিতার পিঠ থেকে নিজ হাতে সব নোংরা সরালেন। কল্পনা করুন সেই মেয়েটি কি পরিমাণ কষ্ট পেয়েছিল এই ঘটনায়। তিনি কাঁদতে লাগলেন। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর মেয়েকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, ‘হে আমার মেয়ে! তুমি কেঁদোনা। মহান আল্লাহ তোমার বাবাকে সাহায্য করবেন, তোমার বাবাকেই বিজয় দান করবেন।’
তিনি তাঁর বাবার উপর সম্পূর্ণ আস্থা রেখেছিলেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন তারা এক দুর্গম যাত্রায় নিজেদের আসীন করেছেন। এই যাত্রা বিপদ ও সংকটে পূর্ণ। কিন্তু তিনি এই পথকে পাড়ি দিতে থাকেন তাঁর মা খাদিজা (রা.) এবং তাঁর বাবা মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর সাথে।
তিনি রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কে সঙ্গ দিয়েছিলেন যখন তিনি ছিলেন একাকী। খাদিজা (রা.) এর মৃত্যুর পরে বাড়িতে কেবল রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও ফাতিমাই (রা.) ছিলেন। কল্পনা করুন কেমন দৃঢ়চেতা ছিলেন তিনি। তাঁর বয়স যখন পাঁচ বছর তখন থেকেই রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর উপর ওহী অবতীর্ণ হয়। তাই তিনি ইসলামের উপরেই বেড়ে উঠার সুযোগ পেয়েছিলেন।
সেই কষ্টের দিনগুলির কথা চিন্তা করুন, যখন রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর অবলম্বন খাদিজা (রা.) ও তাঁর চাচা আবু তালিব মারা যান। তখন তাকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দেখাশোনা করতেন তারই মেয়ে ফাতিমা (রা.), তিনিই তাঁর সাহায্যে নিজেকে উজাড় করে দিতেন, তাঁর জন্য খাবার রান্না করতেন। তিনি তাঁর মায়ের স্থলাভিষিক্ত হয়ে সান্ত্বনা দিতেন রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কে। ফাতিমা (রা.) কে বলা হত ‘বাবার মাতা’। কারণ তিনি মায়ের মত রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর যত্ন নিয়েছেন।
মাদানী জীবনে ফাতিমা (রা.) বেড়ে উঠছিলেন। তাঁর বিয়ের জন্য প্রস্তাব আসতে থাকে। মহান আল্লাহ তাঁর জন্য আলি (রা.) কে নির্ধারণ করেছিলেন। তারা একে অপরকে জানতেন এবং একে অপরের মহত্ত্ব সম্পর্কেও অবগত ছিলেন। আলি (রা.) মহান আল্লাহ এবং রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর প্রিয়পাত্র ছিলেন। আলি (রা.) সম্পর্কে মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, ‘মুমিন ব্যতীত তোমাকে কেউ ভালোবাসে না এবং মুনাফিক ব্যতীত কেউ তোমাকে ঘৃণা করেনা।’
তাদের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের নাম ছিল হাসান (রা.), হুসাইন, মুহাসসিন, জয়নব, উম্মে কুলসুম এবং রুকাইয়াহ। তারা সকলেই আলি (রা.) ও ফাতিমা (রা.) এর সন্তান ছিলেন।
একবার রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একটা চাদর গায়ে দিয়েছিলেন। সেই ক্লোকের ভেতরে ঢুকে পড়ে আলি (রা.), এরপরে হাসান, তারপরে হুসাইন এবং তারপরে তাঁর মেয়ে ফাতিমা (রা.)। এরপরে তিনি তাদেরকে জড়িয়ে চাদরটি বন্ধ করে দেন। তারপর তিনি নিম্নোক্ত আয়াতটি তিলাওয়াত করেনঃ
“হে নবী পরিবারের সদস্যবর্গ। আল্লাহ কেবলই চান তোমাদের থেকে অপবিত্রতা দূর করতে এবং তোমাদেরকে পূতপবিত্র করতে।” [সূরা আল আহযাব ৩৩:৩৩]
রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর অনেক বৈশিষ্ট্যকে তিনি নিজের করে নিয়েছিলেন। তাঁর একটি ডাকনাম ছিল আয-যাহরা বা ‘যিনি অসাধারণ’। তাঁর এমন নামের কারণ তাঁর লালচে চেহারা, তাঁর অপূর্ব সুন্দর লালচে মুখশ্রী ছিল। আর তিনি এমন একজনের কন্যা যার চেহারা ছিল পূর্ণীমার চাঁদের মত উজ্জ্বল। আইশা (রা.) তাঁর ব্যাপারে চমৎকার একটি উক্তি করেন। তিনি বলেন, ‘আমি আল্লাহর সৃষ্টির মধ্যে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও বাচনভঙ্গি বেশী আয়ত্ব করতে পেরেছে এমন কাউকেই দেখিনি ফাতিমা (রা.) ব্যতীত।’ তিনি আরো বলেন, ‘যখনই তিনি এমন ঘরে ঢুকতেন যেখানে রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ছিলেন, তাহলে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাকে দেখেই উঠে দাঁড়াতেন, তাকে অভ্যর্থনা জানাতেন, তাকে চুমু খেতেন, তাঁর হাত ধরতেন এবং তাকে তাঁর জায়গাতেই বসাতেন।’ এভাবেই তিনি তাকে সম্মান করতেন এবং তাঁর সম্মানকে উঁচু স্থানে সমুন্নত রাখতেন। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর ব্যাপারে বলেন, ‘সে জান্নাতের নারীদের নেতৃত্ব দেবে।’ তিনি কেবল তাঁর ঈমানকেই পূর্ণাঙ্গ করেননি, বরং জান্নাতের নারীদের নেত্রী হবার যোগ্যতাও অর্জন করেছেন।
ফাতিমা (রা.) রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এরই এক অংশ ছিলেন। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর
একাংশের সাথে আর কার তুলনা হতে পারে? তিনি বলেনঃ ‘যে তাকে রাগান্বিত করে, সে আমাকে রাগান্বিত করে। যে তাকে আনন্দিত করে, সে আমাকে আনন্দিত করে।’ ফাতিমা (রা.) এর সম্মান এতটাই বেশী যে তাঁর সুখ, তাঁর রাগ রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর সাথে সম্পর্কিত।
ফাতিমা (রা.) তাঁর সততা, তাঁর আনুগত্য, তাঁর পরহেজগারীতা, তাঁর সাহসিকতা, তাঁর ত্যাগ-তিতিক্ষা, রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর অনুকরণের জন্য সুপরিচিত। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যখন তাঁর জীবন সায়াহ্নে উপস্থিত হন তখনও তাঁর বয়স তেমন ছিল না। সময়টা ফাতিমা (রা.) এবং অন্যান্যদের জন্য কঠিন পরীক্ষা ছিল। সেসময় একটি ঘটনা ঘটে যা আইশা (রা.) বর্ণণা করেন। ‘তিনি ফাতিমা (রা.) কে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর সাথে দেখেন যখন তিনি অসুস্থ ছিলেন। ফাতিমা (রা.) রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর অসুস্থতা দেখে কাঁদতে শুরু করেন। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাকে স্নেহভরে নিজের কাছে ডাক দেন। বলেন, ‘এসো, তোমাকে কিছু কথা বলি।’ আইশা (রা.) দেখেন রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ফাতিমা (রা.) এর কানে কিছু বলছেন। এতে ফাতিমা (রা.) এর কান্না আরো বেড়ে যায়। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, ‘আমার কাছে এসো। আমি তোমাকে আরো কিছু বলি।’ এরপর তিনি আবার তাঁর কানে কানে ফিসফিস করে কিছু বললেন এবং সেটা শুনে ফাতিমা (রা.) হেসে ফেললেন। মানুষ এটা দেখে আশ্চর্য হয়ে গেল। আইশা (রা.) তাগাদা দিতে লাগলেন, ‘আমাকে বলুন রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আপনাকে কি বলেছেন।’ প্রথমে তিনি বলতে চাইছিলেন না কিন্তু এক পর্যায়ে তিনি আইশা (রা.) এর তাগাদার কাছে হার মেনে বলেই ফেললেন। তিনি বললেন, ‘প্রথমে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাকে বললেন তিনি এই অসুস্থতা কাটিয়ে উঠবেন না। এরপরে তিনি আমাকে আবার ডেকে বললেন, ‘মৃত্যুর পরে তুমিই আমার সাথে প্রথম দেখা করবে।’
রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর মৃত্যুর মত কষ্টদায়ক কিছু আর কখনোই ছিল না। মুমিনরা তাঁর উপর নির্ভরশীল ছিলেন, তাঁর উপরেই নিজেদের ভরসাকে স্থাপন করেছিলেন। কারণ তিনিই তো তাদের নবী যিনি তাদের সর্বনিম্ন স্থান থেকে সর্বোচ্চ মর্যাদার স্থানে নিয়ে এসেছেন। তিনিই তো তাদের নেতা যিনি তাদের সর্বক্ষেত্রে সফলতার সাথে নেতৃত্ব দিয়েছেন। তিনিই তো তাদের ভালোবাসার পাত্র। তারাও তাদের ভালোবাসার সর্বোচ্চটা ঢেলে দিয়েছিলেন তাদেরই রাসূলের প্রতি।
রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর মৃত্যূতে ফাতিমা (রা.) এর কেমন অনুভূতি হতে পারে কল্পনা করুন। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর অসুস্থতা দেখে ফাতিমা (রা.) সহ্য করতে না পেরে বলে উঠেন, ‘আহ! কি বেদনাদায়ক।’ তখন রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর প্রতিউত্তরে বলেন, ‘তোমার বাবার আজকের পরে আর কোন কষ্ট থাকবেনা।’ এভাবেই তিনি ইঙ্গিত দিয়েছিলেন যে তিনি মারা যাচ্ছেন।
ফাতিমা (রা.) কষ্টে ভেঙ্গে পড়েছিলেন। তাকে সান্ত্বনা দেবার জন্য রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ ‘তোমাকে কি এই ব্যাপারটি খুশি করে না যে তুমি সকল মুমিনের নেতা?’ এটা শুনে ফাতিমা (রা.) আনন্দিত হলেন। কিন্তু রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর মৃত্যুর পরেই তিনি বলে উঠেনঃ ‘ইয়া আবাতা’ (হে আমার পিতা) আপনার রব আপনাকে ডেকেছেন আর আপনি তাতে সাড়া দিয়েছেন।’ এই ডাকটি ছিল জান্নাতুল ফিরদাউস থেকে।
রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর মৃত্যূ তাকে এতটাই প্রভাবান্বিত করেছিল যে তিনি ঘর থেকেই বের হতেন না। সাহাবারা তাকে সমাহিত করার পরে তিনি আনাস (রা.) কে বললেন, ‘হে আনাস! তুমি কিভাবে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর মৃতদেহের উপর বালি ছুঁড়ে দিতে পারলে?’
তিনি বলেন, ‘আমার উপর এমন ফিতনা এসেছে সেই ফিতনা যদি দিনকে আক্রান্ত করত তাহলে তা দিনকে রাত করে দিত।’ এখান থেকেই অনুভব করা যায় কতটা কষ্টে ছিলেন তিনি রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর মৃত্যূর কারণে।
৪ থেকে ৬ মাস পরেই ফাতিমা (রা.) অসুস্থ হয়ে পড়েন। তিনি রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর মৃত্যূর পর থেকেই অসুস্থ ছিলেন তাঁর পিতার বিয়োগবেদনার কারণে। তাঁর সুখী পরিবার ছিল, তিনি উম্মাহর শ্রেষ্ঠ পুরুষদের একজনকে বিয়ে করেছিলেন কিন্তু এরপরেও তিনি তাঁর পিতার সাথে জান্নাত আল ফিরদাউসে থাকতে চাইতেন। তিনি আকাশের দিকে তাকিয়ে হাসতেন।
তিনি আবু বকর আস-সিদ্দিক (রা.) এর স্ত্রী আসমা’ বিনতে আবু উমাইস (রা.) কে ডাক দেন। তারই ফাতিমা (রা.) কে গোসল করানোর কথা ছিল। এবং খেয়াল করে দেখুন কি চমৎকারভাবে ফাতিমা (রা.) তাঁর কথা উপস্থাপন করছেন, কতটা সম্ভ্রান্তই না ছিলেন তিনি! তিনি তাকে বলেন, ‘যখন আমার গোসল করাবে এবং জানাযা পড়াবে তখন পুরো কাজটি করবে রাতে যেন মানুষ আমার আকৃতি না বুঝতে পারে।’ সুবহানআল্লাহ! শুধু এই বাক্যটিই একজন নারীকে তাঁর পর্দা এবং লজ্জা সম্পর্কে শিক্ষা দেয়ার জন্য যথেষ্ট। তিনি তাঁর লজ্জা, সম্ভ্রমের এর জন্য পরিচিত ছিলেন। তাঁর সমকক্ষে আসতে পারে এমন সৌভাগ্য কার? আর হবেনই বা কেন, তিনি তো এমন একজনের কন্যা যিনি মানব ইতিহাসে সবচেয়ে বেশী লাজুক, সবচেয়ে বেশী সম্মানিত ব্যক্তি।
তাঁর মৃত্যুর পরে মহান আল্লাহ তাকে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর সাথে মিলিয়ে দেন। তিনি হয়ে যান জান্নাতী নারীদের সর্দার।
আমরা শেষ পর্যায়ে চলে এসেছি। তবে দুটি বিষয় খোলাসা করা দরকার। কারণ এই দুটি বিষয়ে কিছুটা মতপার্থক্য রয়েছে।
প্রথমটি হচ্ছে সেই সময়ের ঘটনা যখন রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মারা যান এবং এরপরে ফাতিমা (রা.) আবু বকর (রা.) এর কাছে এসে বলেন (তখন তিনি খলিফা), ‘আপনি আমাকে ফাদাকের ভূমিটি দিন।’ আবু বকর (রা.) বললেন, ‘কিন্তু আমি তো আপনাকে তা দিতে পারব না, আপনি জানেন কারণ রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, তাঁর পরিবার সম্পদ রেখে যায় না। তাঁর সম্পদ, তাঁর ভূমি সবকিছুই সাদাক্বা হয়ে যায়।’ ফাতিমা (রা.) তখন কিছুটা হতাশ হন আবু বকর (রা.) এর উপর। ফাতিমা (রা.) তাঁর মৃত্যূর আগ পর্যন্ত আর তাঁর সাথে কথা বলেননি। মানুষ এই ঘটনাকে বিকৃত করার চেষ্টা করে। তারা বলে, ফাতিমা (রা.) রাগান্বিত ছিলেন আর তারা বলতে চায় সেই হাদিসটি উদ্ধৃতি করে, ‘যারা ফাতিমাকে (রা.) রাগান্বিত করে, তারা আমাকেও (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) রাগান্বিত করে। যারা ফাতিমা (রা.) কে আনন্দিত করে তারা আমাকেও আনন্দিত করে।’
প্রথম কথা হচ্ছে, ফাতিমা (রা.) এই হাদিস জানতেন না তাই তিনি এই দাবি করতে গিয়েছিলেন। আবু বকর (রা.) এর কাছ থেকে শোনার পর ফাতিমা (রা.) বলেছিলেন, ‘রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) থেকে যা শুনেছেন সে সম্পর্কে আপনিই অধিক পরিজ্ঞাত।’ (মুসনাদে আহমাদ, হা-নং-১৪)
এর পরে আর কথা বলেন নি এর ব্যাখ্যা হচ্ছে মিরাস এর ব্যাপারে আর আলাপ তুলেন নি। এরপরে যারা এই ঘটনা বর্ণনা করেছেন তাদের মধ্যে শিয়া প্রভাবিত রাবি ছিলেন বলেই এভাবে বর্ণনা করেছেন।
ইবনু কাসির (রহ.) বলেন, “সম্ভবত কোন কোন বর্ণনাকারী নিজে যা বুঝেছেন, তা-ই বর্ণনা করেছেন। এটাও জেনে নেয়া প্রয়োজন যে, এ বর্ণনাকারীদের মধ্যে এমন কেউ রয়েছেন, যার মধ্যে শিয়া মতের প্রভাব ছিল।” (ইবনু কাসির, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, খ. ৫, পৃষ্ঠা ৩১০)
যায়িদ ইবনু আলি (রা.) বলেন, “আমি যদি আবু বকর (রা.) এর জায়গায় হতাম, তবে আমি অবশ্যই ফাদাকের তা-ই ফায়সালা করতাম যা আবু বকর (রা.) করেছিলেন।” (বাইহাকী, দালালিয়ুন নুবুওয়াত, (আবওয়াবু মারদি রাসূলিল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম), হাদিস নং ৩২৭৮; ইবনু কাসির, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, খ. ৫, পৃষ্ঠা ৩১০)।
খাইবার ও ফাদাকে রাসুলুল্লাহ সা. এর যে অংশটি ছিল তা সর্বসাধারণের জন্য ওয়াকফকৃত হবার ব্যাপারে আলী ও আব্বাস (রা.)-এর কোনোরূপ সন্দেহ ছিল না। তবে খালীফাকেই এর মুতাওয়াল্লী (দেখাশোনা ও পরিচালনাকারী) হতে হবে এমন কথা তাঁরা মনে করেননি; বরং তাঁরা মনে করতেন, রাসুলুল্লাহ সা. এর আত্মীয়-স্বজনরাই এর মুতাওয়াল্লী হবেন। উমার (রা.) এর খিলাফাত কালে নেতৃস্থানীয় মুহাজির ও আনসারগণের উপস্থিতিতে তাঁর এবং আলী ও আব্বাস (রা.) প্রমুখের মধ্যে যে আলোচনা হয়, তাতে এ কথা প্রতীয়মান হয়ে যে, আলোচনার বিষয়বস্তু উত্তরাধিকার ছিল না; বরং মুতাওয়াল্লী হবার প্রসঙ্গটিই ছিল আলোচনার মুখ্য বিষয়। বলাই বাহুল্য যে, রাষ্ট্রীয় সম্পদের মুতাওয়াল্লী হবার অধিকার যেহেতু খালীফার ছিল এবং একজন সৎ ও ন্যায়বান লোক ইচ্ছে করলে অপর কারো জন্য নিজের এ অধিকার থেকে বিরত থাকতে পারেন, তাই উমার (রা.) আহলে বাইতের মনন্তুষ্টির জন্য খাইবার ও ফাদাকের মুতাওয়াল্লীর পদ এবং এর ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব আলী ও আব্বাস (রা.) কে প্রদান করেন। সুতরাং উমার (রা.) যখন তাঁদেরকে এ দায়িত্ব প্রদান করেন, তখন তাঁদের নিকট থেকে সুস্পষ্টভাবে এই অঙ্গীকার গ্রহণ করেন যে, তাঁরা যেন এর উৎপন্ন আয় ঐ সকল লোকের জন্য ব্যয় করেন, যাদের জন্য রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ব্যয় করতেন।
এগুলো ছাড়াও আরো বর্ণণা রয়েছে। আবু বকর (রা.) এই ঘটনার পরে আলি ও ফাতিমা (রা.) এর বাড়িতে যান। আলি (রা.) ফাতিমা (রা.)কে বলেন, ‘আবু বকর (রা.) দরজায় অবস্থান করছে। তুমি যদি অনুমতি দাও, তাহলে তাকে প্রবেশ করতে দিব।’ আবু বকর (রা.) ভেতরে ঢুকে তাঁর সাথে কথা বলেন এবং বর্ণণার শেষে দেখা যায় যে ফাতিমা (রা.) তাঁর উপর খুশিই হয়েছিলেন। ফাতিমা (রা.) যে আবু বকর (রা.) এর প্রতি রাগান্বিত হননি এটা বোঝাই যায় কারণ তাই যদি হত তাহলে তিনি খিলাফতে আবু বকর, উমর, উসমান (রা.) এর সাথে গুরত্বপূর্ণ অবস্থানে অবস্থান করতেন না এটা জানার পরেও যে আবু বকর (রা.) তাঁর স্ত্রীকে রাগান্বিত করেছেন।
এরপরে আরেকটি ডাহা মিথ্যা প্রচার করা হয় উমর (রা.) এবং ফাতিমা (রা.) এর মধ্যে। বলা হয়, উমর (রা.) ফাতিমা (রা.) সামনেই দরজা বন্ধ করে দিয়েছিলেন যখন ফাতিমা (রা.) মুহাসসিনকে (রা.) গর্ভে ধারণ করেছিলেন। আমরা বিশ্বাস করি যে মুহাসসিন রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর জীবিত থাকা অবস্থাতেই জন্ম গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু গর্ভপাতের কারণে শিশুটি মারা যায়। এজন্য কিছু মানুষ মিথ্যা ছড়ায়ঃ ‘দেখো উমর (রা.) কি করল!’ এই ব্যাপারটি মিথ্যা এবং গুজব ছাড়া আর কিছুই না। এধরণের বর্ণণা আলি (রা.) কে ছোট করে। তারা বুঝাতে চাচ্ছেঃ আলি (রা) কি তাঁর স্ত্রীকে ডিফেন্ড করতে পারলেন না? এমন কোন কিছু ঘটতে দেবেন যদি কেউ তাঁর সন্তানকে হত্যা করে?’ এগুলো তাঁর বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচারণা ছাড়া আর কিছুই নয়।
আল্লাহ যেন আমাদের সেসব বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত করে নেন যারা জান্নাতে খাদিজা (রা.), ফাতিমা (রা.), আসিয়া (আ.), মারইয়াম (আ.) এর সাথে দেখা করার সুযোগ পাবে। আল্লাহ আমাদের নারীদের তাদের উত্তম অনুসারীতে পরিণত করুন।